এবার মিলানে একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা হলো। বিদেশে গিয়ে ট্যাক্সিতে চড়েছি তো কতবারই। কিন্তু এই প্রথমবার চড়লাম কোনো মহিলা ড্রাইভার চালিত ট্যাক্সিতে।
মিলান সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে রোমের ট্রেন ধরার জন্য হোটেলের রিসেপশনকে ট্যাক্সি ডেকে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছি। এক মিনিট পরেই আমার হাতে ছোট্ট একটা চিরকুট ধরিয়ে জানালো, এই তোমার ট্যাক্সি, চার মিনিটের মধ্যেই এখানে আসবে।
কাটায় কাটায় চার মিনিট বা তার কম সময়ে হোটেলের সামনে যে কারটি এসে দাঁড়ালো সেটিই যে আমাদের ট্যাক্সি তা বুঝতে একটু সময় লাগল, কারণ, ট্যাক্সি ড্রাইভার হবেন একজন মহিলা এটি আমাদের প্রত্যাশার মধ্যে ছিল না। অবশ্য, হোটেলের রিসেপশন থেকে দেয়া ট্যাক্সি বুকিংয়ের চিরকুটটা খেয়াল করে দেখলে আগেই বুঝতে পারতাম সেখানে গাড়ির নম্বরের পাশাপাশি ড্রাইভার ভেরোনার নামও লিখা আছে।
ইউরোপে ট্যাক্সি ড্রাইভাররা যাত্রীর মালসামানা নিজের হাতেই গাড়ি তোলে এবং নামিয়ে দেয়। এটি বোধহয় ইউরোপিয়ান টাক্সি ড্রাইভার এটিকেট। ভেরোনাও এর ব্যতিক্রম করে না। তবে, তার এটিকেটের অংশই হোক আর যাই হোক, ৩৫/৪০ বর্ষীয়একজন সুন্দরী মহিলা আমাদের লটবহর টেনে তার গাড়ির ডিকিতে উঠাবেন আর আমি তা চেয়ে চেয়ে দেখবো- এতো আন- শিভালরাস তো আর হতে পারি না! সুতরাং আমিও হাত লাগাই ।
ড্রাইভারদের এহেন সৌজন্যবোধের পেছনে কিছু অর্থনৈতিক কারণও আছে। ইউরোপ বা আমেরিকায় ট্যাক্সি ভাড়ার কিয়দংশ, ধরুণ ১০ শতাংশ, পরিমাণ অর্থ টিপস হিসেবে দেয়ার রেওয়াজ প্রচলিত আছে। বিভিন্ন সরকারী সফরে অরিয়েন্টেশনের ব্রিফিং এ জানিয়ে দেয়া হয়েছে এ ধরণের টিপস দেয়াটা কাস্টমারি। মানে দেয়াটা প্রত্যাশিত কিন্তু বাধ্যতামূলক নয়।। নিয়মটা জানা থাকলেও অনেক সময় তা পালন করা হয় না, প্রথমত খুচরো টাকা পয়সা না থাকার কারণে; আবার অনেক সময়ে ডলার বা ইউরোকে টাকায় রূপান্তরের মানসাংকটা করে মনে হয়, আমি দু’দিনের বৈরাগী , কী দরকার আমার টিপস দেয়ার বাবুগিরি ফলানোর! ভাড়ার টাকা দেয়ার পর ইউরোপীয় ড্রাইভাররা কানা পয়সার চেঞ্জটা পর্যন্ত বুঝিয়ে দেয় এবং বখশিশ বা টিপস দেয়া বিষয়ে নিঃশ্বাসটুকু ফেলবে না। কিপ দ্য চেঞ্জ বলে ফিরতি পয়সাটা তার কাছ থেকে না নিলে বা পকেট থেকে দুয়েক ডলার/ইউরো বের করলে ড্রাইভারের কাছ থেকে আকর্ণ বিস্তৃত ধন্যবাদটা পাওয় যায়। আর না দিলে? নিরুত্তাপ ধন্যবাদ। মিউনিখের ড্রাইভার সাহেব আর এক কাঠি সরেস। টিপস না পেয়ে গাড়ির ডিকিটা আমাদের জন্য খুলে দিয়েছে, মালসামানা নামানোর জন্য নিজে আর হাত লাগায়নি !
বিদেশে ট্যাক্সিতে চড়ার সময় আমার প্রিয় জায়গা ড্রাইভারের পাশের সীট। ড্রাইভার একটু আলাপী হলে তার সাথে কথা বলে জানা যায় একটা শহরের অনেক কিছুই। সাধারণত সে সুযোগটা আমি মিস করিনা কখনোই। দেশে রিক্সায় বা সিএনজিতে উঠলেও এই বদ অভ্যাসটা আমার পিছু ছাড়ে না; সংগে স্ত্রী থাকলে তাঁর চোখের ভাষায় পড়ি, এতো কথাও (পড়ুন প্যাচাল) মানুষ বলতে পারে!
তো, মিলানে, অল্প দূরত্বের জার্নির শুরুতেই ভেরোনাকে জানাই এই প্রথম আমি কোনো মহিলা ড্রাইভার চালিত ট্যাক্সিতে উঠছি। ভেরোনা স্মিত হেসে বলে, মাই প্লেজার। তারপর নিজ থেকেই জানায়, সে শুধু উইক-এন্ডে ট্যাক্সি চালায় । উইক ডেতে অন্য কাজ করে। আরো বলে, এই ট্যাক্সি চালানোটা সে খুব এনজয় করে। তার একটা প্রধান কারণ অনেক দেশের, অনেক মানুষের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। মিলানে প্রচুর টুরিস্ট আসে দেশ বিদেশ থেকে। বোঝলাম, অন্যের কথার জবাব দেয়া ছাড়া যে সব ট্যাক্সি ড্রাইভাররা নিজে থেকে টু শব্দটি করে না, ভেরোনা তাদের মতো নয়।
গোমড়া মুখো, মিতবাক, বন্ধুসুলভ, আলাপী, সুযোগ সন্ধানী, দালাল-টাইপ, ওভার স্মার্ট - কতো ধরণের ট্যাক্সি ড্রাইভারই না আছে। সিংগাপুরে এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে কথা বলার পর সে আমাকে সার্টিফিকেট দিয়েছিল, তুমি তো বেশ ভাল ইংরেজি বলো! ব্যাংককের ড্রাইভাররা ট্যাক্সিতে উঠার কিছুক্ষণ পরেই বিভিন্ন দ্রষ্টব্যের সচিত্র বিজ্ঞাপন উপস্থাপন করতে শুরু করবে । একবার সহযাত্রী বসের উপস্থিতিতে বিব্রতকর বিজ্ঞাপনের প্রদর্শনীতে বিরক্তি প্রকাশ করলে ব্যাংককের ড্রাইভারের সহজ স্বীকারোক্তি ছিল, অন্তত কয়েক মিনিটের জন্যও আমরা তার সাথে যদি একটা মনিমুক্তার/স্যুভেনিরের দোকানে যাই এবং কিছু নাও কিনি তাহলেও তার কয়েক লিটার পেট্রোলের সংস্থান হয়ে যায়। বলাবাহুল্য, সময়ের অজুহাতে তার অনুরোধ রাখা হয়নি।
একবার রাত দশটায় নিউইয়র্কে গ্রে হাউন্ড বাস স্টপেজ থেকে গন্তব্যের ঠিকানা দেখিয়ে যে ট্যাক্সিতে চড়েছিলাম তার ড্রাইভার ছিলেন একজন আফ্রো- আমেরিকান। ওখানে বোধহয় ড্রাইভারের পাশের সীটে বসার নিয়ম নেই, নিরাপত্তাজনিত কারণে। আমি সংকুচিত হয়ে পেছনের সীটে বসি। সে কোনো বাতচিত না করেই গাড়ি ছোটায় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। এমনিতেই রাত, তারপর কৃষ্ণাঙ্গ ড্রাইভার। গাড়িতে আমি একা। আমার ভেতরে অজানা আশংকার ধুকপুক। তারপর একসময় আমার গন্তব্য বন্ধুর বাসার সামনে গাড়ি থামিয়ে বলে, হিয়ার ইউ গো। এরপর, আবার আমার দিকে তাকিয়ে তার ঝকঝকে দন্ত বিকশিত স্মিত হাসি দিয়ে বলে, সো, নিউইয়র্ক ড্রাইভাররা অতো খারাপ না, হুম? গাড়িতে বসে ব্যাটা তার রিয়ার ভিউ আয়নায় আমার ভেতরের টেনশন ঠিক বুঝেছিল।
ট্যাক্সি ড্রাইভার নিয়ে আরো অনেক বিতং করা যায়। অন্তত উল্লেখ করা যায় রবার্ট ডি নিরো আর জুডি ফস্টারের বিখ্যাত, অনেক পুরষ্কার জয়ী ছবি ট্যাক্সি ড্রাইভারের কথা। সে বিতং এ না গিয়ে বরং শেষ করি মিলানের ভেরোনাকে দিয়েই। মিলান সেন্ট্রাল স্টেশনে পৌছে ১৩ ইউরো ভাড়ার সাথে আরো দুই ইউরো বখশিসের বিপরীতে পাওয়া ভেরোনার আন্তরিক ধন্যবাদের ভংগিটা ছিল সত্যি মনে রাখার মতো। তারপর গাড়ির ডিকি থেকে আমাদের ব্যাগেজ নামিয়ে দিতে দিতে সে বলে, নাইস ফ্যামিলি। বিশেষ করে তোমার স্ত্রী বেশ সুন্দরী আর মেয়েটা খুব কিউট। হ্যাভ আ নাইস হলিডে।
অন্যের , বিশেষ করে অন্য কোনো মেয়ের, মুখে নিজের স্ত্রীকন্যার প্রশংসা শুনলে কার না ভালো লাগে?
বাংলাদেশ সময়: ১১:৩৮:৪৫ ৫২৭ বার পঠিত