বঙ্গ-নিউজঃ চলতি বছর নানা কারণে ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এখনপর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের কিছুটা বেশি উৎপাদিত হলেও বাকি সময়ের মধ্যে উৎপাদন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছানো যাবে না। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, আগামী ২২ অক্টোবর পর্যন্ত মা ইলিশকে সাচ্ছন্দ্যে ডিম ছাড়ার সুযোগ দেওয়ার দেশের সব নদনদীতে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। একইসঙ্গে এ সময়ের মধ্যে ইলিশ বাজারজাত, মজুদ, বেচাবিক্রি সবই নিষিদ্ধ রয়েছে। এরপর আবার ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দুই মাস জাটকা সংরক্ষণের জন্য নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকবে। কাজেই কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার ইলিশ এ বছর ধরা পড়বে না বলে মনে করেন জেলে ও ব্যবসায়ীরা। মৎস্য অধিদফতর সূত্র বলছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট ৪ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। এবছর এর উৎপাদন ৫ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
বরিশাল, পাথরঘাটা, ভোলা, চাঁদপুর, কক্সবাজার ও শরীয়তপুরের জেলেরা জানিয়েছেন, এ বছর এখনও দেশের নদীতে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ইলিশের দেখা মেলেনি। বাজারে যা উঠেছে, তার ৯০ শতাংশই সাগরের ইলিশ। সাগর মোহনায় আরও ইলিশ আছে। এ সব এলাকার জেলেরা জানিয়েছেন, এ বছর সাগর মোহনায় মিলছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। আর সেই ইলিশেই সয়লাব হয়েছে বাজার। তাদের আনুমানিক হিসাব হচ্ছে—এবছর এখনপর্যন্ত আনুমানিক ২ থেকে আড়াই লাখ ইলিশ ধরা পড়েছে।
বিভিন্ন জেলার জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব, নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও নদীর বুকে জেগে ওঠা নতুন চরের কারণে নদীতে প্রয়োজনীয় স্রোত নেই। তাই সাগর থেকে ঝাঁক বেঁধে ইলিশ নদীর মোহনায় আসতে পারছে না। উপকূলীয় নদ-নদীতে এ বছর আর আগের মতো ইলিশ ধরা পড়েনি। উত্তাল মেঘনা-তেঁতুলিয়া পাড়ি দিয়েও ইলিশ মাছের দেখা পাননি জেলেরা।
জেলেরা জানান, গভীর সাগরে এখনও প্রচুর ইলিশ রয়েছে। এ সব ইলিশই মাঝ নদীতে এসে ডিম ছাড়বে। ইলিশের স্বর্গরাজ্য বলে খ্যাত ভোলার তেতুলিয়া, পটুয়াখালীর পায়রা, পিরোজপুরের বলেশ্বর ও সন্ধ্যা এবং চাদপুরের মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় এ বছর ইলিশ মাছ ধরা পড়েনি। তবে সাগরে প্রচুর ধরা পড়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের দেওয়া তথ্য মতে, ২০০২-০৩ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত ইলিশের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। ২০০৮-০৯ অর্থবছর দেশে ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল—২ লাখ ৯৮ হাজার মেট্রিক টনে। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে দেশে এর পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছর তা ৪ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরও দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৪ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন।
আশা করা হচ্ছে, ২০১৭ সালের শেষে দিকে ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৫ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। মা ইলিশ সুরক্ষা ও ডিম ছাড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করায় এ সফলতা এসেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ইলিশ উৎপাদনের সফলতা ধরে রাখার জন্য ইলিশ অধ্যুষিত দেশের ১৫টি জেলায় ২ লাখ ২৪ হাজার ১০২টি জেলে পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে সরকার।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিশ্বের মোট ইলিশের ৬০ ভাগ ইলিশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। আর বাংলাদেশের নদ নদীতে পাওয়া মাছের ১২ শতাংশই ইলিশ। বাংলাদেশের জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) এর অবদান এক শতাংশ। এক মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষায় নদীর পরিবেশ, জাটকা সংরক্ষণ ও অভয়াশ্রম নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশে বছরে ইলিশের বাণিজ্য হতো কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে জাটকা সংরক্ষণের সুযোগ দিয়ে ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই দুই মাসও নদীতে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। এ সময়ে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় নিবন্ধিত জেলেদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়। একজন জেলেকে মাসে দেওয়া হয় ৪০ কেজি চাল। দেশের ১৬টি জেলার প্রায় ২ লাখ ২৪ হাজার ১০২টি জেলে পরিবার এ খাদ্য সহায়তা পায় বলে জানায় মৎস্যসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র। এ ছাড়া এই দুই মাস জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করা হয়।
জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘গত বছর আশ্বিন মাসের প্রথম চাঁদের পূর্ণিমার দিন এবং এর আগের তিন দিন ও পরের এগারো দিনসহ মোট ১৫ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ ছিল। আর এ বছর আশ্বিন মাসের প্রথম চাঁদের পূর্ণিমার দিন এবং এর আগে চার দিন ও পরের সতের দিনসহ মোট ২২ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ রয়েছে। ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময় পার হওয়ার পরও মা ইলিশ সমুদ্রে ফিরে যাওয়ার পথে ধরা পড়ে। এ জন্যই এ বছর সময় ৭দিন বাড়িয়ে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ সময়ে ইলিশ ধরা ঠেকাতে অভিযান চালানো হবে। সরকারের নির্দেশ অমান্য করলে শাস্তি অবধারিত বলে হুঁশিয়ার করেন তিনি। এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ইলিশ ধরা না পড়লেও সময় শেষ হয়ে যায়নি। অবশ্যই নদীতে ইলিশ আছে। জেলেদের জালেও ধরা পড়বে। আমরা লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ইলিশ পাব।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী আকবর বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, ‘সরকারের জাটকা নিধন কার্যক্রম, মা-ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রম, ইলিশের অভয়াশ্রম চিহ্নিতকরণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানসহ সময়োপযোগী কর্মসূচি ইলিশের সংখ্যা বাড়াতে বড় ভূমিকা রেখেছে। মা ইলিশ রক্ষায় ২০১১ সালে যেখানে এক হাজার ৪৪০টি অভিযান চালানো হয়েছিল, সেখানে ২০১৫ সালে চালানো হয় ৫ হাজার ২০৯টি অভিযান। যা এ বছরও অব্যাহত রয়েছে। এ কারণেই গত কয়েকবছর ধরে ভালো সাইজের ইলিশ পেয়েছে দেশের মানুষ।’
এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আলী আকবর বলেন, ‘এ বছরের বিষয়টি অবশ্য ভিন্ন। এখনপর্যন্ত দেশের নদনদীতে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ইলিশের দেখা পাননি জেলেরো। তবে সাগরে ইলিশ ধরা পড়েছে প্রচুর। ২২ অক্টোবরের পরেও সাগরে ইলিশ ধরা পড়বে। আশা করছি, তখন নদীতেও ধরা পড়বে।’
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৪১:৫৯ ৫৪১ বার পঠিত