বঙ্গ-নিউজঃ পদ্মা সেতু বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারভুক্ত প্রকল্প। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার আগে ‘দিন বদলের সনদ’ নামে আওয়ামী লীগে পক্ষ থেকে যে নির্বাচনি ইশতেহার দেওয়া হয় সেখানে প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণের। ক্ষমতায় এসে সেই অনুযায়ী কাজও শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু এরই মধ্যে শুরু হয় দুর্নীতির কথিত অভিযোগসহ বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধকতা। বাংলাদেশের দীর্ঘতম এ সেতু নির্মাণে বিদেশি অর্থায়ন নিয়ে চলে নানা জটিলতা। সরকার সব বাধা বিপত্তি পেরিয়ে নিজস্ব অর্থায়নেই শুরু করে এই সেতুর নির্মাণযজ্ঞ। গতকাল শনিবার পদ্মা সেতুর জাজিরা অংশে একটি স্প্যান স্থাপনের মধ্য দিয়ে পিলারের পর এখন এ সেতুর পাটাতনও দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। সরকার আশা করছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এই সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া সম্ভব হবে।
পদ্মা সেতু নির্মাণে পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে সরকারের তরফ থেকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকে দায়ী করা হয়। এক্ষেত্রে সব থেকে বেশি দোষারোপ করা হয়েছে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংককে। এছাড়া দেশীয় একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল বলে সরকারি দল থেকে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ এসেছে। বিশেষ করে শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসকে এ জন্য দায়ী করা হয়। আওয়ামী লীগের অভিযোগ ছিল, অবৈধভাবে গ্রামীণ ব্যাংক প্রধানের পদে থাকতে না পেরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছেন।
জানা যায়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন। সেই অনুযায়ী ১৯৯৮ থেকে ২০০০ এই সময়ে পূর্ব সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়। এরপর ২০০১ সালে জাপানিদের সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই এর কাজ হয়। স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া পয়েন্টে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনও করেছিলেন শেখ হাসিনা। ২০০৪ সালে জুলাই মাসে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সুপারিশ মেনে মাওয়া-জাজিরার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার শপথ নিয়েই নতুন করে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ হাতে নেয়। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে আগ্রহ দেখায় বিশ্বব্যাংক। সেই সঙ্গে সহযোগী হতে চায় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিপি), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ও জাইকা। ২৯০ কোটি ডলার ব্যয়ে বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করে সরকার। এরপর ওই বছরের ১৮ মে জাইকা (৪০ কোটি ডলার), ২৪ মে আইডিবি (১৪ কোটি ডলার) এবং ৬ জুন এডিবি’র (৬২ কোটি ডলার) সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হয়।
এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় বিপত্তি। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে আসে দুর্নীতির অভিযোগ। ঋণচুক্তির পাঁচ মাসের মাথায় দুর্নীতির অভিযোগ এনে ওই বছর (২০১১) সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করে। তত্কালীন যোগাযোগ মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম আসে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার বিষয়ে। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের ওপরও। বিশ্বব্যাংকের পথ অনুসরণ করে অন্য দাতা সংস্থাগুলোও। ঋণচুক্তি স্থগিতের সময় ঋণ পুনর্বিবেচনার জন্য দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ চারটি শর্ত জুড়ে দেয় বিশ্বব্যাংক। এ সময় দু্ই দফায় বিশ্বব্যাংক ‘দুর্নীতি’র কিছু তথ্য-প্রমাণও বাংলাদেশকে দেয়। সরকারের তরফ থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে নানা দেন-দরবার চলতে থাকে। চুক্তি বাতিল এড়াতে এসময় যোগাযোগ সচিবকে সরিয়ে দেওয়াসহ কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপও নেয় সরকার। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সন্তোষজনক ব্যবস্থা ছিল না সেগুলো। ফলে ২০১২ সালের ২৯ জুলাই আনুষ্ঠানিক ভাবে ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয় আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি।
এসময় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশি ও প্রবাসীদের পদ্মা সেতু নির্মাণে সহযোগিতায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেকে এগিয়েও আসেন। শুরু হয় অর্থ সংগ্রহ। পরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে পদ্মা সেতুর অর্থ সংগ্রহে প্রতিটি তফসিলি ব্যাংকে দুটি করে ব্যাংক হিসাব খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিশ্বব্যাংকের দেওয়া শর্ত অনুসারে এরইমধ্যে পদ্মা সেতুতে পরামর্শক নিয়োগের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। ওই সময় বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল একাধিকবার ঢাকায় এসে দুদকের সঙ্গে বৈঠক করে। এসব বৈঠকে নতুন নতুন শর্ত আসতে থাকে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দেন-দরবারের পাশাপাশি সরকার বিকল্প অর্থায়নের প্রচেষ্টা শুরু করে। নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের উদ্যোগের কথাও এ সময় জোরেশোরে আলোচনা হতে থাকে। বিশ্বব্যাংকের টালবাহানায় ক্ষুব্ধ হয়ে ২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি সংস্থাটিকে এক সপ্তাহের সময় দিয়ে আল্টিমেটাম দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ওই মাসের মধ্যে বিশ্বব্যাংক তাদের অবস্থান স্পষ্ট না করলে সরকার তাদের কাছ থেকে কোনো ঋণ নেবে না। তারা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে। পরে ৩১ জানুয়ারি সরকার পদ্মা সেতুর জন্য অর্থায়নের অনুরোধ প্রত্যাহার করে বিশ্বব্যাংককে চিঠি দেয়। বিশ্বব্যাংকের কাছে অর্থায়নের অনুরোধ প্রত্যাহারের আগে-পরে মালয়েশিয়া, চীনসহ কয়েকটি দেশ অর্থায়নে আগ্রহ দেখায়। তবে সেগুলো দেশের জন্য সাশ্রয়ী না হওয়ায় সরকার সেদিকে না গিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের কাজ হাতে নেয়। পরবর্তী অর্থবছরের (২০১৩-১৪) বাজেটে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য ছয় হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্য দিয়ে সেতু নির্মাণের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে। ২০১৪ সালের ১৮ জুন মূল সেতু নির্মাণে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই করে সরকার। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও কানাডার আদালতে তার কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি বিশ্বব্যাংক। গত ১০ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে কানাডার আদালত জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিল করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ৩:০৭:০৩ ৫৫১ বার পঠিত #bangla news #bangla newspaper #bangladesh news #bd news #daily newspaper #World News