ঈদের ছুটিতে ঢাকাতেই ঢাকা পড়ে আছি। মা যতদিন বেচে ছিলেন, কোনো ঈদ, বিশেষ করে, ঈদ উল ফিতর, গ্রামের বাইরে করেছি বলে মনে পড়ে না। এবার ঈদের লম্বা ছুটি। আমার সময় কাটে বই পড়ে, ইউ টিউবে গান শুনে ছবি দেখে কিংবা অনলাইনে দাবা খেলে।
আমাদের বিল্ডিং এর পাশের খালি জায়গাটা কী এক অদৃশ্য কারণে এখনো মাঠ হয়ে পড়ে আছে। ডেভেলপারদের আলস্য নাকি আদালতের নিষেধাজ্ঞা - কিছু একটা কারণে খালি জায়গাটা, সকাল সন্ধ্যা এখনো মুখরিত হয় শিশুকিশোরদের হৈচৈ এ। ছুটির দিনে ঘুমও ভাঙ্গে ওদের শব্দেই। তারপরও খারাপ লাগে না।
ঢাকার ফ্লাটবাড়ির জীবনে আছেন কিছু ইনভিজিবল প্রতিবেশী, কদাচিৎ যাদের কারুর সাথে কখনো দেখা হয় লিফটে । ম্যাথু আর্নল্ডের ‘ প্রতিটি মানুষই এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ’ - এই বোধ ক্রমশ গেড়ে বসছে এই নাগরিক জীবনে।
আমাদের বেডরুমের বারান্দায় বসে দক্ষিনের খোলা মাঠটাকে সামনে রেখে যখন গোল্ডেন ট্রেজারিতে পড়ি আলেকজান্ডার পোপের কবিতা আলেকজান্ডার সেলকার্ক, যা প্রথম পড়েছিলাম হাই স্কুলের পাঠ্যবইয়ে, তখন এ নাগরিক জীবনে মনুষ্য সঙ্গের জন্য, কোলাহলের জন্য আকুতিটা যেন আরো বেশি পেয়ে বসে।
নগরজীবনের সাথে আমাদের সম্পর্কটা লাভ এন্ড হেইটের। নাগরিক সুবিধাগুলো না পেলে চলে না, আবার নগরের যান্ত্রিকতা, বিচ্ছিন্নতা, বিবিধ দূষন আমাদের ক্লান্ত করে। আমরা, যাদের শেকড় গ্রামে, কখনো নস্টালজিক হয়ে উঠি। নস্টালজিয়ায় রোমান্টিক ভাবনায় জায়গা করে নেন রবি ঠাকুর:
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি,…….
তপোবনের যুগতো কবেই শেষ হয়েছে। ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রামও আছে শুধুই নস্টালজিক রোমন্থনেই। তারপরও ভালো লাগে সেই রোমন্থন।
এতোটুকু অরণ্য কিংবা এতোটুকু সবুজের ছোঁয়ার জন্যই হয়তো স্ত্রী গাছ লাগিয়েছেন বারান্দার টবে কিংবা দক্ষিনের জানালার কার্নিশে। টবের তরুলতার ফাক দিয়ে চোখ খোজে আরো সবুজ, সুবিস্তৃত সবুজ প্রান্তর। কিন্তু ‘লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তরের দূর্লঙ্ঘনীয় দেয়ালের বাইরে আর কিছুই দেখি না।
বারান্দার রকিং চেয়ার। সাইড টেবিলে ঢাউস সাইজের কয়েকটা ঈদ সংখ্যা ম্যাগাজিন। টবের ফুল তরুলতার ফাঁক দিয়ে চোখ যায় সামনের খোলা মাঠে। মাঠের পাশের রাস্তায়, লোক চলাচল মনে হয় পাতলা হয়ে গেছে। ঢাকা থেকে কত্তো মানুষ প্রতি ঈদে ছুটে যায় শিকড়ের টানে। এই উপমহাদেশের দু’য়েকটি দেশ ছাড়া বিশ্বের আর কোন দেশে এমন হয় - আমার জানা নেই।
আমি যে পারিবারিক পরিবেশে বড় হয়েছি সেখানে ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল ঈদ সংখ্যা পত্রিকা। পত্রিকার দোকানে এখন ঈদ সংখ্যার ছড়াছড়ি। সবগুলোই দেখতে ঢাউস সাইজের, সুশোভন। কোনটা রেখে কোনটা কিনি। আগে কিনতাম কোনটায় হুমায়ুন আহমেদ বা প্রিয় অন্য কোনো লেখকের লেখা আছে তা দেখে। এখন সে ধরণের কোনো আকর্ষণ আর বোধ করি না।
বারান্দার চেয়ারে দখিনা আষাঢ়ে বাতাস গা ছুঁয়ে যায়। আমি ঈদ সংখ্যা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাই। নিরিখ করে বোঝার চেষ্টা করি কাইয়ুম চৌধুরী বা ধ্রুব এষের আঁকা প্রচ্ছদের অর্থ। ফুল পাখি নদী নারী বা সবুজের আবহ মনে করিয়ে দেয় গ্রামের কথাই। মন চলে যায় কোন সুদূরে।
ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসা বড় ভাইদের প্যান্টের পকেট হাতড়াতাম খুচরো পয়সার জন্য আর ব্যাগ হাতড়ে বের করতাম কে কোন ঈদ সংখ্যা এনেছে। বিচিত্রা, সন্ধানী, রোববার, স্বদেশ। সিনে ম্যাগাজিন পূর্বাণী ও চিত্রালীর ঈদ সংখ্যাও ছিল দেখার মতো। মনে পড়ে বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায় শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন বা উত্তরের খেপ, সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবানের মতো উপন্যাসগুলো পড়ার কথা। এসএসসি পরীক্ষার বছরে কিশোর বাংলার ঈদ সংখ্যায় ছাপা মুহম্মদ জাফর ইকবালের দীপু নাম্বার টু পড়েছিলাম মা ভাইবোনের চোখ ফাঁকি দিয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় কীভাবে যেন নিজেও হয়ে গিয়েছিলাম ঈদ সংখ্যার লেখক। রোববারে ছাপা হওয়া সে লেখার জন্য সে সময়ের সবচেয়ে বহুল প্রচারিত ইত্তেফাকের শেষ পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপনে ছিল, ‘ মনিরুস সালেহীনের বিশেষ প্রতিবেদন…. ‘। আহ, সে যে কী সুখ, কী আনন্দ। সেগুলোর তুলনায় এখনকার ঈদের আনন্দকে কত ম্লান মনে হয়।
ঈদের জন্য কেনা জীবনের প্রথম রেডিমেড পাঞ্জাবীটা ছিল স্বোপার্জিত। এসএসসি পরীক্ষার পর বন্ধুস্থানীয় কিছু ছাত্রের পীড়াপিড়িতে প্রাইভেট পড়িয়েছি এক মাস। স্কলারশিপের বাইরে নিজের প্রথম উপার্জন ছিল ছাত্র পড়িয়ে পাওয়া সেই টাকা। সে টাকায় ময়মনসিংহ শহরে গিয়ে মা ও বাড়িতে থাকা অন্য দুভাই বোনের জন্য কিছু কেনা, নিজের জন্য পাঞ্জাবী– স্বোপার্জিত স্বাধীনতার স্বাদ ছিল তাতে। সকালের দ্রুতযান ট্রেনে গিয়ে সন্ধ্যার দ্রুতযানে গফরগাঁও স্টেশনে প্রত্যাবর্তন, তারপর খলিল ভাইদের বাসায় রাখা সাইকেলের টুং টাং ঘন্টি বাজিয়ে, হ্যারিকেন জ্বালানো কোনো রিক্সার পেছন পেছন, ব্রহ্মপুত্রের পাড় ধরে বাড়ি ফেরা, হাতে নিজের কেনা ঈদ উপহার। মনের চোখে দেখি কারুকাজ করা রেডিমেড পাঞ্জাবীটার দিকে ঈদের মাঠে কতোজনই না তাকাবে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে.. আহ, আমাদের সন্তানেরা কখনো জানবে না সেই অলৌকিক আনন্দের স্বরূপ!
রবি ঠাকুরের সেই সোনার খাঁচার দিন বা গ্লানিহীন দিনগুলিতে কতো সহজ, কতো সাধারণই না ছিল অসাধারণ ঈদ আনন্দের উপাচারগুলো।
সাধারণ বা অসাধারণ- আপনার উপাচার যাই হোক এবারের ঈদের আনন্দ পরিব্যাপ্ত হোক আপনার জীবনে।
ঈদ মোবারক।
২৫ জুন ২০১৭
বাংলাদেশ সময়: ৩:২৫:৫২ ৬৯৬ বার পঠিত