বঙ্গ-নিউজ:ব্যাংকে নগদ টাকা জমা ও তোলার ক্ষেত্রে সীমা আরোপ করা হচ্ছে। বর্তমানে গ্রাহকরা যে কোনো বড় অঙ্কের টাকা নগদ তুলতে ও জমা দিতে পারেন। এর কোনো সীমারেখা নেই। বড় অঙ্কের এই লেনদেনের লাগাম টানার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনা পেয়ে এ বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
সূত্র জানায়, এর উদ্দেশ্য মানি লন্ডারিং ও জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধ। এ নীতিমালা কার্যকর হলে নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি টাকা নগদে তোলা বা জমা দেওয়া যাবে না। সীমার বেশি লেনদেন করতে হবে অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক বা অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরের মাধ্যমে। তবে এ সীমা কত হবে তা এখনও নির্দিষ্ট করা হয়নি। এদিকে সীমা বেঁধে দেওয়া হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, নীতিমালা এমনভাবে করা হবে যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কোনো বিরূপ প্রভাব না পড়ে।
নগদ লেনদেন সীমিত করার লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া এক চিঠিতে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে আবশ্যিকভাবে পাঁচটি বিষয় থাকতে হবে। এতে বলা হয়েছে, গতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রেখে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নসহ বিভিন্ন আর্থিক অপরাধ রোধে নগদ অর্থের প্রবাহ কমানোর উপায় নির্ধারণ করতে হবে। দেশের অর্থনীতিতে কী পরিমাণ নগদ অর্থ প্রচলিত আছে এবং কী পরিমাণ নগদ অর্থের প্রয়োজন রয়েছে সে বিষয়ে বিশ্লেষণ থাকতে হবে। আর নগদ অর্থ প্রবাহের সঙ্গে অপরাধ প্রবণতার সম্পর্ক জানাতে হবে। নগদ অর্থ বিনিময়ের ধরন ও জনগণ কর্তৃক ধারণের প্রকৃতি উল্লেখ করতে হবে। এ ছাড়া আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপের ফলে নগদ অর্থ প্রবাহের ওপর এর প্রভাব বিশ্লেষণ করতে হবে। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব বিবেচনায় কোনো কিছু থাকলে তাও প্রতিবেদনে যুক্ত করতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, জঙ্গি ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে জাতীয় কর্মকৌশল বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের নির্দেশনার আলোকে নীতিমালা তৈরির সাচিবিক দায়িত্ব পালন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম এবং কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ সার্বিক বিষয়ে সহযোগিতা দিচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, অবৈধ লেনদেন ঠেকাতে নগদ লেনদেনে সীমা আরোপের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এর পেছনে যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, যে কোনো লেনদেন চেকের বিপরীতে বা অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরভিত্তিক হলে তা কোথায় কী কাজে ব্যবহার হয় তার প্রমাণ থাকে। কেউ যদি নগদ টাকা উত্তোলন করে অবৈধ কাজে ব্যবহার করেন তাহলে খুঁজে বের করা কঠিন। বিশ্বের অনেক দেশে নগদ লেনদেনের ক্ষেত্রে সীমা বেঁধে দেওয়া আছে বলে তিনি জানান।
তবে নগদ লেনদেন সীমিত করলে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিরূপ প্রভাবও পড়তে পারে। জানতে চাইলে রফতানি কারকদের সংগঠন ইএবির সভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, সরকার কী করতে চাইছে তা তারা জানেন না। তবে যাই করা হোক, তা যেন বাস্তবধর্মী হয়। তা না হলে বড় প্রতিষ্ঠান বিশেষত অনেক শ্রমিক কাজ করে এরকম টেক্সটাইল ও পোশাক কারখানাগুলো বিপদে পড়বে। তিনি বলেন, বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে শ্রমিকদের এক মাসের বেতন দিতে ১০-২০ কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। এসব শ্রমিকের বেশিভাগেরই এখনও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। ফলে সীমা মানতে গিয়ে মালিকদের কয়েক দফায় টাকা তুলে বেতন দিতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ওই কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, সরকার হয়তো এসব অবগত আছে। নীতিমালা করার ক্ষেত্রেও তা মাথায় রাখা হবে।
একাধিক বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা এ প্রতিবেদককে জানান, লেনদেনে সীমা বেঁধে দিলেই জঙ্গি বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন ঠেকানো যাবে তা নয়। বরং সীমা বেঁধে দিলে মানুষ ব্যাংকের তুলনায় নিজের কাছে টাকা রাখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। যেসব দেশে এরকম ব্যবস্থা রয়েছে তাদের অধিকাংশ লেনদেনই ই-পেমেন্টভিত্তিক। ওই সব দেশে কার্ডের মাধ্যমে সব ধরনের কেনাকাটা বা বিল পরিশোধের চর্চা রয়েছে। এমনকি গাড়ি ভাড়া, রেস্টুরেন্টসহ যে কোনো ধরনের বিল তারা কার্ড বা অ্যাকাউন্ট থেকে পরিশোধ করতে পারেন। বাংলাদেশ এখনও ওই পর্যায়ে আসেনি। এখানকার অনেক প্রতিষ্ঠান বিশেষত গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন নগদে দেওয়া হয়। ফলে এখনই এই নিয়ম বাস্তবায়ন করা হলে আর্থিক ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।
রাজধানীর মৌলভীবাজারে দৈনিক প্রচুর নগদ লেনদেন হয়। মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বলেন, নীতিমালায় কী থাকবে, না থাকবে তা না দেখে এখনই মন্তব্য করা যাবে না। তবে খুব স্বাভাবিকভাবে এটুকু বলা যায়, নগদ লেনদেনে সীমা বেঁধে দিলে মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে নিজের কাছেই বেশি রাখবে। টাকা যদি ব্যাংকে না রেখে বাসায় রাখা শুরু করে তাহলে তার নেতিবাচক প্রভাবও সরকারকে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা জানান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ নির্দেশনা পাওয়ার পর নীতিমালার খসড়া তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। নগদ লেনদেন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তোলা ও জমার প্রতিটি পর্যায়ে সীমা ঠিক করে দেওয়ার বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ভেদে ভিন্ন-ভিন্ন সীমা থাকবে। তবে চেক বা অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর ভিত্তিক যে কোনো অঙ্কের পরিশোধে কোনো বাধা থাকবে না। এতে করে কার্ডভিত্তিক, ইএফটিএন, আরটিজিএসের মতো চ্যানেল ব্যবহার করে লেনদেন বাড়বে। যার প্রতিটি লেনদেনের রেকর্ড তাদের কাছে সংরক্ষিত থাকবে। কেউ জঙ্গি অর্থায়ন বা অবৈধ লেনদেন করলে তা ধরা সহজ হবে। প্রথম দিকে এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কিছুটা সমস্যা দেখা দিলেও ধীরে ধীরে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না বলে তাদের ধারণা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের এমডি এমএ হালিম চৌধুরী বলেন, নগদ জমা ও উত্তোলনের ক্ষেত্রে কোন উপায়ে এবং কী পরিমাণ অর্থ লেনদেনের সীমা বেঁধে দেওয়া হবে তার ওপর নির্ভর করবে সমস্যা হবে কি-না। বিশ্বের অনেক দেশে লেনদেনে সীমা বেঁধে দেওয়া আছে- এটা ঠিক। তবে বাংলাদেশে অনভ্যস্ততায় প্রথম দিকে এটা বাস্তবায়নে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে শ্রমিকদের নগদে বেতন দেয় এরকম প্রতিষ্ঠানের জন্য সমস্যা হতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনা করে সরকার নীতিমালা করবে বলে তিনি আশা করেন।
বিদ্যমান নিয়মে, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে যে কোনো পরিমাণের টাকা নগদে জমা বা তুলতে পারেন। তবে নগদ লেনদেনের পরিমাণ ১০ লাখ টাকার বেশি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিএফআইইউতে রিপোর্ট করতে হয়। আবার কোনো লেনদেন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কাছে সন্দেহ হলেও সে বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিএফআইইউকে জানাতে হয়। আর অ্যাকাউন্ট খোলার সময় প্রত্যেককে একটি ঘোষণা দিতে হয়। যেখানে অ্যাকাউন্টে কী পরিমাণ নগদ জমা বা উত্তোলন হবে তার একটি ধারণা দিতে হয়। ব্যাংকিং পরিভাষায় যাকে লেনদেন প্রোফাইল বা টিপি বলে। এই টিপিতে উলি্লখিত সীমার বেশি কেউ জমা বা উত্তোলন করতে পারে না। তবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের টিপিতে উলি্লখিত সীমার বেশি উত্তোলন বা জমার প্রয়োজন হলে সে ক্ষেত্রে যৌক্তিক কারণসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে আবেদন করে সীমা বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নগদ লেনদেনে বর্তমানে কোনো সীমা নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলো বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছে। অন্যের অ্যাকাউন্টে টাকা জমার ক্ষেত্রে বাহকককে তার জাতীয় পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। বড় অঙ্কের অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকের ক্ষেত্রে ব্যাংককে জানাতে হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৪৪:১৪ ৫৯০ বার পঠিত