বঙ্গ-নিউজঃ(সাজ্জাদ কামাল) ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ১৩১তম জন্মবার্ষিকীতে সংগ্রামী এই ব্যক্তিকে নিয়ে স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করেছে বাংলা একাডেমি।
বৃহস্পতিবার বিকালে একাডেমিতে এই স্মাক বক্তৃতা দেবেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক নূহ-উল-আলম লেনিন।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি অ্যারোমা দত্ত বলেন, “১৯৭১ সালের পর এই প্রথম এই ধরনের কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
“আমরা কাউকে অনুরোধ করিনি। বাংলা একাডেমি নিজ উদ্যোগে করেছে। মনের ব্যথার মধ্যে একটা জোৎস্নার আলোর মতো পেলাম। এরফলে নতুন প্রজন্ম ধীরেন দত্তকে জানবে।”
বাংলা একাডেমি এই উদ্যোগকে ‘মাইলস্টোন’ অভিহিত করেন তিনি।
ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তানে গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই প্রথম মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদার দাবি তুলেছিলেন। একাত্তরে শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে যান তিনি।
তার স্মরণে কুমিল্লা শহরে তার বাসার সামনের রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে ‘ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সড়ক’, একটি স্টেডিয়াম আছে তার নামে কুমিল্লায়। আর কিছু নেই কোথাও।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের উত্তরে রামরাইল গ্রামে।
ছেলেবেলা থেকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকলেও রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি হয় ১৯০৫ সালের পর বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে।
শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরুর পর ১৯১১ সালে কুমিল্লা বারে যোগ দেন ধীরেন্দ্রনাথ। ১৯৩৬ সালে তিনি ত্রিপুরা জেলা বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে থাকায় কয়েকবার গ্রেপ্তার হন ধীরেন্দ্রনাথ। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করলেও তখনকার ত্রিপুরা জেলার বিভক্তির পর জন্মভূমিতেই থেকে যান।
১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের পক্ষে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ওই বছর ডিসেম্বরে পূর্ববঙ্গ থেকে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৫৬ সালে গঠিত আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খানের প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিসভায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ধীরেন্দ্রনাথকে গৃহবন্দি করা হয়। এর মধ্য দিয়ে তাকে সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা হয়।
১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে ছেলে দিলীপকুমার দত্তসহ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ময়নামতী সেনানিবাসে। সেখানেই তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
কুমিল্লা সেনানিবাসে ৮৫ বছরের এই বৃদ্ধের ওপর সেই নির্যাতনের কিছু নমুনা জানা যায় শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থে সাখাওয়াত আলী খানের এক সাক্ষাৎকার থেকে।
“ধীরেন বাবু সম্পর্কে বলতে গিয়ে রমণী শীলের চোখের জল বাঁধ মানেনি। মাফলারে চোখ মুছে তিনি বলেন, ‘আমার সে পাপের ক্ষমা নেই। বাবু স্কুলঘরের বারান্দায় অতি কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কোথায় প্রস্রাব করবেন। আমি আঙ্গুল দিয়ে ইশরায় তাকে প্রস্রাবের জায়গা দেখিয়ে দিই।’
“‘তখন তিনি অতি কষ্টে আস্তে আস্তে হাতে একটি পা ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠানে নামেন। তখন ওই বারান্দায় বসে আমি এক জল্লাদের দাড়ি কাটছিলাম। আমি বারবার বাবুর দিকে অসহায়ভাবে তাকাচ্ছিলাম বলে জল্লাদ উর্দুতে বলে- এটা একটা দেখার জিনিস না- নিজের কাজ কর।’
“‘এরপর বাবুর দিকে আর তাকাবার সাহস পাইনি। মনে মনে শুধু ভেবেছি বাবু জনগণের নেতা ছিলেন, আর আজ তার কপালে এই দুর্ভোগ। তার ক্ষতবিক্ষত সমস্ত দেহে তুলা লাগানো, মাথায় ব্যান্ডেজ, চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় উপর্যুপরি কয়েকদিন ব্রিগেড অফিসে আনতে নিতে দেখি।”
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের নাপিত রমণী শীল হিন্দু হলেও তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল পাকিস্তানি মিলিটারিদের প্রয়োজনে; কারণ তাদের মৃত্যু হলে পাকিস্তানি সৈন্যদের চুল-দাড়ি কাটার মত কোনো লোক থাকবে না।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন বাংলা ভাষাকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল, তখন তার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ব্যক্তি হিসাবে গণপরিষদের অধিবেশনের প্রথম দিনই প্রস্তাব করেন, উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা করা হোক।
সেদিন পূর্ব বাংলার কোনো মুসলমান গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথের এই প্রস্তাব সমর্থন করেননি, বরং সরাসরি বিরোধিতা করেছিলেন মুসলিম লীগের নেতারা।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবটি গণপরিষদে অগ্রাহ্য হয়। সাম্প্রদায়িক সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে গণপরিষদে বাংলা ভাষার অধিকারের প্রস্তাবটি নাকচ হয়।
তবে তার ওই পদক্ষেপই বাংলাভাষীদের দাঁড়িয়ে যাওয়ার প্রেরণা হিসেবে কাজ করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে।
লেখক কবীর চৌধুরী এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং ওই রকম আরও কিছু মানুষের অবস্থানের মধ্য দিয়েই যে সেদিন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ সূচিত হয়েছিল, আজ তা সর্বজন স্বীকৃত সত্য। সেই চেতনার বিকাশ ধারাতেই একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্মলাভ করেছে বাংলাদেশ।”
বাংলাদেশ সময়: ১৮:১৪:০০ ৮৮১ বার পঠিত #bangla news #bangla newspaper #bangladesh news #bd news #daily newspaper #World News