ক্যাডেট জীবন সম্পর্কে বাহিরের মানুষের ধারণা খুব ক্ষীণ। আমার ধারণা- ক্যাডেটদের বাবা-মাও ততোটা জানেন না যতটা তাদের পোহাতে হয়। এই না জানাটা সঙ্গত, কারণ কিছু সিক্রেট ব্যাপার ঐ চারদেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর ক্যাডেটরাও ঐ দেয়ালের মধ্যে অসহ্যকে সহ্য করতে করতে নিজের সহপাঠীদের শেষ আশ্রয় মনে করে তাদের সঙ্গে শেয়ার করে সকল সমস্যা সমাধান না হোক, লাঘবের চেষ্টা করে। বাইরে সব কিছু শেয়ার করে না। এজন্য আমাদের কিছু টিপিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ আছে যা শুধু আমরাই বুঝি, অন্যরা বোঝেনা। আর ওসব এমন সাইফার ম্যাসেজের মত যা কয়েক শব্দেই পূর্ণাঙ্গ ভাব প্রকাশ করে…
এই প্রক্রিয়ার সাথে শুধু সহপাঠী ক্যাডেটরাই নয়, কিছু বন্ধুসুলভ শিক্ষক, কলেজের স্টাফ, এমনকি কলেজের কিছু বাইরের মানুষও কখনো সখনো জড়িত থাকে
গল্পটি বড় ভাইদের কাছে থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে শোনা তেমনই একটা গল্প….(শিক্ষকদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে শুধু গল্পের খাতিরে বলা)
ক্লাস টুয়েলভ (ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার) কলেজের মোস্ট সিনিয়র ব্যাচ। তারা শিক্ষকদের অনেক কাছাকাছি।
সকালে পিটি-প্যারেড, দুপুর পর্যন্ত একাডেমিতে ক্লাস, বিকালে খেলাধূলা-দৌড়ঝাঁপ, সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর সন্ধ্যারাতের শুরু থেকে একাডেমিতে ৪ জন শিক্ষকের তত্বাবধানে সেল্প-স্টাডি/প্রেপ ক্লাস, অথাৎ খাঁটি বাংলায় যাকে বলে-
নিজে নিজে লেখাপড়া
যদি না করো পড়া তবে খুবই ভাল কথা
শুধু যদি না খাও ধরা-
সবাই কি আর এক রকম? কিছু দুষ্টু না থাকলে কী আর চলে!
আবার ক্যাডেটরা যেমন সবাই এক না, শিক্ষকরাও তেমন সবাই একরকম নয়। সারওয়ার স্যার (ছদ্মনাম-১) খুব সহজ সরল, মিশুক, একটু খর্বাকৃতির। গণিতের শিক্ষক, ক্যাডেটদের প্রিয় মানুষ। ক্যাডেটরা একটু এদিক ওদিক করলেও স্যার বড়জোর…”এই শরীফ, বোশো..ও…ও…ও” পর্যন্তই শেষ!
কিন্তু মাহিবুল হক (ছদ্মনাম-২) তা নন মোটেও। তার মনোজগতে ক্যাডেট মানেই সর্বাঙ্গে বান্দরের হাড়যুক্ত কিছু মানবকিশোরমাত্র। তাই এদের শায়েস্তা করে বান্দরনাচন দেখার মধ্যে তিনি এক পরমানন্দ লাভ করতেন বলেই আমাদের ধারণা। এই পরমানন্দ লাভের জন্য তিনি কখনো ক্যাডেটদের নিবাস ‘তারিক/কাসিম/খালিদ’ হাউজের সামনের বাগান হতে কখনো পাতাবাহার, কখনো বাতাবিলেবুর ডাল ভেঙ্গে নিয়ে আচমকা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়তেন ক্যাডেটদের রুমে। গেমস কিংবা প্রেপ ক্লাসে (Self-Preparation Class) যাবার কয়েক মিনিট বাকী আছে, কেউ হয়তো শ্রান্ত দেহে শেষ মিনিটের সুখনিদ্রা নিচ্ছে, কেউ হয়তো কোমরে টাওয়েল পেঁচিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করছে…কোন রেহাই নেই। পুচ্ছের উপর সপাৎ সপাৎ আওয়াজে ঘুমন্ত ক্যাডেট তিড়বিড়িয়ে উঠে এদিক ওদিক লম্পঝম্প দিতে থাকে, কারো কারো কোমর থেকে টাওয়েল সরে গিয়ে…ইয়ে মানে….বোঝেনই তো
কাজেই মাহিবুল স্যার মানেই ভয়ংকর নাম, আতঙ্কের নাম।
সেদিন রাতে ক্লাস টুয়েলভের ছাত্ররা প্রেপ ক্লাসে মনযোগ দিয়ে পড়ছে। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। সকালে সারওয়ার স্যারের গণিত ক্লাসে গতিবিদ্যার একটা অংক বুঝতে পারেনি অনেকেই। সারওয়ার স্যার সেদিন ডিউটি মাস্টার, কাজেই বাকী ৩ জন শিক্ষকের সাথে তারও প্রেপ ডিউটি। ৪ জন শিক্ষকের ৪টি আলাদা ব্লকে সুপারভাইজিংয়ের দায়িত্ব। (উল্লেখ্য, রাতের প্রেপ ক্লাসে ডিউটি মাস্টার স্যারের ড্রেস কোড এবং ক্যাডেটদের ড্রেস কোড একই থাকে। সাদা ট্রাউজার, সাদা ফুল স্লীভ শার্ট এবং ক্লোজকলার। তবে বাকী ৩ জন শিক্ষকের ড্রেস ইনফর্মাল।)
সারওয়ার স্যারের দায়িত্ব ক্লাস টুয়েলভের ক্লাসের ব্লকে। বলাবাহুল্য, মাহিবুল স্যারেরও সেদিন প্রেপ ডিউটি, তবে তা পাশের ব্লকে।
প্রেপ ক্লাস চলছে। ক্লাস টুয়েলভের ছাত্রদের ব্লকে সারওয়ার স্যার সুপারভাইজের দায়িত্ব থাকার সুবাদে তাদের রুমে ঢুকলে ক্যাডেটরা স্যারকে ধরলো- স্যার গতিবিদ্যার যে অংকটা সকালে করিয়েছিলেন তা আমরা অনেকে বুঝতে পারিনি। আবার দয়া করে বোঝান।
বন্ধুবৎসল সারওয়ার স্যার রাজী হলেন। একজন ক্যাডেটের ডেস্কের সামনে দাড়িয়ে গণিতের সমাধান দেখাচ্ছিলেন। কঠিন গণিতের সমাধান বোঝার দরকার ছিল সবারই, তাই সবাই স্যারকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল। এই বোঝাবার ফাঁকে এবং ড্রেসের বদৌলতে ছোটখাট সারওয়ার স্যার তার ক্লাস টুয়েলভে পড়ুয়া ইয়াং ক্যাডেটদের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেলেন।
সারওয়ার স্যার ক্যাডেটদের দিকে ফিরে, ক্যাডেটদের মুখ ক্লাসরুমের গেটের দিকে। গণিতের সমাধান চলছে…. আর গণিতের সমাধান সৃষ্টি করছে খানিকটা গুঞ্জনের…
বিশেষ প্রাণীর মত প্রখর ইন্দ্রিয়ক্ষমতাসম্পন্ন মাহিবুল হক স্যার গন্ধ শুঁকে বুঝে ফেললেন- সেকেন্ড ইয়ারের ক্যাডেট বান্দরেরা বান্দরামি শুরু করেছে। তাঁর নিজের ব্লকের এখতিয়ারকে গুলি মেরে পাশের ব্লকের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। হাঁটার স্টাইলও নিঃশব্দ, তবে প্রকাণ্ড শরীরটাকে এদিক ওদিক দুলিয়ে যেভাবে বয়ে বেড়াতেন তাতে তাকে দশাসই কুস্তিগীরের মতোই দেখাত।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে মাহিবুল স্যার গেলেন টুয়েলভের ক্লাসরুমের কাছে। না, ঢুকলেন না…
দরজার ফাঁক দিয়ে কাহিনী দেখতে লাগলেন।
তিনি দেখলেন- এক বান্দর সব বান্দরকে জড়ো করে কী যেন করছে। ….সেল্প স্টাডি ক্লাসে নিজের সাথে সাথে সবার পড়াশুনা শিকোয় তোলা হচ্ছে!!! এত বান্দরামি!!!!
মাহিবুল হকের আর সহ্য হলোনা।
দরজার আড়াল থেকে আচমকা দৃশ্যপটে উদিত হয়ে কেউটের মতো ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করতে করতে তিনি খর্বাকৃতির ঐ ‘বান্দরপতি’ ক্যাডেটের কাছে পৌছে গেলেন। হাত মুঠি করে তার পেছনে এসে পিঠের উপর হাকিয়ে দিলেন ধুমধুম করে সজোরে বারকয়েক কিলঘুষি।
সময় ও ক্লাসরুম যেন স্তব্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য।……..
ক্যাডেটরা দেখলো মাহিবুল স্যার দ্রুতবেগে ধেয়ে এসে সারওয়ার স্যারের পিঠের উপর ধুমাধুম দিচ্ছেন !……..আর সারওয়ার স্যার হঠাৎ পিঠের উপর কিল খেয়ে আকষ্মিকতায় ঘুরে দাঁড়িয়ে মাহিবুল স্যারকে দেখে যতোটা বিষ্মিত ততোটাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন!! ‘আমারে মাইর দিল কেডা??!!’
আর ক্যাডেট ভেবে তাঁর হাতে মার খাওয়া সহকর্মী যখন ফিরে দাঁড়ালেন, মাহিবুল হক স্যারের অবস্থা তখন তথৈবচ!! তিনি তখন কীভাবে ক্ষমা চাইবেন, মানসম্মান বাঁচাবেন আর কীভাবে ‘বান্দর’ ক্যাডেটদের সামনে মুখ লুকাবেন!!! ধরণী স্যারের জন্য সেই প্রথমবারের জন্য দ্বিধা হয়েছিল বোধহয়
ক্যাডেটরা তখন পেছন থেকে ফিক ফিক করে হাসছিল…কেমন শাস্তি, অ্যাঁ….
শুনেছি বহুদিন মাহিবুল হক স্যার তার বান্দরপেটানো বন্ধ রেখেছিলেন
ক্যাডেট কলেজ এসবের জন্যই অনবদ্য স্থান। অমোচনীয় স্মৃতির আঁখড়া…:)
(মহান রব্বুল আলামিন সব স্যারদের মঙ্গল করুন)
বাংলাদেশ সময়: ১৩:০৩:৫৬ ১৫২৬ বার পঠিত #bangla news #bangla newspaper #bangladesh news #bd news #daily newspaper #World News