বঙ্গ-নিউজ:শোকের মাস আগস্ট, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানো মাস আগস্ট।আগস্ট শুধু মাস নয়। মাসের চাইতে বেশি কিছু। হোয়াংহো যেমন চীনের দুঃখ, আগস্ট তেমনি বাঙালিদের দুঃখ। এই মাসে বঙ্গমাতা তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারায়। বাংলার বেশীর ভাগ শ্রেষ্ঠ সন্তানের মৃত্যুই আগস্টে এবং আশ্চর্য বিষয় হলো ৩ জন বাঙালির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ এ আগস্টে পরলোক গমন করেন। একজন রাষ্ট্রনায়ক, আর দু’জন কবি।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এর প্রভাতপূর্ব অন্ধকারে ঘটে যায় এক বিস্ময়কর অঘটন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপকার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ও তার পরিবারকে হত্যা করা হয়। তারই গড়া এই সোনার বাংলায় একদল ক্ষমতালোভি ক্ষমতার মোহে হয়তোবা বাঙ্গালী জাতিকে দুর্বল করে রাখার জন্য এ মহান নেতা কে হত্যা করে । তিনি মহান ভাষা আন্দোলনে, তাৎপর্যপূর্ণ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ঐতিহাসিক ৬ দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন আর একাত্তরের শ্রেষ্ঠতম নায়ক, বহুবার কারা বরণকারী, পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম জননেতা,যিনি পাকিস্তানি কারাগারের ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে এসেছিলেন তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
আরও এক বিখ্যাত বাঙালি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি তিরিশোর্ধ গ্রন্থ আর আড়াই হাজার প্রায় অসাধারণ বাংলা গানের রচয়িতা, সঙ্গীতস্রষ্টা, গায়ক, বিদ্রোহের কবি, লিখেছেন জাগরণের কবিতা, যিনি বাংলার মানুষকে রাজপথে নামিয়েছিলেন গান ও প্রবন্ধ লিখে, নিজে কারাবরণ করেছিলেন; ব্রিটিশ সরকার যাঁর ৬টি গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করেছিল তিনি আমাদের জাতীয় কবি, রণসঙ্গীতের রূপকার কাজী নজরুল ইসলাম। তিনিও চিরদিনের জন্য হারিয়ে যান ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের এই আগস্টেরই ২৯ তারিখে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,যাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা, বিশ্বসাহিত্যের মহোত্তম সাহিত্য প্রতিভার যিনি অধিকারী ছিলেন। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, মহান ঔপন্যাসিক, মননশীল প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, নাট্যকার, বাংলা ছোটগল্পের জনক, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, চিত্রশিল্পী, নাট্যাভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক, সমাজসেবী ও শিক্ষাবিদ, এশিয়ার প্রথম (১৯১৩) নোবেল পুরস্কার জয়ী; ১৪২টি গ্রন্থ, আড়াই হাজারের মতো অমৃতসঞ্জীবনী গান ও প্রায় দুই হাজার চিত্রের জনক, বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির বিস্ময়কর অগ্রগতির রূপকার; একমাত্র কবি হিসেবে পৃথিবীর তিন তিনটি স্বাধীন দেশের (বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা) জাতীয় সংগীতের রচয়িতা এই বিশ্বমানব ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেয়।
আগস্ট যেন মৃত্যুর দোয়ার খুলে বসে আছে। এই আগস্টে আরও এক শ্রেষ্ঠ সন্তান কে হারায় বাঙালি জাতি। তিনি বাংলা ভাষার প্রধান কবিদের অন্যতম একজন, যিনি জীবদ্দশাতেই বাংলাদেশের প্রধান কবির শিরোপাপ্রাপ্ত জীবনানন্দ দাশ। পরবর্তী শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি, বাংলা ভাষায় সর্বোচ্চ সংখ্যক ৬৫ টির ও বেশী কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা শামসুর রাহমানও হাসপাতালশয্যায় কষ্ট পেতে পেতে চিরমুক্ত হলেন ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট।
এ ছাড়া ড. হমায়ুন আজাদ। ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট, আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে জার্মানিতে অবস্থানকালে রহস্যজনক ভাবে লোকান্তরিত হন। ৬ দফা কেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক; সিরাজউদ্দৌলা নাটকের অনন্য রূপকার সমকাল সম্পাদক, ‘আমাদের সংগাম চলবেই’ সহ একাধিক গণসঙ্গীতের রচয়িতা, কবি সিকান্দার আবু জাফরও এই আগস্টেই বঙ্গবন্ধু হত হওয়ার মাত্র ১০ দিন আগে, ১৯৭৫ এ ৫ আগস্ট মৃত্যু বরণ করেন।
এছাড়াও পৃথিবীর ইতিহাসে বর্বর নেক্কার জনক ঘটনা ঘটেছে এ আগস্ট মাসে। ১৯৪৫ সালের আগস্ট তারিখ দু’টির কথা যদি না বলি, বেদনা বাড়বে বৈ কমবে না। ৬ আগস্ট হিরোশিমা ও ৯ আগস্ট নাগাশাকি শহরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হেনরি ট্রুম্যান-এর নির্দেশে যে দু’টি পারমাণবিক বোমা নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, তাতে দেড় লক্ষেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল, প্রায় তিনলক্ষ লোক আহত হয়েছিল, শহর দু’টি কেবল ধ্বংসই হয়নি, আজও সেখানে নতুন শিশুর জন্ম হয় পরমাণু তেজস্ক্রিয়তার ঝুঁকি নিয়ে। শুধু বাঙালিত্বের সভ্যতার ইতিহাসের কথা বলে এই অতুলনীয় বর্বরতাকে গোপন রাখা যায় না।আর এরই সূত্র ধরে স্মরণ করতে হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বোমা হামলায় প্রায় ২০ জন তরতাজা প্রাণের নিহত কথা। সেদিন বঙ্গবন্ধু কন্যা গুরুতর আহত হলেও সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান।
১৩আগস্ট ২০১১ মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে বিদায় নেয় বাংলাদেশের মহান চিত্রপরিচালক, সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রার অন্যতম দূত তারেক মাসুদ। দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলায়ও বহু হতাহত হয় এই আগষ্টে। হয়তো আরও কিছু হত্যাযজ্ঞের কথা অনুল্লেখিত রয়ে গেল। তবে এই থেকে বুঝা যায় আগস্ট মাসই ছিনিয়ে নিয়েছে শ্রেষ্ট সন্তানদের সভ্যতার মহাসৌধ থেকে তুলে নিয়েছে অনেক মূল্যবান মুকুট।
বাংলাদেশ সময়: ১২:৫২:২৩ ৮১৪ বার পঠিত