
প্রেম ভালোবাসার জন্য কানকাটা যাওয়ার (আক্ষরিক ও রূপক উভয়ার্থে) নজির অনেক আছে, নজির আছে সামাজিকভাবে হেনস্তা করার জন্য কান কাটারও ( স্মরণ করুন শহীদুল্লাহ কায়সারের সংশপ্তকের কানাকাটা রমজানের কথা) । কিন্তু প্রেমের জন্য বা অন্যের প্রতি সহানুভূতি জানানোর জন্য নিজের কর্ণ বিসর্জনের নজির বিশ্ব ইতিহাসে সম্ভবত একটাই। শিল্পের ইতিহাসেও এমন বহুল প্রচলিত গল্প অল্পই আছে। একজনকে নিজের কান কেটে উপহার দিয়েছিলেন কালজয়ী ডাচ চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগ (Vincent Van Gogh) (১৮৫৩-১৮৯০)। (প্রমিত উচ্চারণে দ্বিতীয় গ’টা উচ্চারিত হয় না)। র্যাচেল নামের যে মহিলাকে তিনি তাঁর কান উপহার দিয়েছিলেন, আগে ভাবা হতো তিনি ছিলেন একজন বারবণিতা। পরবর্তী গবেষণায় জানা গেছে বারবণিতা নয়, তিনি ছিলেন কোনো রূপোজীবীনির মেইড। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, প্রেমিকার জন্য চরম ত্যাগের কোনো নিদর্শন হিসেবে নয়, কুকুরের কামড়ে আহত সেই সহজ সরল পরিচারিকার প্রতি সহানুভূতি জানাতেই নাকি ভ্যান গ’র সেই কর্ণ বিসর্জন। অনেকেই জানেন বিশ্বখ্যাত এই শিল্পীর মানসিক স্বাস্থ্য যথেষ্ট ভালো ছিল না।
ভ্যান গ’র শহর আমস্টারডামে যাওয়া হলো প্রথমবারের মতো। মেয়ের স্কুল ফাইনাল শেষ হওয়ার পর বনানীর বই বিচিত্রা থেকে অগাথা ক্রিস্টির কয়েকটা থ্রিলার কেনার পাশাপাশি কিনে দিয়েছিলাম অ্যান ফ্রাঙ্কের দ্য ডায়েরি অব আ ইয়াং গার্ল। ডায়েরিটা বিচ্ছিন্নভাবে আগে পড়েছি, অখন্ড মনোযোগ দিয়ে পড়া হয়নি। ভাবলাম মেয়ের সুবাদে এবার পড়ে নেবো। তখনো জানা ছিল না, আর কিছুদিন পরেই যে আমস্টারডাম যাওয়ার পরিকল্পনা আমাদের আছে, অ্যান ফ্রাঙ্ক সেই শহরের পলাতক জীবনে লিখেছিলেন তার ডায়েরি। আর বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী রেমব্রান্ট, ভ্যান গগ বা দার্শনিক স্পিনোজার শহরও যে আমস্টারডাম, একটুখানি গুগল করলে তাও জানা হয়ে যায় ।
আমস্টারডাম যে সাইকেলের শহর তা জানা ছিল আগেই। কিন্তু সাইকেলের দুর্দন্ড প্রতাপ এবার দেখলাম স্বচক্ষে। এগারো বারো লক্ষ অধিবাসীর আমস্টারডাম সিটিতে বাই সাইকেল আছে ৯ লক্ষের মতো, এ সংখ্যা ওই শহরের গাড়ির সংখ্যার চারগুণ। বিশ্বের অন্যতম বাইসাইকেল বান্ধব শহর হচ্ছে এটা। অন্যতম বলছি এজন্য যে এরপরও নাকি এটা সাইকেল বান্ধব হিসেবে এক নম্বর নয়; এক নম্বর নেদারল্যান্ডেরই অন্য কোনো শহর। তো এ শহরে পথচারীদের চেয়ে মনে হলো সাইকেল আরোহীদের দাপটই বেশি। গোটা শহরে সাইকেল চলার জন্য যে শ’ চারেক কিলোমিটার পথ নির্ধারিত আছে তাতে পথচারীদের চলতে মানা। কবুল করতে দ্বিধা নেই, ভুল করে দু’য়েকবার একটু -ফাঁকা-পাওয়া সাইকেল ট্র্যাক ধরে হাঁটতে গিয়ে শিকার হয়েছি উদ্যত সাইকেল আরোহীদের বিরক্তির। যে শহরের প্রায় ৬০ শতাংশ লোক সাইকেলে যাতায়াত করে আর যাদের দৈনিক অতিক্রান্ত দূরত্বের পরিমাণ ২০ লক্ষ কিলোমিটার তারা তাদের পথে উটকো পথচারী পেলে বিরক্ত হবেন, এটাই তো স্বাভাবিক।
সাইকেল নিয়ে এমনি আরো কিছু মজার তথ্য জানালেন আমস্টারডামের ক্যানেল ক্রুজের এক ক্যাপ্টেন, লঞ্চে করে খাল পরিভ্রমণের সময়। বললেন, অন্য শহরের লোকজন যেমন নিজেদের গাড়ির বিষয়ে খুব প্যাশনেট থাকে, আমস্টারডামাররা তেমনি প্যাশনেট সাইকেল বিষয়ে। তাদের প্যাশন নিত্য নতুন মডেলের সাইকেলের মালিক হওয়া আর নিজেদের মতো করে সেই সাইকেল সাজানো। সাইকেল পার্কিং এর জন্য আছে প্রায় ৮ হাজার পার্কিং লট । তারপরেও কীভাবে যেন হাজার হাজার সাইকেলের অন্তিম আশ্রয় হয় আমস্টারডামের খালে আর সিটি কর্পোরেশনকে প্রতি বছর বারো থেকে ১৫ হাজার সাইকেল উদ্ধার করতে হয় এর খাল থেকে।
আমস্টারডাম শুধু বাই সাইকেলের শহরই নয়, একই সাথে যে তা খালের শহরও তা অবশ্য জানা ছিল না এ শহরে আসার আগে। ১৬৫টা খাল আছে এ শহরে যা তৈরি হয়েছে সেই সপ্তদশ শতাব্দীতে। খালের মোট দৈর্ঘ ১০০ কিলোমিটার। গতবছর ইতালীর ভেনিসে পানি উপর ভাসা শহর দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম; এবার আমস্টারডামের শিরা-উপশিরার মতো বিস্তৃত খাল দেখে আগের বিস্ময় যেন কিছুটা ম্লান হয়ে গেল। মনে হলো কোনো জায়গার অবস্থান বোঝাতে আমরা যেমন বলি অমুক রাস্তার এতো নম্বর বাড়ি, আমস্টারডামাররা ইচ্ছে করলেই যেন বলতে পারে অমুক খালের এতো নম্বর পাড়। উত্তরের ভেনিস নামে খ্যাত আমস্টারডামে ক্যানেল গুলোর উপর যে সেতু আছে তার মোট সংখ্যা বারো শ’র বেশি। ডাচ শিল্পমনের ছোঁয়া আছে সেতুর রেলিং আর দুপ্রান্তের রকমারি ফুলের বাহারেও। ভেনিসের পানিতে ভাসমান গন্ডোলার জায়গায় এসব খালে আছে ছোট ছোট লঞ্চ আর পেডল বোট ।
ক্যানেল রিং দিয়ে নৌভ্রমনের সময় দৃষ্টিপথে উঁকি মারে হাজার বছরের ডাচ ইতিহাস আর ঐতিহ্য। তীরে দাঁড়ানো টিউলিপের যে ছায়া প্রতিবিম্বিত হয় ক্যানেলের স্বচ্ছ জলে তা মাড়িয়ে কিংবা বাহারি ফুলের অপূর্ব বিন্যাস দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই হাজির হয়েছি অ্যান ফ্রাঙ্কের বাড়ির সামনে । মনে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কুখ্যাত নাৎসি হলোকস্টের শিকার হয়ে এখানেই পলাতক ছিল অ্যান ফ্রাঙ্কের পরিবার আর এই বাড়ির এক কোণায় বসেই সে লিখেছিল তার সাড়া জাগানো দিনলিপি।
ভ্যান গগ, অ্যান ফ্র্যাঙ্ক, সাইকেল, খাল কিংবা ফুলের শহর আমস্টারডাম । শুনেছি এর কুখ্যাতি আছে ড্রাগ ও যৌনতার অবাধ বাণিজ্য নিয়ে। শিল্প আর ফুলপাখি নিয়ে নান্দনিক প্রকৃতির বিপরীতে ওই বৈপরীত্যে আমাদের মতো মানুষের উঁকি না দিলেও চলে। তাই যখন প্রায় হাজার বছরের পুরোনো ওই শহর ছেড়ে রওনা হই অন্য কোনো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে, সংগী করি তার ভালোলাগাটাকেই।
আমস্টারডাম ৪-৫ জুলাই/২০১৭

বাংলাদেশ সময়: ১৭:৪১:১৮ ৮৫৯ বার পঠিত