বাতাসের মধ্যে থাকি বলেই অক্সিজেনের গুরুত্ব কখনো আলাদাভাবে অনুভব করিনা। বাড়ির পাশের পরশির গুরুত্বও ঠিক বোঝা যায় না নৈমিত্তিকতার চাপে। কিন্তু বিদেশ বিভূইয়ে গেলেই বোঝা যায় নিজ দেশের কারুর দেখা পাওয়ার জন্য বা নিজের ভাষা শোনার জন্য মনটা কেমন আকুপাকু করে। বিদেশের পথে ঘাটে চলতে স্বদেশের কাউকে দেখলে কিংবা বাঙলা ভাষায় কাউকে কিছু বলতে শুনলে কাছের মানুষ আপনজনের সান্নিধ্য লাভের সুখ পাই আমি। বিদেশে মনে হয় যে কোনো বাঙ্গালীর অনুভূতিই এরকম।
গতকালের ( ২ জুলাই ২০১৭) প্রোগ্রাম ছিল মিউনিখ থেকে শ’ খানেক মাইল দূরের কয়েকটি টুরিস্ট স্পটে যাওয়া। সকালের ছিটেফোঁটা বৃষ্টির মধ্যে যখন ট্যুর কোম্পানির দোতলা বাসে উঠছি, গুড মর্নিং বলে স্মিতহাসির সাদর সম্ভাষন জানায় চেক-ইন এর দায়িত্বে থাকা ৩৫/৩৬ বছরের মহিলা। দেখেই মনে হয় বেশ হাসিখুশি আর সপ্রতিভ সে। তখনো জানা হয়নি সে-ই আমাদের ট্যুর গাইড, নাম মার্গারেট । চেক ইন এর, মানে বাসে আমাদের উঠানোর, সময় আমাদের টিকেট দেখতে দেখতে মার্গারেট জিজ্ঞেস করে, কোন দেশ থেকে আসছো তোমরা? তারপর একটা ওয়াও বলে জানতে চায়, তোমাদের ভাষায় গুড মর্নিং বলে কীভাবে। বললাম, শুভ সকাল। দুয়েকবার উচ্চারণ করে শিখে নিল, শুভ সকাল।
নিজেদের ছোট্ট বোর্ডিং চিরকুট হাতে নিয়ে আমরা উঠে গেছি দোতলায় নিজেদের সীটে। উপর থেকে শুনি মার্গারেট মাঝেমধ্যেই আগত অন্যান্য টুরিস্টদের গুড মর্নিং বলার পরপরই বলছে, শুভ সকা(ল) ইন বাংলাদেশ ল্যাংগুয়েজ। একজন বিদেশীর মুখে বাঙলা ভাষায় সকালের সম্বোধন শুনে মনটা অন্যরকম ভালোলাগায় ভরে যায়। মনে হয় আজকের ভ্রমণটা ভালোই হবে, বিশেষ করে যে ভ্রমণের গাইড মার্গারেটের মতো মজা-করতে- পারা, হাসিখুশি মহিলা।
বাসের লাউড স্পিকারে শুনি আবার শুনি মার্গারেটের কন্ঠ। নীচের তলা থেকে সে কথা বলে, কন্ঠই শুনি, তাকে দেখি না। এবার আনুষ্ঠানিক সম্ভাষণ। জানায় তার বাসের ড্রাইভারের নাম মিরো, সে তাদের কোম্পানির সবচেয়ে ভালো ড্রাইভারদের একজন। বলে, আমাদের ড্রাইভার এখন পুরোপুরি জেগে আছে এবং আশা করছি আমাদের যাত্রীদের ঘুমের খোয়ারিও ইতোমধ্যে ভেঙ্গে গেছে। তার কথায় বাসশুদ্ধ লোক একসাথে হেসে উঠে। সবাই উপভোগ করে মার্গারেটের সেন্স অব হিউমার। লাউড স্পিকারে আবার মার্গারবটের কন্ঠ, ঝিরঝির বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সবাই চলে এসেছে। তাই আমরাও নির্ধারিত সময়ের ১২ মিনিট আগেই শুরু করছি আমাদের যাত্রা।
মিউনিখ সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশনের পাশের একটা স্টপ থেকে বাস চলতে শুরু করে। মার্গারেটের কন্ঠ শুনি, আমাদের এই ট্যুরে থাইল্যান্ড, ইউকে, বাংলাদেশসহ পনেরো ষোলটি দেশের লোকজন আছে। আজ সকালেই আমি কঠিন একটা শব্দ শিখেছি, বাংলাদেশের ভাষায় সকালের সম্ভাষণ.. শুভ সকা(ল)। ওই ভাষায় তোমাদের আবার বলি, শুভ সকা(ল)। মনে হয় ল’ র উচ্চারণটা সে ইতোমধ্যে ভুলে গেছে। তারপরও কী সুন্দর যে শোনায় মার্গারেটের কন্ঠে শুভ সকাল শব্দ দুটো! বিমোহিত আমরা নিজেদের দিকে তাকাই। এক ধরণের গর্ব অনুভব করি। এতোগুলো মানুষের ভাষা থেকে কাকতালীয়ভাবে আমাদের ভাষাই বেছে নিয়েছে মার্গারেট। গর্বিত বোধ করারই তো কথা, নাকি? আমাদের ভাষার কথাই যে মার্গারেট বলছে তা পাশের সীটে বসা যাত্রীদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। আমাদের মুখের অভিব্যক্তিতেই বোধহয় তা ছিল সুপ্রকাশিত।
সেদিনের ভ্রমণে দেখা হলো পাহাড়ের সবুজ উপত্যকা লিন্ডারহফে বাভারিয়ার রাজা দ্বিতীয় লুডভিখের তৈরি অনিন্দ্য সুন্দর রাজপ্রাসাদ। দেখলাম সমতল থেকে দেড় কিলোমিটার উঁচুতে, পাহাড়শীর্ষে তৈরি বিখ্যাত নিউশোয়ানস্টেইন ক্যাসল যা দেখতে প্রতি বছর আসে ১৫ লক্ষ পর্যটক। দেখা হলো ছবির মতো সুন্দর পাহাড়ি উপত্যকার ছোট্ট শহর ওবারআম্মারগাও, যার মানে হচ্ছে আম্মার নদীর উপর গ্রাম।
অসম্ভব ভালোলাগা নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় ফিরেছি মিউনিখ শহরের হোটেলে। রাত দশটাতেও এখানে দিনের আলো মরে না। সব ভালোলাগাকে ছাপিয়ে মার্গারেটের মুখে শুভ সকালটাকেই যেন মনে হয় দিনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
মিউনিখ থেকে ট্রেনে কোলন যাওয়ার পথে
৩ জুলাই ২০১৭
বাংলাদেশ সময়: ১৯:২৩:২৮ ১৭৭৩ বার পঠিত