বঙ্গ-নিউজঃ একাধিক আখ্যানধর্মী ইতিহাস ও ভ্রমণকাহিনিমূলক গ্রন্থ লিখে ইতিমধ্যেই বিশ্বজোড়া পরিচিত নাম উইলিয়াম ডালরিম্পল। এই স্কটিশ সন্তানের লেখালেখির জগতের পুরোটা জুড়েই রয়েছে প্রাচ্যের মানুষ ও তাঁদের সমাজ-ইতিহাস-রাজনীতি। প্রথম প্রথম তিনি শুধু ভ্রমণকাহিনি ও রাজনৈতিক কলামই লিখতেন। সুখপাঠ্য লেখনীর কারণে সেসব বেশ জনপ্রিয়ও হয়। কিন্তু তিনি পরে বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাস বিষয়ে একাধিক বইয়ের রচয়িতা হিসেবে। বিরাটাকৃতির ‘হোয়াইট মোগলস’ ও ‘দ্য লাস্ট মোগল’ গ্রন্থদ্বয় তাঁকে খ্যাতি ও পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে তুলে দেয়। এরপর ভারতবর্ষের বিচিত্র নয় চরিত্র নিয়ে লেখা তাঁর বই ‘নাইন লাইভস’ ও প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ নিয়ে লেখা বই ‘রিটার্ন অফ আ কিং’-ও বেশ সমাদর পেয়েছে। সমালোচকদের কাছ থেকেও গবেষণার গুণের জন্য প্রশংসা লাভ করেছেন তিনি।
তো কী করে উইলিয়াম ডালরিম্পল তাঁর এইসব বৃহদাকৃতির অথচ সুপাঠ্য পুস্তকসমূহ লিখে থাকেন? তাঁর অনুরাগী পাঠকদের মনে এমন প্রশ্ন জাগা অসম্ভব নয়। সম্ভবত এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি তাঁকে প্রায়ই হতে হয় দেখে সম্প্রতি তাঁর লেখালিখির নৈমিত্তিক রুটিন নিয়ে একটি কৌতুহলোদ্দীপক প্রবন্ধ লিখেছেন ডালরিম্পল। সেখানে তিনি জানাচ্ছেন, তাঁর লেখার রুটিন মূলত দুটো। কখন কোনটা বেছে নেবেন, তা নির্ভর করছে “কাগজে কলম বসাচ্ছি কি বসাচ্ছি না তার ওপর”। প্রতি চার বা পাঁচ বছরের সময়সীমায় তিনি মাত্র একটা বইই লেখেন। সেই একটা বই লিখতে সময় লাগে এক বছর। ‘নাইন লাইভস’ লিখতে তাঁর সবচেয়ে কম সময় লেগেছিল, মাত্র নয় মাস। আর সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছিল(সবচেয়ে বেশি খাটনিও হয়েছিল) ‘ফ্রম দ্য হলি মাউন্টেন’ শীর্ষক ভ্রমণকাহিনিমূলক বইটা লিখতে, আঠারো মাস।
ডালরিম্পল বিরাট আকারের ননফিকশন বই লেখার কাজটাকে তুলনা করেছেন চার বছর মেয়াদী বিশ্¦বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে। প্রথম বছরটা হেসেখেলে কাটে। তুলনামূলকভাবে নিতান্তই কম খাটনি যায়। তিনি ওই সময়টায় পাকা বইপড়-য়ার মতো ইচ্ছামতো বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকেন, তা রোম নিয়ে হোক কি করাচি বিষয়েÑ ইচ্ছামতো পড়ে যাওয়াটাই আসল কথা। পড়তে পড়তেই চেষ্টা থাকে পরের বইটা ঠিক কোন বিষয় নিয়ে লিখবেন তা স্থির করে ফেলার। পাশাপাশি চলে লাইব্রেরিতে ঢুঁ মারা আর স্থির করা বিষয়ের ওপর আগে যারা লিখেছেন সেইসব ইতিহাসবিদদের কাছে ইমেইল পাঠানোর কাজ। দ্বিতীয় বছর চলে ওই বিষয়ের ওপর পূর্বে লিখিত তাবৎ বই পাঠ আর সেখান থেকে ‘সেকেন্ডারি সোর্স’ গ্রহণ করা। আর তৃতীয় বছরটা কেটে যায় আর্কাইভ থেকে তথ্য আহরণ করতে করতে। ডালরিম্পল লিখেছেন, আর্কাইভ কাজ করার সময় তাঁর সাথে সবসময়ই ছিল একটি ল্যাপটপ। তা সে দিল্লির ন্যাশনাল আর্কাইভ হোক, কি লাহোরের পাঞ্জাব আর্কাইভ অথবা কাবুলের স্টেট আর্কাইভ। এরপর আসে সেই চতুর্থ বছর, যে সময়ে তিনি গোটা বইটা একেবারে লিখে ফেলতে আরম্ভ করেন।
আর তথ্য সংগ্রহের জন্য দারুণ একটা ‘ফাইলিং সিস্টেম’ তিনি শিখেছিলেন প্রবীণ ঐতিহাসিক অ্যান্থনি বিভেরের থেকে। যে পদ্ধতিকে নাকি রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ের নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সেই পদ্ধতিমতে যথাক্রমে ব্যক্তি, স্থান ও বিষয় সংক্রান্ত তিনটি কার্ড ইনডেক্স তৈরি করতে হবে। আর বইটি লেখা হচ্ছে যে বিষয় বা সময় নিয়ে, সেটাকে একটা গল্পের মতো করে বিন্যাস্ত করবার পর শুরু থেকে শেষ অব্দি সংঘটিত সব ঘটনা ক্রমানুসারে সাজিয়ে একটা ‘টাইমলাইন’ তৈরি করতে হবে, অবশ্যই সব সূত্রের উল্লেখসমেত।
এতসব আয়োজনের পর, ডালরিম্পল জানাচ্ছেন, তিনি লিখতে বসার জন্য পুরোপু্ির প্রস্তুত হন। চারশ পাতা এবারে লিখে ফেলতে তিনি পারবেনই। এটা হয়তো খুব ধীরগতির প্রক্রিয়া, কিন্তু যখন তিনি মনস্থির করেন যে লিখবেনই, তখনই লেখাটা তাঁর মাথায় নাকি চলে আসে। শুধু মগজ থেকে কপি-পেস্ট করে কম্পিউটারে বা কাগজে বসিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা। আর চাই মাথায় আসা লেখাটাকে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় গতির সঙ্গে অক্ষরমালায় মূর্ত করার ক্ষমতা। ডালরিম্পলের মতে, আটঘাট বেঁধে লিখতে বসলে কোনো লেখককে আর ‘রাইটার্স ব্লক’ কাবু করতে পারে না।
বই রচনার প্রক্রিয়ার এই চূড়ান্ত বছরে, তিনি কিছু বিশেষ নিয়ম মেনেও চলেন। যেমন বাইরে খুব একটা দরকার না হলে বেরোন না। বাইরে খেতে একদমই যান না। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠেন। আর ঘুমোবার আগে বইয়ের যে অংশটুকু সেদিন অব্দি লেখা হয়েছে তা প্রিন্ট করে বিছানার পাশে রেখে দেন। ঘুম থেকে উঠবার পর মন যেহেতু তরতাজা ও প্রসন্ন থাকে তাই ওই সময়টায় ছাদে গিয়ে প্রিন্ট করা লেখাটুকু ফের পড়েন। তখনই সেখানে প্রয়োজনীয় সংশোধন-পরিবর্ধন-পরিমার্জন করেন। এইভাবে একটা গোটা অধ্যায় লিখতে সময় লেগে যায় পাক্কা এক মাস। এই এক মাসে গোটা অধ্যায়টাই প্রায় তিরিশবার পরিমার্জনের মধ্যে দিয়ে যায়। তারপর তিনি কাগজে করা সংশোধনী ও পরিবর্তনগুলো ওয়ার্ড প্রসেসরে বসিয়ে ফেলেন। এই কাজ শেষ করে বেরোন প্রাতঃভ্রমণের জন্য। সকালের নাস্তা খান। ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে সাড়ে ন’টাতেই বইয়ের নতুন অংশ লিখতে বসে পড়েন। লিখবার কাজটা একটানা চলে দুপুর দুটো অব্দি। তারপর একটু দেরিতেই দুপুরের খানা খাওয়া। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে মেইল লেখা কি লন্ড্রি থেকে কাপড় দিয়ে গেল কিনা সেই বিষয়ে তদারকি করার মতো সাংসারিক কাজগুলো সেরে নেন ডালরিম্পল। এরপর বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা অব্দি পাণ্ডুলিপি আরো কিছু সম্পাদনা ও বিষয় সম্পর্কে গবেষণা করে ফেলেন। তারপর সেই তখন অব্দি লেখা ম্যাটারটুকুর প্রিন্ট-আউট বের করে বিছানার পাশে রেখে দিয়ে ডিনার খেতে যান। প্রতিদিন অন্তত এক কি দুই হাজার শব্দ লিখবার লক্ষ্য রয়েছে তাঁর। আর রাতে ‘গেম অফ থ্রোন্স’ বা অন্য কোনো সিরিয়াল দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েন।
লেখার কাজে পূর্ণ মনোযোগ দেবার জন্য ডালরিম্পল নিজের ঘরে বসে না লিখে বাড়ির বাগানের শেষ সীমায় অবস্থিত একটা ছাউনির তলায় বসে লেখেন। চমৎকার পরিবেশ ছাড়াও বাগানে বসে লিখবার একটা বড় কারণ হলো ওখানে ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক পৌঁছায় না। ডালরিম্পলের মতে : ইন্টারনেটে বসে থাকলে কখন যে দু ঘন্টা সময় নিমিষে ফুরিয়ে যাবে, কেউ তা টেরও পাবে না। তিনি তাঁর স্যামসাং ট্যাবটিও লেখার সময় একটা ড্রয়ারে তালাবদ্ধ করে রাখেন। ইমেইলও চেক করেন না দুপুর দুটোর আগে। বই লিখতে বসার আগে, যখন শুধুই গবেষণার কাজ করছেন তখন তিন থেকে ছয় ঘন্টা অব্দি অনলাইনে(টুইটার কি ফেসবুকে) থাকলেও লেখা শুরু করবার পর কখনোই দু ঘন্টার বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার তিনি করেন না।
তবে এসব নিয়ম মেনে চলার পাশাপাশি দুটি বিশেষ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তকেও ভালো লেখার মূলসুত্র হিসেবে বিবেচনা করেন উইলিয়াম ডালরিম্পল। প্রথমটি হলো, যতদূর সম্ভব সকালের সময়টুকুকে বাড়িয়ে নিয়ে কাজ করা। অন্তত দুপুর দুটো অব্দি। একদিনে অন্তত নিজের পাণ্ডুলিপির মধ্যে চার ঘন্টা ‘থাকা’ উচিত। আর দ্বিতীয়টি, লেখা শেষ না করা অব্দি মদ্যপান না করা। তাঁর মতে, “যদি আপনি মদ্যপান করেন তাহলে হয়তো অনেক লিখতে পারবেন, কিন্তু পরের দিন যখন পড়বেন তখন দেখবেন যা লিখেছেন তা একেবারে রাবিশ ।” এমনিতে প্রতিদিন ডিনারে তিনি একপাত্র লিখবার সময় একজন অসংলগ্ন ও অগোছালো ব্যক্তি হওয়ার বদলে ‘অত্যাধিক নিয়মানুবর্তী’-ই হতে চান। সবটুকু শক্তি দিয়ে ওয়াইন খেলেও লেখার সময় এই অভ্যাস আর চালু রাখেন না। বরং সাধারণত যেখানে দু কাপ কফি পান করেন, তার জায়গায় চার কাপ কফির দরকার পড়ে। সাথে দু কাপ চা-ও চলে। ডালরিম্পল আরো বলেন, প্রলোভনে পড়ে পথভ্রষ্ট হওয়া সহজ, কিন্তু তিনি পুরো দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চান নিজের কাজের ওপর। লেখক হবার জন্য এই দৃষ্টিনিবদ্ধ করার ক্ষমতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। লিখতে বসার পর পাণ্ডুলিপি যদি লেখককে গ্রাস না করে ফেলে, তাহলে কাজের কাজ কিছু হবে না।
সূত্র : গার্ডিয়ান
বাংলাদেশ সময়: ১:৫৯:৫৩ ৫২৭ বার পঠিত