ইচ্ছে ছিল মার্চে ইউরোপ যাবো। গত অক্টোবরে ঘুরে আসলেও মার্চ থেকে এপ্রিলে আরো বেশী সময় নিয়ে ঘুরব। অনেক পরিচিত আত্মীয়র সাথে দেখা করা বাকি রয়ে গেছে। তাছাড়া আমার মূল আকর্ষণ ছিল এপ্রিলে নেদারল্যা-ের টিউলিপ ফেস্টিবেল দেখা। আশির দশকে সিলসিলা ছবিতে টিউলিপের সেই মাঠ দেখার পর থেকে সে মাঠে ঘুরে বেড়ানোর খাব মনের মাঝে লেগে রয়েছে।
টিউলিপ ফুল অপরিচিত নয় এখন। বসন্ত এল চারপাশ উজ্জ্বল করে তারা হাসে। আমার বাগানেও নানা রঙের টিউলিপ ফুলের চাষ করেছি তারা হাসে বসন্ত সমিরণে। কঠিন শীতের বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে শরতের সময় বীজ বুনে দেই। প্রতি বছর নতুন করে বাড়ছে আমার জমিতে টিউলিপের বাহারি রঙের হাসি। তারপরও নেদারল্যান্ডের সেই দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ দেখার স্বাধ মনে।
কিন্তু কঠিন বাস্তবতার হাত থেকে ছুটতে পারলাম না। মার্চ এপ্রিল চলে গেলো ঘুরতে যাওয়া হলো না। নেদারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, লন্ডন থেকে ফোন আসতে থাকল আমার যাওয়ার খোঁজ নিতে। পা বাড়িয়ে আছি পারলে এখনি উড়ি, তারপরও বললাম আসা হচ্ছে না। আসতে পারছি না। হয় তো আগামী বছর।
এ বছর কোথাও আর যাওয়া হবে না এমনই একটা ছক কাটা ছিল মাথায়। কিন্তু ভ্রমণে রাজযোটক থাকলে কোন না কোন ভাবে বেরিয়ে পরা হয়।
ছেলে মেয়েদের পরিকল্পনা ছিল বালী যাবে শেষ পর্যন্ত তাদের পরিকল্পনা বদল হলো। ঠিক হলো বালীর জায়গায় বারবেডোস যাবে। সাথে আমাকেও ইনক্লুড করে নিল। চলো চলো সমুদ্র পাড়ে। আরে সমুদ্র নয় মহাসমুদ্র ডাকছে । আটলান্টিক আর ক্যারেবিয়ান সাগরে ঘেরা ওয়েস্ট ইণ্ডিজ দ্বীপ।
দুদিনের প্রস্তুতিতে দশ দিনের জন্য চললাম।
প্লেন সকাল আটটায়। ভোর পাঁচটায় রওনা হয়ে আর্ন্তজাতিক ফ্লাইটের মান অনুযায়ী তিন ঘন্টা সময় হাতে নিয়ে পৌঁছানো হলো না। দু ঘন্টা আগে পৌঁছালাম। চেকিং বোডিং হাতে নিয়ে সিকিউরিটি পার হওয়ার জন্য দাঁড়ালাম। বিশাল লম্বা লাইন। বর্তমান ভয়াবহ সময়ের দূর্যোগ সাধারন জন সাধারনের বেরানো যাওয়ার পাথে পথে কাঁটা হয়ে আছে।
সময়ের কাটা দৌঁড়াচ্ছে আমরা জিলাপীর প্যাঁচের মতন ফিতা দিয়ে ঘেরা জায়গায় ঘুরছি এদিক থেকে ওদিক। শেষ হতে আরো তিন চার সারি বাকি। সে সময় প্লেনের লোক এসে ডেকে নিল। বারবেডোসর সব যাত্রীদের।
যাক দ্রুত পেরুনো গেল এবং অপেক্ষার সময় না কাটিয়েই বিমানে চড়া হলো। এয়ার কানাডার বিশাল বিমানটি ভর্তি যাত্রী উষ্ণতায় হারাতে চলেছে ক্রান্তীয় অঞ্চলে।
আকাশ ঝকঝক করছে রোদের আলোয় নীচে সাদা মেঘের বিশাল বাড়ি গুলো পেরিয়ে উড়ে যাচ্ছে প্লেন আপন মনে। জানলা দিয়ে বাইরে বেশীক্ষণ তাকানো যাচ্ছে না। আলোয় চোখ ধাধিয়ে যায়।
পাঁচ ঘন্টায় বিশাল আটলান্টিকের উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে পেরুনো হলো। তারপর পাওয়া গেল স্থলের দেখা। হুস করে জল পেরিয়ে স্থলের বিমানবন্দরে পা ছোঁয়াল যানখানী। আমরা নেমে এলাম উষ্ণ মাটির কাছে।
ইমিগ্রেশন পেরিয়ে টেক্সি নিয়ে পৌঁছে গেলাম রির্সোটে। দারুণ সাজানো গোছানো পাঁচ তারা রির্সোটের অভ্যর্থনায় পৌঁছাতেই দেখলাম কারা যেন আমাদের ব্যাগ বেগেজ নিয়ে গেল টেক্সি থেকে নামিয়ে। আমাদের অর্ভথনা করে নিয়ে বসাল লবির সাজানো জায়গায়। মার্বেলের কারুকাজ করা মেঝে, টেবিল কাউন্টার ঝাড়বাতি বড়ই মনেহরণ করে সাজানো। তার মাঝে নানারকম অর্কিড আর ফুলের বাহার। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি মিশেছে আকাশের নীলের সাথে দৃষ্টি টেনে নিচ্ছে তার দিকে। মহা সাগরের কলতান ভেসে আসছে। মুগ্ধ হয়ে বসে আছি। এমন সময় জুসের গ্লাস সাজিয়ে দিয়ে গেল সামনে।
কাগজপত্র দেখা শেষে করে আমাদের রুমে নিয়ে গেল একজন সাথে করে। যথাযথ সাজানো রুম দেখিয়ে সব বুঝিয়ে দিল। আমাদের ব্যাগগুলোও নিয়ে এলো একজন।
ঘরের সাজানো সৌন্দর্যের চেয়ে বেশী আকর্ষণ করছে ব্যালকুনি থেকে দেখা প্রকৃতি, নীল সবুজ জলের সমুদ্র, ঘন নীল উজ্জ্বল আকাশ অনেক বেশী ডাক ছিল। ঘরের এসির চেয়ে সমুদ্র তীরের বালু পায়ে মেখে হাঁটার ইচ্ছা তীব্র। পোষাক বদল করে নিচে চলে গেলাম। সমুদ্র এত কাছে তার গায়ে হাত না বুলিয়ে কি দূরে বসে থাকা যায়।
প্রবল গর্জনে ঢেউর পর ঢেউ এসে ভেঙ্গে পরছে ধূয়ে মুছে নিয়ে যাচ্ছে যেন ধরার সব কালিমা। সারি সারি মানুষ শুয়ে আছে আরাম চেয়ারে, রোদের আলোয় গা এলিয়ে। কেউ বই পরছে কেউ ঘুমাচ্ছে। কেউ হয় তো ফোনে চ্যাট করছে ছবি তুলছে। পাশে তিনখানা সুইমিং পুল। সেখানেও চলছে নিজেদের পছন্দে খেলা ধূলা। গা ভিজিয়ে বসে থাকা।
সাগরের তীরে লাল রঙের একটা পতাকা টাঙ্গানো তারমানে এখন ভাটার সময় সাগরে নামা যাবে না। দূরন্ত কিছু মানুষ সব নিষেধ উপেক্ষা করে সারফিং করছে। সাঁতারও কাটছে। কিছু হেঁটে চলে বেড়াছে তীর জুড়ে। বাচ্চারা বানাচ্ছে বালির প্রাসাদ।
হোটেলের সার্ভিং বেয়ারা ট্রে হাতে ঘুরছে। তাতে কখনো ভেজা টাওয়েল, কখনো আইসক্রীম, কখনো পানিও বা ফলের জুস। কখনো বোতল ভর্তি ঠা-াা পানি স্প্রে করে দিচ্ছে রোদের মাঝে পরে থাকা শরীর জুড়ে।
বালুকা বেলার পাশে শুয়ে থাকা শরীর গুলো মানুষের। এখানে নারী পুরুষের কোন পার্থক্য আছে বলে মনে হলো না। সবগুলো শরীরের অধিকারী মানুষ নিজের শরীরে রোদের তাপ বাতাসের ওজন লাগাতে ব্যস্ত। নিজের পছন্দের ছোট ছোট কাপড়ে শরীরের খানিক অঙ্গ ঢাকা। এ যেন প্রকৃতির অংশ হয়ে মিশে আছে মানুষগুলো। সমুদ্রের ঢেউয়ের প্রতি বা নীল আকাশের মেঘের প্রতি বা নারিকেল গাছের ঝিরিঝিরি দোলের প্রতি মানুষের যতটা আগ্রহ মানুষের শরীর যেন এখানে তার চেয়ে অনাগ্রহের বস্তু।
যে যার শরীর নিয়ে পরে আছে অন্য কারো সেদিকে ভ্রক্ষেপ নাই। মানব শরীর যেন প্রকৃতিরই অংশ।
বিষয়টা খুবই উপভোগ করলাম। সাথে বাঁধা নিষেধের প্রলয় মনে পরে কষ্ট পেলাম।
মনে হচ্ছিল কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কথা। যেখানে পুরুষরা ইচ্ছা মতন হাফ প্যান্ট বা জঙ্গিয়া পরে নেমে যায় সমুদ্রে অথচ মহিলারা। একটু খানী পানিতে শাড়ী উঁচু করে ধরে দাঁড়িয়ে সমুদ্র স্নান করে বা সেলোয়ার কামিজের বিশাল বোঝা নিয়ে পানিতে নামে কিছু উৎসাহী মহিলা। ঢলঢলে ঢিলা সেলোয়ার কামিজ কখনো ওড়না নিয়ে যুদ্ধ করতে হয় সমুদ্রের তুমুল স্রোতের সাথে।
যেখানে নিজেকে ধরে রাখাই অনেক সময় কঠিন হয়। ঢেউয়ের তুমুল ধাক্কায় পড়ে গেলে ভেষে যাওয়ার সুযোগ অনেক বেশী। সেখানে সে রিক্স নিয়ে কাপড় সামলাতে সামলাতে মহিলারা সমুদ্র স্নান উপভোগ করেন। কারণ তিনি মানুষের চোখের কাছে নিরাপদ নন। মানুষ তার সমুদ্র স্নানরত নারী শরীর দেখবে আগ্রহ ভরে।
অথচ এখানে মোটা, চিকন, অল্প বয়সি থেকে বুড়া বয়সী নারী পুরুষ, সঙ্গীর সাথে অথবা একা শরীর মেলে দিয়েছে প্রকৃতির কাছে। কেউ তাদের বিরক্ত করছে না।
প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে অনেক ,মানুষই ভালোবাসে। সে ভাবেই তারা উপভোগ করছে জীবন। কেউ তাদেও নিয়ে সমালোজনা করছে না।
এই স্বাধীনতাটুকু ভালো লাগল।
এ শুধু এখানে নয় পৃথিবীতে আরো বহু জায়গা আছে যেখানে মানুষ নিজের ইচ্ছা মতন চলতে পারে। পৃথিবীর অনেক সাগরের পারে লেইকের পাড়ে ন্যূড সৈকত আছে। যেখানে নারী পুরুষ বাচ্চা পরিবার নিজের মতন গা খোলা সময় কাটায়। কাপড় পোষাকের ভাড় খুলে ফেলে তরা প্রকৃতির মতন জীবন যাপনে চলে যায়। এরা কিন্তু কারো আক্রমণের শিকার হয় না। নিজেরাও কাউকে আক্রমণ করে না কখনো। কাপড় বা শরীর দেখানোর কারণে ধর্ষনের যুক্তি এসব জায়গায় টিকে না।
বীচ ছাড়া জাপানে স্প্রিং ওয়াটার খুব প্রসিদ্ধ। সারাদিনের ক্লান্তি মুঝতে মাঝে সাঝে অনেকে খোলা আকাশের তলে স্প্রিং ওয়াটাওের উষ্ণ পানিতে নিজেদেও ডুবিয়ে রাখেন। এসব টাবে নামার সময় কোন কাপড় পরা যাবে না।
খুব হলে একটা রুমাল নেয়া যাবে নিজেকে ঢাকতে। এছাড়া ছোনা বিষয়টিও গ্রীক থেকে ইউরোপ এলাকায় বেশ গুরুত্ত পায়। শীতের প্রকোপ থেকে বাষ্পের গরম ধারায় শরীরকে উষ্ণ করে রক্ত সঞ্চালনের জন্য খুবই ভালো।
আমাদের দেশেও প্রচলিত আছে সমৃদ্ধ মানুষরা রোদে শুয়ে কাজের লোকের হাতে সরিষার তেলের ঢলাইমলাই নেয়া। তবে আমাদের দেশে সব কিছু পুরুষের জন্য সীমাবদ্ধ। মহিলাদের নিয়ে তেমন ভাবা হয় না। যা সত্যি স্বাস্থ্যের উপকার করে। তবে মহিলারা সাজবে। পায়ে আলতা দিবে। চুল বাঁধবে। কাজল দিবে, পুতুল হয়ে থাকবে সে সাজে বাঁধা নেই।
ঘুরে ফিরে পাশের একটি রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। বারবেডসে প্রথম খাওয়া। খাওয়া দাওয়া ভালোই লাগল। আশে পাশে ঘুরে আবারো সমুদ্রের পাশে বসে সময় কাটাতে লাগলাম সূর্যাস্তের মায়ায়।
চলবে…..
বাংলাদেশ সময়: ২১:৫৫:৪৫ ১২৯৭ বার পঠিত