বঙ্গ-নিউজঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থবছরের শেষদিকে তাড়াহুড়ো না করে অর্থবছরের শুরু থেকেই উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণের জন্য সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের তৃতীয় বর্ষে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের হার আরও বাড়াতে হবে। অর্থবছরের শেষদিকে তাড়াহুড়ো না করে বছরের শুরু থেকেই বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করুন। ‘
একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ‘ফাস্ট ট্রাক’ ভুক্ত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার জন্যও তাদের আরো আন্তরিক হবার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে প্রকল্পের পেপার ওয়ার্ক সম্পন্ন করুন। আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের প্রয়োজন হলে তা দ্রুত করে ফেলুন। পাশাপাশি কাজের গুণগতমানের সঙ্গে কোনো আপোষ করা যাবে না। ‘ফাস্ট ট্রাক’ ভুক্ত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নির্ধাতি সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার জন্য আরও আন্তরিক হোন। ‘
আজ রবিবার সকালে সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ সভা কক্ষে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবদের নিয়ে অনুষ্ঠিত সচিব সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
সচিবদের সরকারের অন্যতম চালিকাশক্তি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি রাজনৈতিক সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ক্ষমতায় আসে। কিন্তু, সচিবদের আরো অনেক দীর্ঘ সময় ধরে সেবা দেওয়ার সুযোগ থাকে।
তিনি বলেন, ‘কাজেই এটা সচিবদের উপরই নির্ভর করে দেশ কিভাবে চলবে। ‘
শেখ হাসিনা সচিবদের কাজে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, তাঁর দলের রাজনৈতিক দর্শন এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি একটি ভালো দলের সঙ্গে কাজের সুযোগ পেয়েছেন।
উন্নয়ন কর্মসূচি এমনভাবে গ্রহণ করতে হবে যাতে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ উপকৃত হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গ্রাম উন্নয়নের উপর জোর দিতে হবে, কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। যাতে গ্রামের মানুষ কাজের খোঁজে শহরে না আসে। শহরের উপর জনসংখ্যার চাপ যাতে না বাড়ে সে ব্যবস্থা করতে হবে। ‘
প্রধানমন্ত্রী দক্ষ এবং যোগ্যদের গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব প্রদানের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘ভালো কাজের পুরস্কার আর মন্দ কাজের জন্য তিরস্কার ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিন। সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো থেকে সেবা পেতে জনগণকে যাতে ভোগান্তির শিকার না হতে হয় তার উদ্যোগ নিন। ‘
তিনি বেতন-ভাতা বৃদ্ধির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে দুর্নীতি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছে, কর্মচারিদের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। ‘
একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করে সকলের ন্যায়-সঙ্গত পদোন্নতি এবং পদায়ন নিশ্চিত করারও আহ্বান জানান।
তাঁর সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের পর এডিপি’র আকার এবং বাস্তবায়নের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৫-০৬ সালে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ছিল ২৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এবার বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। ৮ বছরে বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৬ দশমিক ২৫ গুণের বেশি।
অপেক্ষাকৃত তরুণ কর্মকর্তা, যাদের আরো দীর্ঘদিন চাকরি করার সুযোগ রয়েছে প্রশিক্ষণে তাদের অগ্রাধিকার প্রদানের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অপেক্ষাকৃত তরুণ কর্মকর্তা যারা দীর্ঘদিন চাকরি করবেন, প্রশিক্ষণে তাদের অগ্রাধিকার দিন। ‘
জাতির পিতা একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ধনী-দরিদ্র্যের বৈষম্য কমানো এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করারও আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন কর্মসূচি এমনভাবে গ্রহণ করতে হবে, যাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ উপকৃত হয়। ‘
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ উচ্ছেদে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির পুনরোল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জঙ্গিবাদ দমন এবং মাদক ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণে মাঠ পর্যায়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিন। এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। ‘
দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের অবস্থানকে সুস্পষ্ট উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের দৃঢ় অবস্থান সুস্পষ্ট । ‘
নাগরিকদের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য একটি ওয়েবভিত্তিক অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা পরীক্ষামূলকভাবে চালুর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ সংশোধন করা হয়েছে। তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এবং জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন ২০১১ প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রণয়ন করা হয়েছে জাতীয় শুদ্ধাচারের কৌশলপত্র। ‘
শেখ হাসিনা বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে মধ্যম আয়ের দেশের উপযোগী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা ‘জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল’ প্রণয়ন করেছি। প্রতিবছর প্রদত্ত বিভিন্ন ভাতার হার ও পরিধি সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের আওতায় প্রকৃত দরিদ্র, ছিন্নমূল পরিবারকে সমিতিবদ্ধ করে ক্ষুদ্র সঞ্চয় মডেলের আওতায় স্থায়ী তহবিল গঠন করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার বঙ্গোসাগরের ১ হাজার ৭৩৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ‘মেরিন প্রটেকটেড এরিয়া’ ঘোষণা করেছে।
তিনি বলেন, বৃক্ষরোপণ, পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে ম্যানগ্রোভ বাগান সৃজন, অংশীদারিত্বমূলক ব্লক বাগান ও স্ট্রিপ বাগান সৃজন করতে হবে।
পরিবেশ সংরক্ষণে সকলকে আন্তরিক হবার আহ্বান জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামসহ পাহাড় ও টিলা অধ্যুষিত এলাকায় পরিবেশ রক্ষাসহ ভূমিধস প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালনে আরও আন্তরিক হতে হবে। এবারের মত মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে চাই না। ‘
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনপ্রতিনিধিদের চিন্তা-চেতনার বাস্তব রূপায়ন ঘটে জনপ্রশাসনের কাজের মাধ্যমে।
তাঁর সরকারের সাফল্যে সন্তোষ প্রকাশ করে এই সাফল্যকে ধরে রাখা এবং উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ওপরও প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বারোপ করেন।
জনগণের ভোগান্তি হ্রাসে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা এবং মামলার জট কমানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ জন্য উচ্চপর্যায়ের মনিটরিং কমিটি গঠন করা যেতে পারে। বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রস্তাব প্রেরণের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় প্রয়োজনীয় উপাত্তসহ লিখিত জবাব যথাসময়ে উপস্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট মামলাসমূহে সরকারি স্বার্থ সুরক্ষায় তৎপর আরও তৎপর হতে হবে। এ লক্ষ্যে অ্যাটর্নি সার্ভিস চালুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে অনুরোধ জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সরকারি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট মামলা জেলা/মন্ত্রণালয়ভিত্তিক মনিটরিংয়ের জন্য সফটওয়্যার ডেভেলপ এবং উচ্চ আদালতের সহকারী/ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলদের জেলা/মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব প্রদানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য আমি আইন ও বিচার বিভাগের সচিবকে অনুরোধ জানাচ্ছি। ‘
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের সাফল্য প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের অর্জন অভূতপূর্ব, যার স্বাক্ষর বহন করছে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কার্যক্রম এবং আর্থ-সামাজিক সূচকসমূহ। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, এসডিজি কৌশলপত্রে আমাদের উন্নয়ন লক্ষ্য এবং লক্ষ্য বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এসব কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নে আপনারা আপনাদের মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করবেন।
কেবল সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নয়, দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে জনকল্যাণে সরকারি কর্মকর্তাদের আত্মনিয়োগের জন্য সহকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
বৈঠকে অন্যান্যর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী এবং প্রেস সচিব ইহসানুল করিম উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯:৫০:৪৮ ৩৪৩ বার পঠিত