বঙ্গ-নিউজঃ ইতিহাস বিকৃতকারীরা যেন আর কখনও ক্ষমতায় আসতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে আরও এগিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এ দেশ গড়ে উঠবে। আগামীর বাংলাদেশ হবে অর্থনৈতিক মুক্তির ও সমৃদ্ধির বাংলাদেশ।’বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো বিশ্ব প্রামাণ্য ঐহিত্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় শনিবার রাজধানীতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনন্দ শোভাযাত্রা শেষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। সরকারিভাবে রাজধানীসহ সারা দেশেই এ শোভাযাত্রা কর্মসূচি পালন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে ৬ দফা, ৭ মার্চের ভাষণ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনসহ বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন।
৪৬ বছর আগের এ ভাষণকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ আখ্যা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘদিন ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করতে দেয়া হয়নি। এ ভাষণ বাজাতে গিয়ে বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছে। এ ভাষণ এখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। সত্য ইতিহাস চিরভাস্বর। ইতিহাস কেউ মুছে ফেলতে পারে না।
কোনো দলের নাম উল্লেখ না করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘যারা এ ভাষণ একদিন নিষিদ্ধ করেছিল তাদের অবস্থানটা এখন কোথায়? তারা যে মহাসত্যকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। তারা কোথায় মুখ লুকাবে?’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় চলে আসা, রাজাকার, আলবদরদের মন্ত্রী করার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলন, ‘৭৫-এ শুধু জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়নি, যে আদর্শ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই আদর্শকেও ভূলুণ্ঠিত করে রাজাকার-আলবদরকে ক্ষমতায় বসানো হয়। তারা ইতিহাস বিকৃত করে। জাতির পিতার ভাষণ নিষিদ্ধ করে। এ ভাষণ বাজাতে গিয়ে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। দেশের কয়েকটি প্রজন্ম স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে পারেনি মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রাজাকার, আলবদর স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, ইতিহাস বিকৃতকারীরা যেন কখনোই আর ক্ষমতায় আসতে না পারে।’
জাতির পিতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যও কাজ শুরু করেছিলেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, তার দেখানো পথেই এখন এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের অর্থনীতি এখন শক্তিশালী। বাংলাদেশকে একসময় বিশ্ব করুণার চোখে দেখত মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আন্তর্জাতিকভাবে দেশ মর্যাদা পেয়েছে। আজ আমাদের কেউ করুণা করতে পারে না, অর্থনৈতিকভাবে আমরা আজ শক্তিশালী। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেদিনের ভাষণের প্রেক্ষাপট, তার ভাষণের নানা বক্তব্যের ব্যাখ্যাও দেন প্রধানমন্ত্রী। সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থেকে এ ভাষণ শোনা এবং লাখো মানুষের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করার কথাও বলেন তিনি।
সেই ভাষণেই বঙ্গবন্ধু দেশবাসীকে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, বাংলার মানুষের সঙ্গে জাতির পিতার একটা আত্মিক সম্পর্ক ছিল। সে জন্য তিনি সম্বোধন করেছিলেন ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের যা যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’ আরও বলেছিলেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।’ এখনও বারবার মনে পরে সেই দিনের কথা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা জানতেন, এ ভাষণের পর স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে, তাকে হত্যা বা গ্রেফতার করা হতে পরে। সে জন্যই তিনি বলে গিয়েছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি… আমাকে যদি হত্যা করা হয়…’। এত দূরদর্শী ভাষণ বিশ্বে আর একটিও নেই।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, এত দূরদর্শী ও এত নির্দেশনা বিশ্বের আর কোনো ভাষণে নেই। এ ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের কথা বলেছিলেন, গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলেছিলেন। তিনি জয় বাংলা বলে তার ভাষণ শেষ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু এ দেশের মানুষকে রাজনৈতিক মুক্তি দিয়েছেন, অর্থনৈতিক মুক্তি দেয়ার পথে হাঁটা শুরু করেছিলেন। দেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তখনই স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করা হয়।
তিনি আরও বলেন, বাবা যেদিন ভাষণ দেবেন তার আগের দিন মা বলেছিলেন- তোমার মনে যা আসে, তুমি যা বিশ্বাস কর, সেটাই বক্তব্যে বলবে। বাবা তাই করলেন। তার ভাষণ লিখিত ছিল না। ছিল না কোনো কাগজ বা নোট।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে স্বীকৃতি দেয়ায় ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেসব দেশ এ প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে এবং যারা উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। এ স্বীকৃতি যারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন তাদেরও স্বীকৃতি। এ ভাষণে যে শুধু নির্দেশনা ছিল তাই নয়, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কেমন হবে, সেটাও বঙ্গবন্ধু বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার পরিকল্পনা আরও আগের জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭০ সালের ৫ ডিসেম্বর তিনি তিন নেতার মাজারে ফুল দিতে গিয়ে বলেছিলেন, এই ভূখণ্ডের নাম হবে বাংলাদেশ। আজ লাল-সবুজের পতাকাও তারই পছন্দ করা। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি, এটা তার খুব পছন্দের গান ছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সাড়ে তিন বছরেই বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ কারণেই তাকে হত্যা করা হয়। জাতির পিতা মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন। এক কোটি মানুষ শরণার্থী, সাত কোটি মানুষের মধ্যে সাড়ে তিন কোটি মানুষ গৃহহীন, লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, নারী ধর্ষিত হয়েছে। রাস্তাঘাট, সেতু ধ্বংস হয়েছে। এসব রাস্তাঘাট মেরামত করা, গৃহহীনদের ঘরের ব্যবস্থা করা, শহীদ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে অগ্রযাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের। কিন্তু শত্রুরা তা থামিয়ে দেয়।’
সমাবেশ উপলক্ষে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছিল লোকে লোকারণ্য। দুপুর থেকে উদ্যানে আসতে থাকেন রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, সরকারি চাকুরে, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুপুর থেকেই চলে নানা আয়োজন। নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি উপভোগ করেন আগত অতিথিরা। এদিকে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে শোভাযাত্রা নিয়ে সরকারি চাকুরেরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যেতে শুরু করেন। তবে এর ঘণ্টা খানেক আগে থেকেই বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আশপাশের সড়কগুলোয় অবস্থান নিতে শুরু করেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই ঢাকঢোলসহ এসেছেন। তারা নানা রঙের টি-শার্ট পরেছেন। বহন করছেন ব্যানার। আনন্দ শোভাযাত্রায় রাখা হয় হাতিও।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম। তিনি স্বাগত বক্তৃতা দেন। আরও বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, সরকারের পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিক, দেশবরেণ্য কবি, সাহিত্যিক প্রবন্ধকারসহ সব শ্রেণী পেশার নাগরিক উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪:৩৩:৫৭ ৭৪১ বার পঠিত #bangla news #bangla newspaper #bangladesh news #bd news #daily newspaper #World News