‘ Hi, হাই এবং হাই’ (যেতে যেতে পথে…৬৪)-ড. মনিরুস সালেহীন

Home Page » ফিচার » ‘ Hi, হাই এবং হাই’ (যেতে যেতে পথে…৬৪)-ড. মনিরুস সালেহীন
শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর ২০১৭



প্রতিকী ছবি
আব্দুল হাই আমাদের খুব কাছের মানুষ, প্রিয়জন। ছোটবেলায় যখন আমরা পাড়া দাপিয়ে বেড়াতাম, বিকেলগুলোকে মুখরিত করে রাখতাম হাজারো রকমের খেলাধুলায় আর কলকাকলিতে (মতান্তরে চিৎকার চেঁচামেচি) আব্দুল হাই তখন আনমনে কোনো গাছের ছায়ায় বসে কাজ করে যেতো। আমাদের চেয়ে বয়সে কিছু বড় আব্দুল হাই সে সময় বানাতো বাঁশের টুকরি যাকে আমাদের এলাকার লোকজন বলতো খাঁচা। মাথার উপর পাহাড়সমান খাঁচার বোঝা নিয়ে যেত প্রতি সোমবারের সালটিয়া বাজারে।
বাশ থেকে প্রথমে চিরল চিরল ছিলকা, পরে নিপুণ হাতে মুহুর্তেই কিভাবে সেই ছিল্কা খাচায় রূপ নিতো- এটা দেখতে খুব ভালো লাগতো আমার। খাঁচা বোনার শিল্প দেখার পাশাপাশি আরেক আকর্ষন ছিল আব্দুল হাইয়ের গল্প। বিভিন্ন শ্লোক, ধাঁধা, ও মন্ত্রের সমৃদ্ধ ভান্ডার ছিল আব্দুল হাইয়ের কাছে। শরীর বন্ধন বা অদৃশ্য হওয়ার মন্ত্র ছাড়াও আরো কত মন্ত্র যে জানতো!আমাদের শেখাতে বললেই সে বলতো, এইতা তুমার মত ছুডুরার লাইগ্যা না। পরে সুনীলের কবিতায় যখন পড়েছি, বড় হও দাদা ঠাকুর, তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো, তখন আব্দুল হাইকেও আমার মনে হয়েছে এক নাদের আলী যে আমার শৈশবের লাগামছাড়া কল্পনাকে উস্কে দিতো।
এই আব্দুল হাই পরে কিভাবে জানি আমাদের প্রধান বর্গাচাষী এবং তারপরে বলতে গেলে বাড়ির ম্যানেজারই হয়ে উঠেছিল। তো, আমাদের বাড়ির ম্যানেজার হওয়ার পরেই তার সাধারণ ‘ হাই’ বা এর সাথে ছন্দ মেলানো ডিরেগটরি সম্বোধনকে আমিই উদ্ধার করেছিলাম। তাকে ডাকতে শুরু করি আব্দুল হাই বলে। ঘটনাক্রমে এ নামেই এখন সে পরিচিত।
আরেক হাইয়ের দেখা পেয়েছিলাম মেরিল্যান্ডের বেথেসডায়। হামফ্রে ফেলো হিসেবে আইএমএফ সদর দপ্তরে ইন্টার্নিশিপ করার সুযোগ পেয়েও তা হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছিল স্বল্প সময়ের জন্য ওয়াশিংটনে বাসা না পাওয়ার কারণে। সে সময় শ্রদ্ধেয় সিনিয়র সহকর্মী, ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর (পরবর্তীতে সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান) গোলাম হোসেন স্যারের বদান্যতায় তার বেথেসডার বাসায় মেহমান হয়েছিলাম লম্বা সময়ের জন্য। আবদুল হাই ছিল স্যারের গৃহ পরিচারক। হাইকে নিয়ে মজার ঘটনাটা তখনি শুনেছিলাম।
কোনো এক বিকেলে বাসার সামনের রাস্তায় পায়চারী করার সময় আব্দুল হাইকে কোনো এক বয়স্ক শ্বেতাংগিনী হাত তুলে ‘ Hi” সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন। দেশ থেকে সদ্য আমেরিকায় যাওয়া সেই হাই তখনো ‘হাই’ কেতা বুঝে উঠেনি। সে ভেবেছে ওই ভদ্রমহিলা তাকে ডেকেছেন, কিছু বলবেন। সে ভদ্রমহিলার পশ্চাদানুগমন করে। আরো কিছুক্ষণ যাওয়ার পর ওই মহিলা পেছন ফেরে আব্দুল হাইকে দেখে আবারো মুচকি হেসে, হাত নাড়িয়ে বলেন, হাই। এর পরের ঘটনা? সে এক বিরাট ইতিহাস! মহিলাকে অনুসরণ করতে যেয়ে শেষ পর্যন্ত পথ হারিয়ে ফেলে আমাদের আব্দুল হাই। তারপর পুলিশের সাহায্য, সেখান থেকে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং সবশেষে নিয়োগকর্তায় বাসায় প্রত্যাবর্তন।
স্যারের বাসার কিচেনে আনাড়ি হাতে সে তৈরি করতো এটা সেটা। টুকটাক কথা হতো তার সাথে। মৃদুভাষী আব্দুল হাইকে বেশ লাগত তার সহজ- সরলতার জন্য। কিন্তু পরে জেনে বিস্মিত হয়েছিলাম, এই আবদুল হাই-ই স্যারের বাসা ছেড়ে পালিয়েছে আমেরিকান ড্রিমকে নিজের হাতের মুঠোয় নেয়ার জন্য। এর জন্য স্যারকে যে কী পরিমাণ পেরেশানির শিকার হতে হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়।
আমি নিশ্চিত সেই হাই- ডাকে পথ হারানো আব্দুল হাই এখন আমেরিকান নাগরিক এবং তাকে দিনে অনেকবারই বলতে হয় ‘হাই! আর আমাদের গ্রামের আবদুল হাই এখন পক্ককেশ বৃদ্ধ । বাড়ি গেলে, পুকুর পাড়ের জলপাই তলায় বসি। আব্দুল হাই এসে বসে পাশের কোনো বেঞ্চে বা টুলে। গল্প করি তার সাথে।বুঝি অনেকগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে প্রায় বিপর্যস্ত। আমি কখনো জিজ্ঞেস করি আব্দুল হাইকে, তোমার মনে আছে আমাদের ছোটবেলায় তুমি আমাদের কত গল্প, শ্লোক (এক ধরণের ধাধা) বলতে, বলতে মন্ত্রের ছড়া?
সে যেন একটু লজ্জা পায়। বলে, থইনছে পুরান কতা। আপনের অতো পুরান কতাও মনো থাহে? আব্দুল হাই এখন আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করে।
কী জানি হয়তো একটু আনমনাই হয়ে উঠে আব্দুল হাই। পুকুর- ছোয়া বাতাসে থির থির করে কাপে আব্দুল হাইয়ের কাশফুলের মতো সাদা চুল। Hi-স্বপ্ন নিশ্চয় তার ছিলো না। সাধারণ জীবন যাপনের যে স্বপ্ন সবার থাকে, তাও কি পূরণ হয়েছে আব্দুল হাইয়ের? আমি ঠিক বুঝি না। অন্তত তার চোখমুখ দেখে ঠিক আচ করা যায় না। কারণ আবদুল হাইয়ের চোখমুখে আমি নিরাশার আধার দেখি না। লক্ষ করি এখনো বয়সে ছোটদের সাথেও ওর সম্পর্ক আগের মতোই খুনসুটির।
Hi এর সাথে এতোটুকু পরিচয় নেই আমাদের এই হাইয়ের। তার সব ছেলের কাছে মোবাইল ফোন থাকলেও তার কাছে নেই। Hi কে যদি কোনো রূপক হিসেবে চিন্তা করি, তবে বলতেই হবে সেই Hi এর সন্ধান পায়নি সে যেমনটা পেয়েছে মেরিল্যান্ডের আব্দুল হাই, আমেরিকান ড্রিমকে হাতের মুঠোয় পেয়ে।
জলপাই গাছের ছায়ায়, ক্লান্ত অপরাহ্নে, নিস্তরংগ পুকুরটাকে সামনে নিয়ে আব্দুল হাইয়ের সাথে গল্প করতে করতে ভাবি, এই যে এতোসব অভাব, অভি্যোগ নিয়েও আব্দুল হাইয়েরা, হাইয়ের মত মানুষেরা হাসতে পারে - এটাও এক মন্ত্র যা কখনো শেখা হবে না আমাদের মত হাজার স্বপ্নের পেছনে ছোটা মানুষের।

ড. মনিরুস সালেহীন

বাংলাদেশ সময়: ২৩:৫৬:৫২   ১১৭৭ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

ফিচার’র আরও খবর


অ্যানেন্সেফ্লাই কী? - রুমা আক্তার
শেখ হাসিনা বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নের অগ্রদূত : স্পিকার ; ১০০০ নারী উদ্যোক্তা’র মধ্যে ৫ কোটি টাকার অনুদান প্রদান
“ম্রো’ আদিবাসীর গো হত্যা’ অনুষ্ঠাণ ” - তানিয়া শারমিন
আলোকিত স্বপ্ন নিয়ে তৃতীয় বর্ষে রবিকর ফাউন্ডেশন
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন রক্ষায় প্রয়োজন জেন্ডার সংবেদনশীল নীতির পর্যালোচনা
জিনগত ত্রুটির অপর নাম “ডাউন সিনড্রোম”- রুমা আক্তার
মোহাম্মদ শাহ আলমের জীবন ও কর্ম
ইসফাহান নেসফে জাহান
সিলেটে গ্রুপ ফেডারেশনের কর্মশালায় বির্তকিত মুরাদ- আয়োজকদের দুঃখ প্রকাশ
ডলারের দাম যেভাবে বাড়ছে, টাকার দাম কেন কমছে

আর্কাইভ