বঙ্গ-নিউজঃ থানা-পুলিশ, আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ধরনা দেওয়া আর আদালত প্রাঙ্গণে ছুটতে ছুটতে বিমল শীল এখন ক্লান্ত, অসহায়। বিচার পেতে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি নানাজনের কাছে গেছেন। সবাই তাঁকে শুধু আশ্বাসই দিয়ে গেছেন। কিন্তু মা-বাবা, ভাইসহ পরিবারের সবাইকে হারানো এ মানুষটি ১৪ বছরেও বিচার পাননি। এ নিয়ে এখন আর তাঁর কোনো আফসোস নেই। কারণ, বিচারের আশাই ছেড়ে দিয়েছেন তিনি!
হঠাৎ বিমল শীলকে কারও চিনতে পারার কথা নয়। আজ থেকে ঠিক ১৪ বছর আগে ২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাধনপুর গ্রামের শীলপাড়ায় সংখ্যালঘু একটি পরিবারের ১১ জনকে ঘরে আটকে বাইরে থেকে তালা মেরে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাচক্রে সেদিন বাড়িতে না থাকায় ওই পরিবারের একজন সদস্য বেঁচে যান। বিমল শীল সেই একজন। তিনি বলেন, সারা দেশে আলোড়ন তোলা এত বড় ঘটনার বিচার মনে হয় হবে না।
এই মামলার তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র দিতেই নয় বছর লেগে যায় পুলিশের। এরপর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হলেও এক আসামি উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসায় দুই বছর বিচারকাজ বন্ধ ছিল। পরে আবার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। কিন্তু গত দেড় বছরে একজন সাক্ষীকেও আদালতে হাজির করতে পারেনি পুলিশ। এ পর্যন্ত ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১২ জনের সাক্ষ্য হয়েছে। সাক্ষীদের ১৭ জন পুলিশের সদস্য। তাঁদের একজনও সাক্ষ্য দেননি। মামলার এই বিবরণ তুলে ধরে বিমল শীল বলেন, ‘এরপর বিচারের আশা কীভাবে করি।’
সেই রাতে বাঁশখালীতে পুড়িয়ে মারা হয় বিমল শীলের বাবা তেজেন্দ্র লাল শীলকে (৭০)। একই ঘটনায় মারা যান বিমলের মা বকুল শীল (৬০), ভাই অনিল শীল (৪০), অনিলের স্ত্রী স্মৃতি শীল (৩২), অনিলের তিন সন্তান রুমি শীল (১২), সোনিয়া শীল (৭) ও চার দিন বয়সী কার্তিক শীল। বিমল শীলের চাচাতো বোন বাবুটি শীল (২৫), প্রসাদি শীল (১৭), এনি শীল (৭) এবং কক্সবাজার থেকে বেড়াতে আসা তাঁর খালু (মেসো) দেবেন্দ্র শীল (৭২)। পল্লি চিকিৎসক বিমল শীল সেদিন একটি কাজে চট্টগ্রাম শহরে ছিলেন।
এত বছরেও এই মামলার নিষ্পত্তি না হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, দেশে দায়মুক্তির সংস্কৃতি অব্যাহত থাকায় সংখ্যালঘুরা চরম নিরাপত্তা ও আস্থাহীনতায় ভুগছে। বিচার না পেয়ে একধরনের হতাশা থেকে তাদের দেশত্যাগের প্রবণতা বাড়ছে। অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেছে। তিনি আরও বলেন, দেশ সংখ্যালঘুশূন্য হয়ে পড়লে বহুত্ববাদী সমাজ থাকবে না। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র বিপন্ন হবে।
বাঁশখালীর ঘটনার বিচার না হওয়ার দায়ভার সরকার, রাষ্ট্রসহ রাজনীতিবিদেরা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না বলে মনে করেন রানা দাশ গুপ্ত। সর্বশেষ রংপুরে সংখ্যালঘুদের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেভাবে হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে, তাতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মতো সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা দরকার। এই আইনের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।
বীভৎস এই হত্যাকাণ্ডের জন্য মামলার বাদী বাঁশখালীর সাধনপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) তৎকালীন চেয়ারম্যান ও বিএনপির নেতা আমিনুর রহমানকে দায়ী করেন। তাঁর অভিযোগ, সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যে আমিনুর রহমানের নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। এখন উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন আমিনুর। তবে আমিনুর মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, রাজনীতি করার কারণে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে এই মামলায় জড়ানো হয়।
ঘটনার ২৫ মাস পর পুলিশের দেওয়া প্রথম অভিযোগপত্রে আমিনুরের নাম বাদ দেওয়া হয়। বাদী নারাজি দিলে আদালত পুনঃ তদন্তের নির্দেশ দেন। এর দুই বছর পর পুলিশ আবারও আমিনুরকে বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এবারও বাদী নারাজি দেন। সর্বশেষ চতুর্থ দফায় ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি আমিনুরসহ ৩৯ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এর মধ্যে এক আসামির নাম রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অন্য ৩৮ আসামির মধে৵ এখনো পলাতক রয়েছেন ২২ জন। জামিনে আছেন ১৬ জন। পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের আগ্রহ নেই বলে দাবি করেন বিমল শীল।
আদালত সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল এই মামলার সর্বশেষ সাক্ষ্য গ্রহণ হয়। এরপর প্রতি মাসে একবার করে ১৭টি ধার্য দিন থাকলেও একজন সাক্ষীও হাজির হননি। সর্বশেষ গত ৩০ অক্টোবর তৃতীয় অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ মুনসী আবদুল মজিদের আদালতে এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য ছিল। সাক্ষী হাজির না হওয়ায় আদালত আগামী বছরের ২২ জানুয়ারি পরবর্তী দিন ধার্য করেন। সেদিন পাঁচজন সাক্ষীর হাজিরার দিন ধার্য ছিল। তাঁরা হলেন বাঁশখালী উপজেলার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট খলিল আহামদ ও নুর মোহাম্মদ, বাঁশখালী থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) রেজাউল করিম ও কনস্টেবল আবদুল মান্নান এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক প্রদীপ কুমার চৌধুরী।
এই মামলার সাক্ষী বাঁশখালী থানার তৎকালীন এসআই রেজাউল করিম এখন চট্টগ্রাম নগর পুলিশের পরিদর্শক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেড় মাস আগে তাঁর গ্রামের বাড়ি পাবনার ঠিকানায় আদালত থেকে একটি সমন যায়। আগামী ধার্য দিনে তিনি আদালতে হাজির হবেন বলে জানান।
এই মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা এখন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) স্পেশাল ট্রেনিং সেন্টার, খাগড়াছড়িতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত। কেন সাক্ষ্য দিতে হাজির হচ্ছেন না, জানতে চাইলে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তিনি এখন পর্যন্ত কোনো সমন পাননি।
বাঁশখালীর এই মামলায় সাক্ষীরা যাতে হাজির হন, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইজিপি ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজিকে অনুরোধ করেছেন চট্টগ্রাম জেলা সরকারি কৌঁসুলি এ কে এম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, তারপরও সাক্ষীকে হাজির করা যাচ্ছে না। সাক্ষীকে হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা কোর্ট পরিদর্শক এ এইচ এম মশিউর রহমান বলেন, সাক্ষীদের অনেকের ঠিকানা পরিবর্তন হয়েছে। এ কারণে অনেককে পাওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ সময়: ৭:৪০:৪৫ ৬৬৪ বার পঠিত #bangaldesh news #bangla news #bangla newspaper #bd news #daily newspaper #world news.bongo-news.com