“আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ-এর গল্প, লোরেনের সাথে আমার প্রেম”

Home Page » সাহিত্য » “আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ-এর গল্প, লোরেনের সাথে আমার প্রেম”
মঙ্গলবার, ১১ জুন ২০১৩



sayeed-bg20130610233806.jpgবঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ লোরেনার সাথে আমার সম্পর্ক একটু অদ্ভুত হলেও একেবারে যে মিথ্যা না। এটিকে আমার বুকের গভীরে হাত রেখেও টের পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। অনেক সম্পর্ক আছে পৃথিবীতে সত্য না মিথ্যা, ভালো না মন্দ এমন পাতলা টান টান থিন লাইনের সামনে রেখেও প্রমাণ করা যায় না। কারণ সেই সম্পর্কটা শুধু একটা ফিরে ফিরে আসা বোধের মধ্যে ঘুরপাক খায়। সেটি ঠিক দেখা যায় না, কেবল বোঝা যায়। আমার ঠিক তাই হলো। লোরেনা আমার ক্লাসের নতুন আসা ছাত্রী। ইংরেজি শিখতে এসেছে। দেশ দক্ষিণ আমেরিকার এল সালভাদর। তো হঠাৎ করে এই মেয়ে বা মহিলাটি আমার মনে কিভাবে একটা শূন্যতা জাগিয়ে দিল সেটির কারণ আমি ঠিক করে বুঝে উঠতে পারিনি। তবে এটুকুই জানি যে তার সারা মুখে এমন একটা কমনীয়তা আছে এমন পাতলা একটা স্কিনের যাদু আছে যে যেন এই প্রথম আমি আমার আমাকে সেখানে আবিষ্কার করেছি। তার মুখটার মধ্যে কোনো ধরেনের কোলাহল বা হাঙ্গামা নেই। এমন করে পুরো মুখটা বসানো যে শত আড়াল করলেও সেখান থেকে একটা মৃদু ভাষা আসে। আমার নিউরনে গিয়ে টং করে আঘাত করে। তাকে দেখা মাত্রই আমার ভেতরে একটা বিহেভরিয়্যাল চেঞ্জ আসে। হাত কেঁপে উঠে, গলার শক্তি বেড়ে যায়, চোখ আরো ধারালো হয়। তখন আমি রিডিং গ্লাস ছাড়াই সবকিছু পড়তে পারি। সে ক্লাসে তেমন কথা বলে না। কোনো গ্রুপ অ্যাক্টিভিটি দিলে সবার সাথে কথা বলে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই চুপ করে থাকে। আমি বুঝতে পারি কোনো কোনো চুপ থাকাও সুন্দরের কাজ। এই কথা না বলাই যেন তাকে আরো আর্কষণীয় করে ফেলেছ বা যার ফলে একটা পবিত্র রহস্য তাকে ঢেকে রেখেছে। দশ বছর ধরে আমি মাস্টারি করি। দশ বছর এমন হয়নি। কত কত ছাত্রীদের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে কথা হয়েছে। তাদের জন্য আমার এমন লাগেনি। এই কলেজে যোগদান করার পরে এই প্রথম মনে হলো সময় খুব লম্বা, সময় টেনে টেনে নিজেকে বড় করে আর আমার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। খালি ভাবি ক্লাস শরুর সময়টা আসে না কেন। কেন আটটার জায়গায় নয়টা বাজেনা! সময়ের এই সফলতা আমার কাছে তখন বড় অসহ্য আর স্বৈরচারি মনে হয়।
যা হোক এমন করে একদিন যখন লোরেনার যাদু আর আমার একান্ত মনোযোগ একসাথে ধীরে ধীরে দেয়ালের এপাশ ওপাশ দেখল তখন আর অন্ধকার থাকলো না। লোরেনার সাথে আমার প্রেম হল। প্রেমের অর্থ যদি একটা অপেক্ষা হয় বা একটা শূন্যতা হয় আমার তাই হলো। যেই নামে ডাকিনা কেন আমার ভেতরে বাইরে একটা ঘোর এসে আমাকে ঘিরে ধরল। এভাবে অনেক কথা আর না-কথার পর আমরা যখন একদিন বাইরে এলাম তখন এই ছোট শহরে শীত এসে হানা দিতে শরু করেছে। আমি এসএমএস করে লোরেনাকে বলেছি বিকেল চারটার পর ফ্রি হয়ে যাবো। তুমি ঠিক রেললাইনের অপোসিট পার্কটাতে থেকো। কলেজ থেকে বার হয়ে যখন পার্কটার সামনে গেলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। হাতে মুখে কনকনে শীত। রাস্তা ঘাট ফাঁকা হতে শুরু করেছে। একটা গরম জ্যাকেটের দরকার ছিল খুব। তাতে আর কী হবে? আজকে লোরেনা আসবে। আমার ঠাণ্ডার ভেতরই একটা গরম ভাব চলতে লাগল। দ্রুত হেঁটে রেললাইন পার হয়ে সেই পার্কটাতে ঢুকলাম। ঐতো লোরেনা। গায়ে লাল একটা জাম্পার। গলায় সাদা স্কার্ফ। চুলগুলি ঘাড় বেয়ে নিচে ঝুলে পড়েছে। আমি বললাম সরি একটু দেরি হয়ে গেল। লোরেনার কোনো রিয়েকশন নেই। চোখ মুখে রাগের কোনো চিহ্নও নাই। হাতটা ধরতে চাইলাম। হাত বাড়িয়ে আবার সরে পড়ল। শুধু শরীরের একটা গন্ধ পেলাম। তার পাতলা স্কিনের সামনে গেলে প্রতিদিন আমি সেই গন্ধটা পাই। কীসের গন্ধ এটি? এল সালভাদরের কোনো ফুলের, কোনো পাতার, কোনো বিকেলের, সন্ধ্যার নদীর? একটু হেঁটে বললাম’ তে আমো’। তে আমো স্প্যানিশ ভাষা। মানে আমি তোমাকে ভালোবাসি। লোরেনার কাছ থেকেই শিখেছি। আমার কথা শুনে লোরেনা আমার মুখের দিকে ঠিক তাকায় না। হাতের বাম পাশে একটা হলুদ আকাসিয়া ট্রি। কী হলুদ পাতা! লোরেনার মুখটা তেমন হলদে দেখায়। রেললাইন দিয়ে দ্রুত একটা ট্রেন চলে যায়। আমার বুকের ভেতর খা খা।

অনেক রাত অবধিও আমার ঘুম হলো না। বাচ্চারা তাদের মায়ের সাথে অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ একটা বিয়ের দাওয়াত ছিল। তাতেই ওরা ক্লান্ত। সকালে শারমিন বলেছিল কলেজ থেকে আসার সময় উলি থেকে রুটি দুধ আর আর ডিম নিয়ে আসতে। সন্ধ্যার আগেই আমি ওসব নিয়ে আসি। বিয়ে বাড়িতে অনেক খাওয়া। বাসায় এসে আর বেশি কিছু খেতে ইচ্ছে হলো না। আমার চোখে শুধু লোরেনার মুখ। তার চোখ চুল গ্রীবা এমন কি তার সেই সাদা রঙের স্কার্ফটাও আমার সামনে এসে উড়তে লাগল। গলায় পেঁচানো এই সাদা কাপড়টা কী অসম্ভব একটা মুহূর্ত নিয়ে আসে। এর থেকে আমার ক্লাসও মুক্তি পায় না। কদিন আগে যে ক্লাসরুম কাঠ কাঠ আর মরু সেখানে আজ নতুন পাতার বন। সবুজের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে। লোরেনার মুখটা ভাবতে লাগলাম। আমি কোথাও তাকে দেখেছি! কোথায় কোথায়? ভাবতে লাগলাম। কিন্তু কোনো কুল কিনারা পেলাম না। কতো বয়স হবে লোরেনার। পঁচিশ ত্রিশ বা বত্রিশ। কিছুই বোঝা যায় না। মাঝে মাঝে মনে হয় বিশ বা একুশ। ওর ফিগারটা এমন যে বয়স বোঝার উপায় নেই। আবার যখন সে টাইট জিন্স আর টি সার্ট পরে তখন মনে হয় ও একদম কলেজ পড়ুয়া কোনো মেয়ে। ক্লাসে সে ভালো করে কথাও বলতে পারে না। এই টার্মে আমি স্টুডেন্টদের সাউন্ড শেখাই। সাউণ্ড চার্ট দেখাই। সিঙ্গেল ভাউয়েল সাউণ্ড, লঙ ভাউয়েল সাউণ্ড, কনসোনেন্ট সাউণ্ড। স্টুডেণ্টরা আমার সাথে সাথে উচ্চারণ করে। ওরা ভালো মজা পায়। একজন চীনা ছাত্র বলে টিচার অজিরা আসলেই আহম্মক। ওরা আইসল্যাণ্ডকে বলে আইল্যাণ্ড। শুনে সবাই হেসে উঠে। আমি লোরেনার টেবিলটাতে যাই। তার সাথের খালি চেয়ারটাতে বসি। লোরেনার চোখ স্থির। আমার চোখের দিকে। পিঠ বেয়ে চুল গড়িয়ে পড়েছে। সাদা ঘাড়ে হালকা সোনালি চুল। কোন জিনিসটা আমার বেশি ভালো লাগে?। দেখলাম ওর সব চাইতে সুন্দর- ওর সেই কথা না বলা মুখটা। সাইলেণ্ট ইজ গোল্ডেন। পুরো মুখটাতে একটা লজ্জা যেন ভর করছে। আর সেইটাই তাকে ভয়ংকর একটা পরিচ্ছদে ঢেকে দিয়েছে। এরকম কত দক্ষিণ আমেরিকার মেয়ে আমার ছাত্রী ছিল। বিশেষ করে চিলিয়ান মেয়েগুলি। কী সব আলট্রা স্মার্ট তারা। পোশাক পরার বেলায় তারা বেশ খোলামেলা। আর এই আমার লোরেনা এর উল্টো। সবকিছুর মধ্যেই যেন একটা নিখুঁত পরিমাপের বিষয় তার আছে। সে দেখানোর কোন ভান করে না। বরং লুকিয়ে থাকতে পারলে সে বাঁচে। তাকে দেখতে দেখতে আমার আর সাউণ্ড শেখানোর কথা মনেই থাকে না। আমার দেখতে পেলাম এল সালভাদরের একটি অচেনা হারিয়ে যাওয়া পাখি আমার মুখের সামনে উড়েছে। তার চঞ্চুতে একগুচ্ছ সোনালি খরকুটো। আমি তাকে ধরতে চাইছি আর সে উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। আশ্চর্য এক সময় আমি তার কোনো ডানা দেখতে পাই না, তার ঠোঁটও দেখতে পাই না। শুধু তার উড়ালের মায়া আমার দুচোখ অবশ করে তোলে। কী তার আছে যে আমার এতো ভালো লাগে? আমি পরীক্ষা করি তার সেই মধুরতা তার সেই কমনীয়তা। বুঝলাম তার সেই হাল্কা বাতাসের মতো কথা বলাতে আমার সব ভালো লাগা। আমি বলি স্প্যানিশ ভাষায় বলো তো- আই লাভ ইউ? লোরেনা বলে ‘তে আমো’ বলে সে লজ্জা পায়। হাত গুটিয়ে ফেলে। শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে নেয়। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তার সেই আঙুলগুলিকে আবার দেখি। এগুলি কী? জলপাতা, জলরেখা, ভেজাফুল, এগুলি কী? পার্কে হাঁটা শেষে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে প্রথমে পানির অর্ডার দিই। কী খাবে তুমি? লোরেনা মেন্যু দেখে। তার নরম আঙুলের ভেতর কনকনে শীত। না কনকনে আগুন। গলার বা দিকটা একটু খোলা। মানে এখন আর সেই স্কার্ফটা নেই। আমি বললাম তুমি স্কার্ফটা পর না প্লিজ। তার ভাষা তেমন বুঝি না, সেও আমারটা। বেশির ভাগ সময় ইশরায় কথা হয়। আমি বলি তোমার বাসায় যেতে চাই।

-আমাকে নেবে?
-কেন?
-তোমার সাথে একটু থাকতে চাই।
-বাসায় তো আমার বাচ্চারা আছে। ওরা কী ভাববে?
-তাতে কী
-ওরা কী বলবে।
-ওদেরকে বলো যে আমি তোমার টিচার। বাসায় পড়াবো।
লোরেনা আমাকে বলেছিল ওর এক্স হাজবেণ্ড, কি যে নাম, রড্রিগেজ ওর সাথে আর থাকে না। মাঝে মাঝে আসে বাচ্চা দুটিকে দেখতে।
-কেন তুমি রডরিগেসকে ছেড়ে দিলে?
-টিচার ও সারাদিন মদ পান করত। আর আমাকে মারতো।
-তুমি সহ্য করতে?
-করতাম। কিন্তু যেদিন দেখলাম ও আমার ভাইয়ের বউয়ের সাথে শুয়ে আছে তখন আর সহ্য করতে পারিনি।
-কী করলে?
-আমি পালিয়ে আমার এক বান্ধবীর বাসায় চলে গেলাম। বাচ্চা দুটিও গেল। তারপর উকিল ধরে ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিই। এখন আমি একা থাকি।
-একা থাকো কেন? তুমি এতো সুন্দর। অসুবিধা হবে তো তোমার।
-না তেমন না। ম্যানেজ করে চলি।
-আমাকে তোমার পছন্দ না? আমি মদ সিগারেট কিছুই খাই না। আমি খুব ভালো।

লোরেনা মুচকি হাসে। বেয়ারা খাবার নিয়ে আসে। আমার প্লেটে ভাজা একটা বারামুন্ডি মাছ। চোখটা কে খেয়ে ফলেছে! সারা শরীর পুড়ে কালো।
এদিকে শারমিন একটা নতুন চাকরি পায়। আগের চাকরিতে তার সুপারভাইজার বেশি খবরদারি করত। তাই মনে মনে আরো একটা চাকরি খুঁজছিল। সন্ধ্যায় বাসায় ডিনার করার সময় আমাকে বলে তুমি কি আমাকে আসার সময় কাজ থেকে পিক করতে পারবা?
-কয়টায়?
-পাঁচটার সময়? তোমার ওয়েই তো আমার অফিস
-আমার তো মাঝে মাঝে দেরি হয়ে যায়
-আমি না হয় অপেক্ষা করব
-আচ্ছা ঠিক আছে

রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে চিন্তা করলাম। শারমিনের সাথে আমি যে অসুখি তাতো না। আমাদের প্রায় ষোল সতের বছরের সংসার। শারমিনের খুব যত্ন করে সাজানো। দুটি সন্তানও আছে আমাদের। সংসার সামলানো রান্নাবান্না ঘর গোছানো থেকে শুরু করে আমার বিছানার গল্পও বেশ সাস্থ্যবান। কোনো সমস্যা নাই। আমার সব আবদারই সে সাড়া দেয়। দেখতে শুনতে খারাপ তাও না। বেশ লম্বা, গোলগাল ধরনের। হাঁটলে বেশ লাগে। শোয়ার সময় চুল থেকে ভুর ভুর করে গন্ধ আসে। লোরেনার সাথে তার তুলনা চলে না। দুইজন দুই আকার আর গঠনের মানুষ। কিন্তু এর মধ্যে মনে হল লোরেনা আমাকে টান টান করে ধরে আছে। কী কারণে? অনেক ভেবে দেখলাম সেই যে সে খুব একটা কথা বলে না। লুকিয়ে লুকিয়ে থাকে। অই জিনিসটাই মনে হয় এখন আমি বেশি ভালোবাসি। শারমিন কি সেটিকে হারিয়ে ফেলেছে? সতের বছরের জীবনে মানুষ কি আর চুপ থাকতে পারে? আর একটা বিষয়ও আমার ভেতর কাজ করে। যেদিন লোরেনাকে প্রথম দেখি সেই থেকেই আমার মনে পড়ে তাকে যেন কোথাও দেখেছি। সে কি আমার কিশোর বয়সের সেই সাফিনুর। যাকে প্রায় আমি পাগলের মতো ভালোবাসতাম। যে কিনা আমাকে ছেড়ে বাবু নামের এক দোকানদারের সাথে চলে যায়। আমার কেন জানি মনে হয় সেই সাফিনুর লোরেনা হয়ে ফিরে এসেছে। সেই রকমই বেশ স্নিগ্ধ মুখটা, ঝাঁকড়া চুল উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙ আর কথা বলে আস্তে আস্তে।

দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকে একটা এসএমএস পাই। ক্যান ইউ কাম দিস আফটারনুন? লোরেনার টেক্সট। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমি খুশিতে আটখানা। ওর সাথে একটি রাত থাকার স্বপ্ন আমার কয়েক যুগের! আমার আর সহ্য হয় না। টাইম পাস অন, টাইম ফ্লাই প্লিজ। গো এওয়ে। কুয়িক কুয়িক। ক্লাস শেষ হওয়ার সাথে সাথে শারমিনকে ফোন দিলাম। নো রিপ্লাই। পরে এসএমএস করলাম। আমার একটা ওয়ার্কশপ আছে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। ক্যাচ এ ট্রেন প্লিজ। তিনটা চারটা এমন করে গুনতে গুনতে লোরেনাদের ফেয়ার ফিল্ড-এ চলে যাই। ওদের বাড়ির সামনে গাড়িটা পার্ক না করে রাস্তার এক পাশে রেখে দিই। রাস্তার নাম লেমন ট্রি ক্রিসেণ্ট। নাকে লেবু পাতার গন্ধ। ৮৫/২ নম্বরের বাড়িটা বার করতে কোনো অসুবিধা হল না। গাড়িতে জিপিএস চালু ছিল। কিন্তু একটা জিনিস অবাক লাগল। লোরেনা তো বলিছল ওর বাড়িটা নতুন। কিন্তু কাছে এসে দেখি বেশ একটা পুরনো ইউনিট। দুতলা। লোরেনারা দুতলায় থাকে। ভাঙা দেয়াল। ময়লা সিঁড়িতে পোড়া সিগারেটের বাট, কোকের ক্যান, পচা কয়েকটা আপেল। অনেকক্ষণ দরোজা নক করলে লোরেনা সামনে আসল। একটা হাসিও দিল না। আমি বললাম সরি একটু দেরি হয়ে গেছে। লক্ষ্য করি ওর মুখটা কেমন যেন একটু কালো হয়ে আছে। বললাম কেমন আছো? কোনো জবাব নেই। হাতের ইশারায় বসতে বলল।

-তোমার বাচ্চারা কোথায়?
-ওরা ঘুমায়।
-এই সন্ধ্যায়? এতো আর্লি?
-ওরা একটু অসুস্থ্য।
-কী অসুখ।

লোরেনা কিছুক্ষণ চুপচাপ।
-এক কাপ গরম কফি হবে?
-কফি। আচ্ছা।

লোরেনা অন্য রুমে চলে যায়।
নাকে কেমন জানি একটা গন্ধ আসছে। পোড়া সিগারেটের? পঁচা আপেলের নাকি অনেক পুরনো বিয়ারের। সবগুলি একসাথে হয়ত। রুমের চারদিকে তাকাই। একটা জানালার কাচ ভাঙ্গা। পাশে একটা ফুলদানি। কোনো ফুল নাই অবশ্য। বিছানাটা এমনভাবে গোছানো যে মনে হয় কেউ এখানে শোয় না। ও তো ওর বাচ্চাদের কথা বলেছিল। কোনো ছবি তে দেখি না। বাচ্চাদের আওয়াজও পাই না। টিভির উপরে জিসাসের একটা ছবি। কিন্তু জিসাসের মুখটা এমন কেন। বেশ ক্রুদ্ধ! ক্রশে বিদ্ধ হওয়ার আগেও তো সে হাসিমুখে ছিল। সদাপ্রভুর সাথে তাড়াতাড়ি চলে যাবে তাই।

একটু পরেই লোরেনা রুমে ঢুকে। এর মধ্যে সে কাপড় বদল করে ফেলেছে। জিন্স আর টি সার্টের বদলে সে এখন একটা ঢিলেঢালা মেরুন রঙের মিডির মতো কিছু পরে আসছে। হাতে একটা জুসের বোতল। আমার কাছে এসে বসল। আমি ওর হাতটা ধরতে চাইলাম। সেই যে সিনেমায় দেখা বিচের সাদা কবুতর তেমন তার আঙুলগুলি। সে আমার কাছে ঘেঁষে বসল। আমি বললাম তোমার বাচ্চারা আসবে না?
-না ওরা ঘুমায়।
-বাসায় আর কেউ নেই
-না ইউ অ্যাণ্ড মি অনলি।

একসময় সে গ্লাসে একটু জুস ঢেলে দিল। আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। আমার ক্লাসে থাকার সময় তার যে চোখ আমি দেখতে পাই। সেটি আজ নেই। সেই রঙ সেই স্নিগ্ধতাও নেই মুখে। কেমন যেন ধারালো, খটখটে হয়ে আছে সব। আস্তে আস্তে ঠোঁটে একটা চুমু খেলাম। ওর মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলাম না। আমার গলা কেমন যেন শুকিয়ে আসছে। মনে হয় আমি নার্ভাস। আমার বিবাহিত জীবনে এরকম সময় আর আসেনি। শারমিন ছাড়া আমি অন্য কোনো মেয়েকে চুমু খাইনি। সত্যি বলছি। আমার হাত কাঁপছে। লোরেনা আরো কাছে চলে আসল একদম আমার বুকের কাছে। আমি তাকে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরলাম। সে পাখির মতো আমার শরীরের সাথে মিশে গেল। এতো হালকা এতো নরম তার শরীর। ভাবাও যায় না। কী আশ্চর্য এরকম আলিঙ্গনের জন্য আমি কয়েক যুগ অপেক্ষা করছি। সে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। আমাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বিছানায় যেতে চাইল। আমি বললাম না, এভাবে একটু থাকো। আই ওয়ান্ট টু হাগ ইউ লং। আমি আমার মুখটা ওর গালের সাথে ধরে ওকে হাগ করলাম। এক মিনিট দু মিনিট। আমি যখন এভাবেই দাঁড়ানো তখন ভাবলাম লোরেনার আগের যে স্বামী নাম তার রড্রিগেজ, সে এসে আমার পেছনে দাঁড়ালো। তখনো পুরোপুরি রাত হয়নি। একটু আগে আমি একটা গাড়ির শব্দ শুনতে পেরেছিলাম। মাথায় আঘাত পাওয়ার পর লোরেনা যে কিচেন থেকে ছুরিটা রড্রিগেজের হাতে তুলে দিয়েছিল তা আমার চোখের সামনে ভাসছে। ছুরিটা লোরেনার সেই সাদা স্কার্ফ দিয়ে মোড়ানো। রড্রিগেজ সাই করে স্কার্ফটা খুলে ছুরিটা আমার উপর ব্যবহার করল। আমার মাথা আর পিঠ থেকে কতোটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল আমার তা খেয়াল নেই। শুধু দেখলাম লোরেনা একটা পর্দার পেছনে সরে গেল। আর রড্রিগেজ আমার প্রায় নিথর দেহটাকে টেনে নিতে নিতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে ফেলে দিল। পড়তে পড়তে মেঝেতে রক্ত পরিষ্কারের শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু খুব মৃদু। ক্লাসে যেভাবে লোরেনার মুখ থেকে মৃদু ভাওয়েল সাউণ্ড বেরিয়ে আসত এরকম। আমার দেহটা গড়াতে গড়াতে সেই পঁচা আপেল সেই পোড়া সিগারেটের সাথে এসে জায়গা নিল। উপরে রাতের কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ। পাশে একটি আকাসিয়া গাছ। তার পীত কালো পাতা। ভোঁ ভোঁ করে ছুটে চলে গেল কয়েকটি গাড়ি হিউম হাইওয়ের দিকে।

বাংলাদেশ সময়: ১২:০৩:৪২   ৪৮৪ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ