বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল দলের জন্য নির্বাচিত খেলোয়াড় সাবিনা আক্তারের মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত। আমি তার কর্মময় জীবনের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাই। সামান্য দুদিনের জ্বরে তিনি অকালে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। নিম্নমানের চিকিৎসা, নিদারুণ অবহেলা আর অবজ্ঞার কারণেই প্রত্যন্ত অজপাড়াগাঁও কলসিন্দুর গ্রামের এই সম্ভাবনাময় নারী ফুটবলারের মৃত্যু ঘটেছে বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের সমাজ এবং কর্তৃপক্ষ কেউই এ দায় এড়াতে পারে না। স্মরণ করা যেতে পারে বাংলাদেশের প্রমিলা ফুটবলাররা ২০১৬ সালে সেপ্টেম্বর মাসে নেপালে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ মহিলা ফুটবলের আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন।তখন এ গ্রামেরই ৯ জন নারী ফুটবলার খেলেছিলেন ঐ দলে। গারো পাহাড়ের কোলের কলসিন্দুর গ্রামের এই ক্ষুদে ফুটবল কন্যাদের ওপর ভর করে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল তাজিকিস্তান থেকেও জয় করেছিল শিরোপা। কিন্তু তখনও অবহেলা, অপমান আর অসম্মানই বরণ করতে হয়েছিল তাদের।
শিরোপা জয় করে দেশে ফেরার পর ২০১৬ সালের ০৬ সেপ্টেম্বর বাড়ি ফেরার পথে নিলয় পরিবহণের লোকাল বাসে উঠতে হয়েছিল এই মেয়েদের। বাসের ভীড়ে নিদারুণভাবে অসম্মানিত এবং অপমানিত হতে হয়েছিল দেশের মুখ উজ্জ্বল করা এই সোনার মেয়েদের। সেদিন অশালীন টিকা টিপ্পনি এবং বিশ্রিী ভাষার গালাগালি শুনতে হয়েছিল তাদের।অতঃপর স্কুল থেকে বহিষ্কারের হুমকিও মোকাবিলা করতে হয়েছে এই হতভাগাদের।হবেই তো, দেশের মুখ উজ্জ্বল করার একটা পুরস্কার আছে না! তাছাড়া তাদের পাপ তো আর যে সে পাপ নয়, এ তো নারী হয়ে ফুটবল খেলার পাপ!
অথচ ক্রিকেট বা অন্য কোন খেলায় ছেলেদের কোন দল ভালো করলে তাদের জন্য অর্থ, অভ্যর্থনার ছড়াছড়ি আর নিরাপত্তার কী দুর্ভেদ্য বলয়ই না আমরা রচনা করি। তাই ভাবি, কী নিদারুণ বৈষম্য আর অসম্মান প্রদর্শন করা হলো এই মেয়েদের প্রতি! এ কি শুধু তারা নারী বলে? না কি তারা গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশ বলে? জাতীয় দলের জন্য নির্বাচিত এই অনন্য ফুটবল প্রতিভাকে পরিচর্যা করার কোন দায়ই আমাদের ছিল না?
গারো পাহাড়ের পাদদেশের নিভৃত একটি গ্রামের নাম কলসিন্দুর। গারো পাহাড় থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার উত্তরে নেতাই নদীর পাড়ের সমৃদ্ধ জনপদ হলো এই কলসিন্দুর। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার ২নং গামারীতলা ইউনিয়নের এই গ্রাম নতুন প্রজন্মের নারী ফুটবলারদের প্রতিভাগুণে নতুন করে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। প্রমীলা ফুটবলের অন্যতম সূতিকাগার হিসেবেও ইতোমধ্যে পরিচিত হয়ে উঠেছে কলসিন্দুর গ্রাম। এই গ্রাম থেকে উঠে এসেছে একঝাঁক সম্ভাবনাময় প্রতিশ্রুতিশীল নারী ফুটবলার।এই দুর্গম প্রত্যন্ত পল্লির মেয়ে সাবিনা আক্তার দেশের ফুটবলে আশার আলো হয়ে উঠছিলেন।
কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়ে শিক্ষার্থীরা ফুটবল মাঠে দুরন্তপনা দেখিয়ে সবার নজর কেড়েছেন। পড়ালেখার পাশাপাশি এই বিদ্যালয় থেকে উঠে আসছে জাতীয় পর্যায়ের নারী ফুটবলাররা। ইতোমধ্যেই ধারাবাহিক সাফল্য দেখিয়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন ।
আজ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ মঙ্গলবার বেলা সাড়ে তিনটায় বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল দলের জন্য নির্বাচিত এই সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় সাবিনা আক্তার ময়মনসিংহের ধোবাউড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। জ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় তাকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনা হয়েছিলো।
থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য অনূর্ধ্ব-১৬ এএফসি চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের প্রাথমিক ক্যাম্পে জায়গা করে নেওয়া এই ফুটবলারের আগামীকাল ২৭ স্পেটম্বর বুধবার সকালেই ঢাকায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ক্যাম্পে যোগ দেয়ার কথা ছিল। দলের হয়ে মিডফিল্ডার পজিশনে খেলতেন সাবিনা আক্তার। ২০১৩ সালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ডাক পান বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ দলের প্রাথমিক ক্যাম্পে। সেখান থেকে এবার অনূর্ধ্ব-১৫ দলে সুযোগ পান তিনি। সাবিনার সতীর্থদের মধ্যে তহুরা আক্তার, মারিয়া মান্দা, মাহমুদা আক্তার ও লুপা আক্তার উল্লেখযোগ্য। কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাবিনা গত ১৯ সেপ্টেম্বর গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়ও চ্যাম্পিয়ন হয়।
আমাদের জাতীয় দুর্ভাগ্য এমন কিশোরী প্রতিভাকে আমাদের মাঝে পেয়েও আমরা তাকে হারালাম। আবারও তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা।
বাংলাদেশ সময়: ২:০৭:১৬ ১৩৬৯ বার পঠিত #bangla news #bangla newspaper #bangladesh news #bd news #daily newspaper #World News