বঙ্গ-নিউজঃ উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত রোডের দু’ধারেই পাহাড়ে পিঠে এখন বসবাস করছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। কালো পলিথিনের সারি সারি ঝুপড়ি ঘর সবুজ পাহাড়ের পিঠে যেন কালো কলঙ্করেখা এঁকে দিয়েছে। এই ভার কেমন করে বইবে পাহাড়! যে জনপদ ছিল সবুজ পাহাড়ের মন মাতানো রূপের জন্য বিখ্যাত, তা নিমিষেই হয়ে গেল গাছপালাহীন।
খুব বেশি দিন নয়, মাস দেড়েক আগেও পর্যটন এলাকা কক্সবাজার-টেকনাফ রোডের দু’পাশে আঁকাবাঁকা গাঢ় সবুজ পাহাড় ছিল। অবাধে বন-গাছপালা কেটে ঝুপড়ি তুলে এখন এখানে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। যতই দিন যাচ্ছে, বাড়ছে ঝুপড়ি ঘরের সংখ্যা।
এভাবে পাহাড় কাটা ও বনাঞ্চল উজাড় হওয়ায় কক্সবাজার এলাকার ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। গত মঙ্গলবার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে জানানো হয়, এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের কারণে ১৫০ কোটি ৮৭ লাখ টাকার বনজ সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। পরিবেশের এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি।
কক্সবাজারের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, ‘টাকার অঙ্কে পাহাড় ও গাছপালার ক্ষতি নিরূপণ করা যায় না। মানবিক কারণে আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। তবে পাহাড়গুলো কেটে তারা যে হারে ঘর নির্মাণ করেছে, তাতে পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। টেকনাফ রোডের পাশের সবুজ পাহাড়গুলো ধ্বংস করতে না দিয়ে শুরু থেকেই ভেতরের অনেক ন্যাড়া পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যেতে পারতাম আমরা। এখন আবার বনের গাছপালা কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে তারা। এ অবস্থা চলতে থাকলে যে কোনো সময় বড় ধরনের পাহাড়ধসের আশঙ্কা রয়েছে।’
তিনি জানান, ‘বসতি গড়ার জন্য পাহাড়ের গাছপালা কাটার পর আমরা অনেক পাহাড় থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করেছি। একটু সতর্ক হলে শতবছরে গড়া পাহাড়গুলো এমন বিপন্ন হতো না।’
শুধু উখিয়া ও টেকনাফ নয়, সরেজমিনে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার গুনদুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তে গিয়েও রোহিঙ্গাদের ধ্বংস করে রেখে যাওয়া একটি পাহাড়ের দেখা মিলল। তুমব্রু থেকে উখিয়ার দিকে আসতে পশ্চিমকোল এলাকায় বাঁশবাগান নামে পাহাড়টির অবস্থান। ২০ একরের পাহাড়টিতে হাজারখানেক রোহিঙ্গা পরিবার বসত গড়েছিল। পরে ওই পরিবারগুলোকে সেখান থেকে উখিয়ার বালুখালীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
গুনদুমের তুমব্রু ২৭১ মৌজার হেডম্যান থাইন চাপ্রো বলেন, ‘পাহাড়টার দিকে তাকালে বুকে ব্যথা লাগে। একটা পাহাড় পূর্ণাঙ্গ পাহাড় হয়ে উঠতে বহু বছর লাগে। ধ্বংস করতে লাগে মাত্র কয়েক দিন। যদি আগে থেকে পরিকল্পনা করা থাকত, তাহলে পাহাড়টির এমন খারাপ অবস্থা হতো না। উখিয়া উপজেলার থাইংখালী পাহাড়ের গাছ কেটে ঝুপড়ি ঘর স্থাপন করেছিল। সেখান থেকেও রোহিঙ্গাদের বালুখালীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
তবে দখলমুক্ত পাহাড়গুলোর কোনোটাতেই এখন আর সবুজের চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। কেটে ফেলা হয়েছে বড় বড় গাছ। লতাপাতা-গুল্ম কিছুই আর নেই। মাটি কেটে ঘর বানানোর কারণে পাহাড়ের আকৃতিও বদলে গেছে। সবুজ বনাঞ্চল উজাড় হয়ে সেই পাহাড়গুলো এখন পরিণত হয়েছে বিরানভূমিতে। পাশাপাশি টেকনাফের মৌচনি, দমদমিয়া, জাদিমুরা, মিঠাপানিরছড়া, রাজারছড়া, রোজারঘোনা, রঙ্গিখালী, উলুচামারী, লেচুয়াপ্রাং, পানখালী, সিকদারপাড়া, মিনাবাজার, লম্বাঘোনা, আমতলী, নোয়াখালী, কচ্চপিয়া, বড়ডেইল, হলবনিয়া, শামলাপুর, নেচার পার্ক, বাহারছড়া ও মেরিন ড্রাইভ এলাকার জায়গাসহ প্রায় ১০ হাজার একর পাহাড় কেটে রোহিঙ্গারা ঝুপড়ি ঘর নির্মাণ করছে। পাহাড় কাটা এখনও থেমেনি।’
পাহাড় কেটে রোহিঙ্গাদের এই বসতি স্থাপন অদূর ভবিষ্যতে ওই এলাকায় মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন পরিবেশকর্মীরা। ভারি বর্ষণে পাহাড়ধস হলে প্রাণহানির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ ছাড়া কক্সাবাজার এলাকার সব বনভূমিই হাতির অভয়ারণ্য। নির্ধারিত কিছু রুট থাকে তা দিয়েই হাতি চলাচল করে। ওই রুটের বাইরে সাধারণত চলাচল করে না। রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেওয়ায় হাতির আবাসস্থলে প্রভাব পড়বে। শুক্রবার বন্যহাতির আক্রমণে তিন শিশু ও এক রোহিঙ্গা নারী নিহত হন।
টেকনাফের জাদিমুরা পাহাড়ে কথা হয় সেখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নারী আমিনা বেগমের সঙ্গে। তার বাড়ি মিয়ানমারের জামবুনিয়া গ্রামে। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের সেনারা চায় না রোহিঙ্গারা সে দেশে থাকুক। তাই আমাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। গুলি করে হত্যার পাশাপাশি লুট করা হচ্ছে ধনসম্পদ। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পরিবারের আট সদস্য নিয়ে রাতের আঁধারে নৌকা নিয়ে টেকনাফে প্রবেশ করি। এখানে এসে পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছি। পুরুষরা দিনের বেলায় ডেইলি কাজ করে, আর নারী ও শিশুরা পাহাড় থেকে গাছ কেটে জ্বালানি সংগ্রহ করে।’
উখিয়া-টেকনাফে ১৯৯১ সালে ৭৭ একর জায়গায় রোহিঙ্গাদের জন্য করা হয়েছিল সরকার নিবন্ধিত দুটি আশ্রয়কেন্দ্র। সেখানে লোকসংখ্যা ছিল ৩৮ হাজার। বর্তমানে ওই আশ্রয়কেন্দ্রের আশপাশসহ সেখানে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে।
জেলা বন বিভাগ সূত্র মতে, উখিয়া রেঞ্জে কুতুপালং, থাইংখালী, বালুখালী-১, বালুখালী-২, মধুরছড়া, তাজমিনার ঘোনা, নকরার বিল, সফিউল্লাহঘাটা, বাঘঘোনা ও জামতলীসহ আশপাশের পাহাড় কেটে প্রায় তিন হাজার একর জায়গায় রোহিঙ্গারা বসতি গড়ে তুলেছে। এ ছাড়া টেকনাফ রেঞ্জে ৪৫০ একর, হোয়াইক্যং (পুটিবুনিয়া) রেঞ্জের ৫০ একর এবং শিলখালী রেঞ্জের ৩৭৫ একর পাহাড়ি বন কেটে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে। মোট পাহাড়ি জমির পরিমাণ সাড়ে ৪ হাজার একর।
কক্সবাজার জেলা বন কর্মকর্তা মো. আলী কবির বলেন, ‘হঠাৎ করে পানির বানের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করবে কেউ টের পায়নি, তাই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে রোহিঙ্গারা যেখানে-সেখানে ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে বসবাস শুরু করেছে। তাদের জন্য কুতুপালং ক্যাম্পের পাশে তিন হাজার একর এলাকা নিয়ে ক্যাম্প করে সাময়িকভাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সবাইকে ধাপে ধাপে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে বনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে যা পূরণ করা অসম্ভব।’
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশ্রাব বলেন, ‘রোহিঙ্গারা পাহাড় ও গাছ কেটে যেভাবে ঘর নির্মাণ করেছে, তাতে পরিবেশের ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। যেসব পাহাড় কেটে ন্যাড়া করা হয়েছে, সেখানে যদি দ্রুত গাছপালা না লাগানো হয়, তাহলে বড় ধরনের পাহাড়ধস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া কী পরিমাণ পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে তা জানতে এখন জরিপ করা হচ্ছে।’
কক্সবাজার এলাকার পাহাড় ও বন নিয়ে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক ড. দানেশ মিয়া। তিনি বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পরিবেশ এবং বনভূমির কথা চিন্তা করলে রোহিঙ্গাদের জন্য বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সবাইকে রান্না করে খেতে হচ্ছে। এক লাখ চুলা যদি থাকে, সেই এক লাখ চুলার জন্য প্রতিদিন যদি ন্যূনতম পাঁচ কেজি জ্বালানি ধরি, তাহলে প্রতিদিন পাঁচ লাখ কেজি কাঠ পুড়ছে। এগুলো কোনো না কোনোভাবে আমাদের উখিয়া-টেকনাফের জঙ্গল থেকে যাচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে বনভূমির বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে।’
বাংলাদেশ সময়: ৭:০৩:০৭ ৭৮৫ বার পঠিত