বঙ্গ- নিউজ ডটকমঃ সাভারের রানা প্লাজা ধসে ব্যাপক প্রাণহানির পর রাজধানীর প্রায় ১৫০টি ভবন পর্যবেক্ষণ করে প্রাথমিক রিপোর্ট দিয়েছেন বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা। ভবন পরিদর্শনের জন্য এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ আবেদন পড়েছে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগে। প্রাথমিক পরিদর্শনে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ভবনই কোন না কোনভানে ঝুঁকিপূর্ণ। তবে ৪০ ভাগ ভবন অর্থাৎ ৬০টি ভবন বসবাস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় আছে মহাখালী এলাকার গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব গার্মেন্ট ভবন তৈরি করা হয়েছিল কমার্শিয়াল বা আবাসিক ভবন হিসেবে। কিন্তু এখন এসব ভবন ব্যবহার করা হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল (শিল্প ভবন) ভবন হিসেবে। ফলে সেখানে ভারি ভারি যন্ত্র, জেনারেটর এবং লোকজনের উপস্থিতি অনেক বেশি। এর ফলে ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ভবন ধসে যে কোন সময় রানা প্লাজার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি ঘটতে পারে। বিষয়টি সতর্ক করে দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। এছাড়া কমপ্লিট ইঞ্জিনিয়ারিং টেস্ট অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে মালিক পক্ষকে। এ পরীক্ষার পর্যায়ে ভবনের নিচের ফাউন্ডেশন যাচাই করে দেখতে হবে। এজন্য ভবনের নিচে খুঁড়তে হবে। এদিকে ভবনগুলো পরিদর্শনের ফল সম্পর্কে আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে রাজউককে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন ও সুপারিশ জমা দেবে বুয়েট। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের চেয়ারম্যান ও তদন্তের সমন্বয়ক অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও ব্যক্তিগত অনুরোধের প্রেক্ষিতে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষকরা এ তদন্ত কাজ পরিচালনা করছেন। গত ২৪শে এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়লে অসংখ্য মানুষ নিহত ও পঙ্গুত্ববরণ করেন। ফাটল-আতঙ্কে রাজধানী এবং এর বাইরে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ও পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণাও করা হয়েছে। কিছু ভবনের ক্ষেত্রে অনিয়ম পাওয়ায় মালিকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। ভবন পরীক্ষার জন্য আবেদন করতে হয় বুয়েটের ব্যুরো অব রিসার্চ, টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেশনের (বিআরটিসি) পরিচালকের কাছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন ভবন পরীক্ষার জন্য ৩০শে এপ্রিল থেকে ১লা জুন পর্যন্ত বুয়েটে সরাসরি প্রায় ৫০০ আবেদন জমা পড়ে। আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৫টি তদন্ত দল বিভিন্ন এলাকার ভবন পর্যবেক্ষণ করছে। যেসব ভবন পর্যবেক্ষণ করে তাৎক্ষণিক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে তার মধ্যে বেশির ভাগই গার্মেন্ট এবং স্কুল। এছাড়া ব্যাংক-বীমা ও আবাসিক ভবন রয়েছে। একটি তদন্ত দলের প্রধান অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী মানবজমিনকে বলেন, পরিদর্শনে বিভিন্ন ধরনের ক্রটি ধরা পড়েছে। যেসব ভবন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সেসব ভবন সম্পর্কে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিল্ডিং কোড না মানা, কলাম ও বিমে ফাটল, অনুমোদনহীন তলা করাসহ নানা ধরনের ক্রটি ধরা পড়েছে। তিনি বলেন, বিমে ফাটল তেমন ঝুঁকিপূর্ণ না হলেও কলাম ফাটলে রয়েছে বিরাট ঝুঁকি। তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণে যেসব ক্রটি ধরা পড়েছে তার মধ্যে রয়েছে ৫ বা ৬ তলার ভবন তৈরির অনুমোদন নিয়ে ৯, ১০ এমনকি ১১ বা ১২তলা পর্যন্ত করা। রয়েছে অতিরিক্ত ফ্ল্যাট। রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকার ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এসব আবেদন করা হয়েছে। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুজিবর রহমান বলেন, আমাদের কাজ চলছে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েট এ পর্যন্ত প্রায় ১৫০টি ভবনের পরিদর্শন করে প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে ভবনের বাড়তি তলা নির্মাণ, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, অবকাঠামো দুর্বলতা ইত্যাদি। তবে এসব ভবন আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন বলে জানান তিনি। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবেদনের পর বিশেষজ্ঞ দল গিয়ে ভবনের প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা তথা ভবনের কোথাও কোন ফাটল আছে কিনা, ভবনের নকশা ও মাটির অবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন আছে কিনা প্রভৃতি যাচাই করে একটি প্রতিবেদন দেয়া হয়। প্রতিবেদনে প্রাথমিক নির্দেশনার পাশাপাশি ভবনের প্রকৌশলগত ও অবকাঠামোগত পরীক্ষা করার কথাও বলা হয়। সব পরীক্ষার পর দেখতে হয়, ভবনটি ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী নির্মিত কিনা। একটি তদন্ত দলের প্রধান অধ্যাপক বদরুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন ধাপে তদন্ত কাজ পরিচালনা করতে হয়। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভবনের জন্য ৩০ ফুট পাইলসের জায়গায় দেয়া হয়েছে ১৫ ফুট। এটা করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ।
পিছু হটছেন আবেদনকারীরা: রানা প্লাজা ধসের পর যেসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পরিদর্শনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল তাদের অনেকেই পিছু হটতে শুরু করেছে। এর অন্যতম কারণ হয়েছে পরিদর্শনকৃত বেশির ভাগ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ ধরা পড়ায়। কেননা, এর ফলে তাদের ব্যবসা ঝুঁকিতে পড়তে পারে। সরকার বা রাজউক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। এজন্য তারা আবেদন করেও এখন খোঁজখবর নিচ্ছেন না। অনেক ক্ষেত্রে পরিদর্শনের তারিখ দিয়েও তাদের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না।
যেসব সুপারিশ থাকছে প্রতিবেদনে: রাজধানীতে ও এর বাইরে অনেক ভবন ৫০, ১০০ বা ১৫০ বছরের পুরনো। এসব ভবনের কোনটিই বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুযায়ী করা হয়নি। আর এটা করা তখন সম্ভবও ছিল না। কিন্তু এসব ভবনে এখনও মানুষ বাস করছে। যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ভবন নিয়মিত মনিটরিং করে কমপ্লিট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আনার সুপারিশ করা হচ্ছে। এছাড়া যেসব ভবন বিল্ডিং কোড অনুযায়ী তৈরি হয়নি তা বিল্ডিং কোডের আওতায় আনা। কমার্শিয়াল বা রেসিডেন্সিয়াল ভবন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভবন হিসেবে ব্যবহার না করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া। অনুমোদনহীন ভবন নির্মাণ বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া। ইতিমধ্যে যেসব ভবন ডিজাইন ছাড়া করা হয়েছে সেসব ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ব্যবস্থা নেয়া। যেসব ভবনের কলামে ফাটল দেখা দিয়েছে সেসব ভবনকে বিল্ডিং কোডের আওতায় নিয়ে আসা। রাজধানী ও বাইরের সব ভবন পরিদর্শন করার ব্যবস্থা করা। পুরকৌশল বিভাগের চেয়ারম্যান ও পরিদর্শন দলের সমন্বয়ক অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, রাজউকের অনুরোধেই আমরা পরিদর্শন পরিচালনা করছি। এছাড়া ব্যক্তিগত আবেদনের প্রেক্ষিতেও কিছু ভবন পরিদর্শন করেছি। আমরা আনুষ্ঠানিক পরিদর্শন রিপোর্ট ও সুপারিশ আগামী ২ সপ্তাহের মধ্যেই রাজউকে জমা দেয়ার চেষ্টা করবো।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৫৩:০৫ ৫০৫ বার পঠিত