শ্রীকান্ত উপন্যাসে ছিদাম বহুরূপীর জন্য এখনো মায়া হয়। বেচারা। বাঘ সেজে মানুষের মনোরঞ্জন করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে খড়ম পেটা হতে হয়েছিল মিছে-বাঘ -দেখে- ভয়- পাওয়া মেসো মশায়ের হাতে।
সঙ সেজে ঢঙ দেখিয়ে বা বহুরূপী সেজে যারা দু’ পয়সা উপার্জন করতো, তারা আমাদের গাও গেরাম থেকে বিগত হয়েছেন আমাদের চোখ ফোটার আগেই।
কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন পর্যটন স্পটে বেশ দেখা মেলে এমন বহুরূপীদের।
গত বছর রোমের প্যানথিয়ন চত্বরে দেখলাম গেরুয়া পোষাক পরে সাধুর ভাব ধরে, মানে মালা জপার ভঙ্গি করে, শূন্যে বসে আছেন একজন ! সাধু হও, সাধু সেজো না- এ ধরণের আপ্তবাক্য যতই বলি না কেন, সাজা সাধুদের কদর কিন্তু কমবেশি সব খানেই আছে (বাবা রাম রহিমের কথা মনিয়ে করিয়ে দিলাম কি?) দেখলাম অনেকেই সেই শূন্যে ভাসা সাধুর সঙ্গে সেল্ফি বা ছবি তোলায় আগ্রহী। আর নজরানা হিসেবেও সেই সুবাদে মাঝমধ্যেই তার ‘ কাঠের বাক্সে’ পড়ছে ইউরোর কয়েন। আমরা কয়েকজন কলিগ দূর থেকে নিজেদের মধ্যে বাঙলায় বলাবলি করি, সাধু সাহেব নিশ্চিত বাঙালী। হঠাৎ করে খেয়াল করি সাধু সাজা ভদ্রলোক আমাদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপেন। বুঝি, তিনি তাকে নিয়ে আমাদের উচ্চকিত গবেষণাটা ঠিক পছন্দ করছেন না।
ইতালীর গ্রীষ্মের প্রচন্ড রোদে সাধু- সাজা দেশী ভাইয়ের জন্য আমার খারাপই লাগে- ঘামে চিকচিক করছে তার মুখ, কপালের খড়িমাটির প্রলেপ লেপ্টে যাচ্ছে, সাধুসুলভ নির্বিকারে তিনি তসবিহ জপেন আর অপেক্ষায় থাকেন কে তার সংগে একটা ছবি তুলবেন আর ছুঁড়ে দেবেন একটা কয়েন!
মিলান ক্যাথিড্রাল বা ডোমো চত্বরে দেখলাম পয়সা উপার্জনের নতুন কৌশল যা আগে কখনো দেখিনি। টেপ রেকর্ডারে বাজা মিউজিকের সাথে এক যুগলের নৃত্য। প্রথমে বুঝতে পারিনি, পরে ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম ভদ্রলোকের নৃত্যসংগী একটি লাইফ লাইজের পুতুল! পুতুল নাচের নতুন ভার্শন।
রাস্তার পাশে বা কোনো মলের খোলা চত্বরে দাঁড়িয়ে এক্রোবেটিক বা বিভিন্ন শারিরীক কসরত দেখানো অনেক দৃশ্য দেখেছি ব্যাংককে, এডিলেইডে ও নিউইয়র্ক এ। মনে পড়ে, নিউইয়র্কের স্ট্যাচু অব লিবার্টিতে যাওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ানো মানুষদের ৫/৭ মিনিটের এক দারুণ এক্রোব্যাটিক শো দেখিয়ে মুগ্ধ করেছিল তিন তরুণ কৃষ্ণাঙ্গের এক দল। এবার একই জিনিশ দেখলাম দেখলাম আমস্টারডামের ড্যাম স্কোয়ারে।
রাস্তায় সঙ সাজা বা শারিরীক কসরত দেখানোর চল আমাদের দেশে খুব একটা দেখিনি, কিন্তু সাপের খেলা, বানরের খেলা কিংবা যাদু দেখিয়ে পয়সা উপার্জনের চল তো আমাদের দেশে চালু আছে কোন সুদূর অতীত থেকে। কিশোর বেলা অবধি খুব ভালো লাগতো ট্রেনে, গ্রামের বাজারে বা রাস্তার ধারে ক্যানভাসারদের ক্যানভাস শুনতে। কী সুন্দর করেই না নিজেদের পণ্যসেবার মহত্ব প্রকাশিত হতো সেই ক্যানভাসিং এ। মনে পড়লে এখনো নিজের মনে হাসি- টিয়ে পাখির ভাগ্য গণনায় সেই কিশোর বয়সেই জেনেছিলাম আমার বউ হবে বেশ সুন্দর। আর সেই গোপন খবর সরলমনে বড় ভাবীকে জানানোর পর কী হেনস্থার শিকারই না হতে হয়েছিল আমাকে।
বিশ্বায়নের এ যুগে জীবন ও জীবিকার জন্য মানুষ ছুটে চলছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। বাংলাদেশের মানুষও যে কী পরিমাণ বহির্মুখী হয়েছে তার প্রমাণ মেলে প্রবাস আয়ের ওপর আমাদের অর্থনীতি কী পরিমাণ নির্ভরশীল তা একটু বিবেচনা করলেই। ইউরোপ, আমেরিকায় বা মধ্যপ্রাচ্যে গেলে প্রবলভাবে অনুভব করা যায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের দুর্দান্ত উপস্থিতি। বারো রকম মানুষ দেখার ও তাদের বোঝার যে বাতিক আমার আছে সে তাড়না থেকেই মেশার, কথা বলার চেষ্ট করি প্রবাসে দেখা- মেলা বাংলাদেশীদের সাথে।
সেভাবেই গল্পে মেতেছিলাম আশিকের সাথে। খুব ভালো লেগেছিল ওর কিছু কথা। প্রথমেই যা বলেছিল সে কথাটা শুনতে বেশ। একবার শুনলেই মনে গেঁথে যায়। মনে হলো এ কথাগুলো সে আগেও কাউকে বলেছে। তবে মনভোলানো কথা নয়, কথাগুলো উঠে আসে তার গভীর আত্মপ্রত্যয় থেকে। রোম সিটি সেন্টার থেকে রোম ফুমিচিনো দ্য ভিঞ্চি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এ আসার পথে গাড়িতে বসে বলেছিল আশিক- “এখানে আমাদের জীবনে প্রতিদিনই নতুন করে সূর্য উঠে, প্রতিদিনই একটা নতুন জীবন শুরু।“ নতুন সূর্য উঠার সাথে জীবনের নবীকরণের যে সম্পর্ক বোঝায় খুব সম্ভবত ওই অর্থে কথাটা বলেনি আশিক। বলেছিল প্রবাসজীবনে খেটে মানুষ প্রতিদিন জীবন যাপনের জন্য উদয়াস্ত যে সংগ্রাম করে তা বোঝাতে।
আশিক নিজের গাড়ি চালায়। আট সিটের মাইক্রোবাস নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। বাণিজ্যিকভাবে প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করা আইনসিদ্ধ না হলেও সে এটা করে মূলত এশীয় টুরিস্টদের নিয়ে যাদেরকে সে প্রয়োজনে নিজের অতিথি হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে।
গ্রীস্মকালের রোমের কাঠফাটা রোদ্দুরে পুড়ে কিংবা বৃষ্টিতে ভিজে বিভিন্ন টুরিস্ট স্পটে ছাতা, পানি, বিভিন্ন স্যুভেনির, ট্যুর টিকেট বা বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রের স্কিপ- দ্য- লাইনের টিকেট ফেরি করা হাজার হাজার বাংলাদেশীর চেয়ে অনেক অনেক ভালো আছে আশিক। ভালো যে আছে তা বোঝা যায় ওর চোখেমুখে উদ্ভাসিত প্রত্যয়টুকু চোখে পড়লেই। সেই প্রত্যয়টুকু আরো বিকশিত হয় ওর পরের কথায়- “আমি কতোটুকু কী করতে পারি বা আমার ভেতর কতোটুকু সামর্থ্য আছে তা কখনো বুঝতে পারতাম না এখানে না এলে।“ খুব ভালো লাগে ওর কথা শুনে। আমি মনে মনে ওকে শ্রদ্ধা করি।
তেমনি ভালো লাগে গিয়াস নামের আরেক বাংলাদেশীকে যার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল রোমের সিটি সেন্টার থেকে একটু দূরের পোর্টা দ্য রোম নামের বিশাল শপিং মলে যাওয়ার পথে, বাসে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে স্টুডেন্ট ভিসায় সে প্রথমে পাড়ি জমিয়েছিল সুইডেনে। তারপর সেখান থেকে ইউরোপের এখানে ওখানে ঘুরে স্থিতু হয়েছে ইতালির রোমে। এখন সে রোমে একটি ইতালিয়ান রেস্তোরার হেড শেফ। কথা প্রসংগে জানলাম, ওই রেস্তোরায় তার অধীনে কাজ করে তিন ইতালীয়। বাসে ক্ষণিকের আলাপচারিতায় জানা গেল, গন্তব্য যাওয়ার জন্য আমরা যে বাস স্টপে নামব, একই বাস স্টপে নামবে গিয়াসও। বাস স্টপে নেমেই গিয়াসের আমন্ত্রণ , ভাই, একটু যদি ক্যাফে খেয়ে যেতেন? মামুলী ভদ্রতা ভেবে আমি ধন্যবাদ জানিয়ে না করি। কিন্তু গিয়াস নাছোড়বান্দা । বলে, ভাই, আমি খুব খুশি হবো যদি আপনারা আমার সাথে একটু ক্যাফে খান। ওর বলার ধরণে যে আন্তরিকতা উচ্চকিত ছিল, এরপর আর না করতে পারিনি।
বিদেশে খুব ভালো অবস্থানে আছেন, ব্যবসা বা হোয়াইট কলার জব করে বছরে ছয়-অংকের ডলার /পাউন্ড উপার্জন করছেন এমন বাংলাদেশী আছেন হাজার হাজার । কিন্তু স্বদেশ স্বজন ছেড়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জীবিকার অন্বেষণ করছেন বিদেশ বিভূঁইয়ে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি।এঁদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় সচল আছে দেশের অর্থনীতির চাকা। দেশী ভাইবেরাদর পেলে তাঁরা যে আন্তরিকতা দেখান তা সত্যিই অভিভূত করে আমাকে। তাদের ঘর্মাক্ত মুখ নয়, আমার চোখে ভাসে দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসায় সিক্ত তাদের অকৃত্রিম অভিব্যক্তিটুকু।
বাংলাদেশ সময়: ২:০২:৪৪ ১৫৫০ বার পঠিত #bangla news #bangla newspaper #bangladesh news #bd news #daily newspaper #World News