বঙ্গ-নিউজঃ রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রয়েছে। তারপরও থামছে না মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ। গত ২৫ আগস্ট সহিংসতা শুরুর পর এক মাস পেরিয়েছে। কিন্তু বন্ধ হয়নি রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও বাড়িঘরে আগুন দেয়া। গতকাল মঙ্গলবারও নাফ নদীতে পাঁচজন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধারের খবর পাওয়া গেছে। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়তে দেখা গেছে। এখনো বইছে রোহিঙ্গা স্রোত। গত চারদিনেই বাংলাদেশে এসেছে ৪ লাখ ৮০ হাজার। ওষুধ, খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও আবাসন সংকট বিরাজ করছে ক্যাম্পগুলোতে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিরামহীন কাজ করে চলছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলো।
গত সপ্তাহে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভাষণে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বৈশ্বিক সাহায্য চেয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গা নিধন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের ফিরিয়ে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখার দাবিও জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেজ, জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা, আসিয়ানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংগঠন ইতিমধ্যে এই সহিংসতাকে ‘জাতিগত নিধন’ বলে আখ্যা দিয়েছে। কিছু মানবাধিকার সংস্থা একে ‘গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার প্রধান মিয়ানমারকে সমস্যার সমাধান করতে বলেছেন।
রাশিয়া, চীন ও ভারত এই ইস্যুতে বিতর্কিত অবস্থান নিয়েছে। তবে ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক দেশই এই সহিংসতার বিরুদ্ধে। তারা মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ ও অবরোধ আরোপের দাবি জানিয়েছে। মিয়ানমারকে সামরিক প্রশিক্ষণ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য। নোবেল লরিয়েটরাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিরা রোহিঙ্গা নিধনের নিন্দা জানিয়েছেন। এতো কিছুর পরও মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান থেকে টলেনি। মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়েছে। দেশটির সেনাবাহিনীর প্রধান মিন অং হ্লা সেদেশের জনগণকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এক হতে বলেছেন। আর রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি বলেছেন, রোহিঙ্গারা কেন বাংলাদেশে পালিয়ে যাচ্ছে তা তিনি জানেন না। তবে অব্যাহত চাপের মুখে মিয়ানমারের একজন মন্ত্রীর ভিন্ন সুর পাওয়া গেছে। অল্প ক’দিনের মধ্যেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা করতে বাংলাদেশে আসার কথা বলেছেন তিনি। এর বাইরে অন্যান্য বিষয়ে মিয়ানমার এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
গত মাসের ২৫ আগস্ট থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) হিসেবে ৪ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছিল। গতকাল মঙ্গলবার সংস্থাটির নতুন এক প্রতিবেদনে সোমবার পর্যন্ত অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা ৪ লাখ ৮০ হাজার বলে জানানো হয়েছে। অর্থাত্ চারদিনে আরো ৪৪ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে। এরমধ্যে আগের তিনটি অস্থায়ী শিবিরে অবস্থান নিয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার, নতুন করে গড়ে ওঠা শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে ২ লাখ ১ হাজার। কক্সবাজার শহর, উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয়দের বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছে ৮৯ হাজার রোহিঙ্গা। পালিয়ে আসা শরণার্থীদের বড় অংশই শিশু ও নারী।
দুর্দশাগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়ে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশংসা পেয়েছেন। আশ্রিতদের ভরণ-পোষণ ও চাপ সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। শরণার্থীদের চাপ সামলাতে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন পড়ছে। প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিনটন পোস্ট এক প্রতিবেদনে বলেছে, ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা গণহত্যার পর এতো অল্প সময়ে মধ্যে এতোবেশি শরণার্থীর ঢল আর দেখা যায়নি। তাদের জন্য আশ্রয়, খাবার, পানি ওষুধ সরবরাহে বেগ পেতে হচ্ছে।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার ও স্বাস্থ্যসংস্থাগুলো শরণার্থী শিবিরে মহামারী ছড়িয়ে পড়ারও আশঙ্কা করছে।
সরকার উখিয়ার বালুখালীতে নতুন আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে দুই হাজার একর জমি বরাদ্দ করেছে। কিন্তু ত্রাণ বিতরণসহ অন্যান্য সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ পুরোপুরি শুরু হয়নি। সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা এক-পঞ্চমাংশ রোহিঙ্গাকে রেশনের আওতায় এনেছে। তবে পানির অভাব থাকায় আশপাশের জলাশয়গুলো শুকিয়ে যেতে পারে বলে শংকা প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সংস্থা।
অন্য দিকে, গতকাল কয়েকজন রোহিঙ্গা জানিয়েছে, গত সোমবার বিকালে তারা ১০-১২ জন বাংলাদেশের দিকে আসছিল। রাখাইন থেকে দুটি নৌকায় করে নাফ নদী পাড়ি দিচ্ছিল। এসময় নদীতে টহলে থাকা মিয়ানমার নৌবাহিনীর সদস্যরা তাদের ধাওয়া করে। একটি নৌকা পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। কিন্তু অন্যটি নৌবাহিনীর হাতে আটকা পড়ে। ওই নৌকায় ছয়জন ছিল। তাদের একে একে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। তারপর লাশ নদীতে ছুড়ে ফেলে। আহত একজন নদীতে ঝাঁপ দেয়। সে কোনো রকমে পালিয়ে বাংলাদেশের উপকূলে আসে। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে বালুখালীর একটি হাসপাতালে নিয়ে আসে।
গতকাল দুপুরে স্থানীয়রা বলেন, সীমান্তের গ্রামগুলোতে এখনো আগুন দেয়া হচ্ছে। আকাশে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। রাখাইন ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা রোহিঙ্গা এক্টিভিস্টরা বলছেন, সেনাবাহিনী এখনো সেখানে অভিযান বন্ধ করেনি।
গত ২৫ আগস্ট উত্তর রাখাইনে কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়ি ও সেনা ক্যাম্পে হামলা হয়। অভিযোগ ওঠে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নামে একটি সংগঠন এই হামলা চালায়। এরপর রোহিঙ্গাদের ওপর নেমে আসে সহিংসতা। শত শত ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। একমাসে কমপক্ষে দশ হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়। অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। অভিভাবকহীন অবস্থায় পালিয়ে এসেছে ১৪শ শিশু।
কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে নতুন রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রমে সাড়া মিলেছে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে নিবন্ধন। এ পর্যন্ত ১৯ হাজার ২শ ৭৯ জন রোহিঙ্গার নিবন্ধন সম্পন্ন হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১:২৯:৩৯ ৫৩৯ বার পঠিত #bangla news #bangla newspaper #bangladesh news #bd news #daily newspaper #World News