যাদুঘর আমাকে সবসময়ই খুব টানে। সুযোগ পেলেই ঢু মারি যাদুঘরে, দেশে বা বিদেশে। টানে যে কোনো লাইব্রেরিও। অতীতকে পুনরুজ্জীবিত করায় লাইব্রেরি ও মিউজিয়ামের ঐকতানকে ব্যাখ্যার অবকাশ আছে অল্পই। লাইব্রেরি সম্পর্কে কবিগুরু যেমন বলেছেন - “মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত।”– একই কথা প্রযোজ্য যাদুঘর সম্পর্কেও। কালো অক্ষরের পরিবর্তে মহাকাল এখানে বাধা থাকে অতীতের হাজারো স্মারকে। ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে দেখেছি ডাইনোসরের কংকাল আর ফারাওদের মমি।প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামে দেখেছি ভিঞ্চির মোনা লিসাকে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যাদুঘরে সজীব হয়ে আছে পাকহানাদের নৃশংসতা এবং বাঙালীর গৌরব গাথা। এমনি আরো কত কী। যে কোন মিউজিয়ামের গ্যালারির সামনে দাঁড়ালেই সুদূর অতীত এসে সমুপস্থিত দর্শকের সামনে।
লাইব্রেরি বা মিউজিয়ামের মতো অতীতের আরেক সংরক্ষণশালা আমাদের মন।ইট পাথরের অট্টালিকায় সাজানো মিউজিয়ামের মতো আমাদের মনের অলিন্দে কন্দরেও তিলে তিলে তৈরি হয় আরেক যাদুঘর। পার্থক্য এই যে সে যাদুঘরের দর্শক আমি নিজেই, অন্যের প্রবেশাধিকার সেখানে থাকে না।
কন্যা যখন স্বর্গে যাওয়া ঢেকি কিংবা কলুর বলদ বাগধারার কলুর কথা জিজ্ঞেস করে তখন আমাকে ঢু মারতে হয় নিজের মনের যাদুঘরে। আমি দেখি আমাদের বাড়ির ঢেঁকিঘরের ঢেঁকি তে ধানভানা কিংবা চিড়ে কোটার দৃশ্য। দেখি পাশের গ্রাম আমাটিয়ার কলু পাড়ায় চোখে ঠুলি পড়ে কোনো বলদের তেলের ঘানির পাশে বৃত্তাকারে অবিরাম ঘুরে বেড়ানো। কিন্তু দেখানো হয় না মেয়েকে, ভাষার বর্ণনায় কিংবা ইন্টারনেটের ছবি দেখিয়ে কতটুকুই বা তা বোঝানো যায়!
টাকা আনা পাইয়ের সাথে টাকার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে সেই কবে- এ প্রজন্মের কেউ তা জানেও না। মন সের ছটাক বা তোলার কথা শুনলে আমার ছেলে আমার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন আমি ভিনগ্রহের কোন কিছুর কথা বলছি। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পাল্কির গানের (পালকি চলে!/পালকি চলে!/গগন-তলে/আগুন জ্বলে!/স্তব্ধ গাঁয়ে/আদুল গায়ে/যাচ্ছে কারা/রৌদ্রে সারা!) অনুপম দৃশ্যকল্পটি নিজের কল্পনায় আনতে অনেক কষ্টই হবে এ প্রজন্মের মানুষের। রবি ঠাকুরের বীরপুরুষ কবিতায় পালকিতে চড়া মা’র পাল্কির পর্দা সরিয়ে একটু মুখ বাড়িয়ে থাকার দৃশ্যটিকে এখনকার ছেলেমেয়েদের বোধহয় হ্যারি পটার ছবিতে লন্ডন স্টেশনের থ্রী বাই ফোর নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ছেড়ে যাওয়া হগওয়ার্ট এক্সপ্রেসের চেয়ে বেশি কাছের মনে হয় না।
কিন্তু এ সবই সাজানো মনের যাদুঘরের গ্যালারীতে, পরম যত্নে।
হাতে স্মার্টফোন নিয়ে কিংবা কিছুক্ষণ আগেই ফেসবুকে নিজের সর্বশেষ স্ট্যাটাসটা দিয়ে যখন এই গ্যালারীর সামনে দাঁড়াই তখন নিজেকে খুব ভাগ্যবানই মনে হয়। আমাদের প্রজন্মের মানুষরা যেন দুই কালের সেতুবন্ধ। এক প্রান্তে টরে টক্কা অন্য প্রান্তে স্মার্ট ফোন; একপ্রান্তে ফিলিপস বা সিটিজেন রেডিও, বড়জোর সাদাকালো টিভি, অন্য প্রান্তে থ্রি ডি স্মার্ট টিভি, ইন্টারনেট। দূর দু’ প্রান্তের এমন সেতুবন্ধ তো আমাদের প্রজন্মই।
গফরগাঁও রেলস্টেশনে গাড়ির খবর নেয়ার জন্য সহকারী স্টেশন মাস্টারের ঘরে উকি দিলেই দেখা যেতো বিশাল লকারের মতো এক যন্ত্রের হাতল ঘুরিয়ে কানে টেলিফোন লাগিয়ে রেলকর্মীর সজোর চিৎকার- হ্যা…ল….লো…., ধলা? কিংবা ধাবমান ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা ট্রেনের সমান্তরালে চলা টরে টক্কার টেলিগ্রাফের তার যেখানে দোয়েল ফিঙেরা বসে রোদ পোহাতো শীতের সকালে কিংবা শ্রান্ত অপরাহ্নে বসে মুছতো ডানার রৌদ্রের গন্ধ।
ডাইনোসরের মতো এগুলো হারিয়ে গেছে। কিন্তু আমার মনের যাদুঘরের কিউরেটর সাহেব সযতনেই সেসব সাজিয়ে রেখেছেন মন গ্যালারীতে।
পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের কাহিনীকাব্য নক্সী কাথার মাঠে’র ‘বনগাঁয়েরা ধান কেটে নেয় থাকতে মোরা গফরগায়ে?’ শুনলে কিংবা এ কাব্যগ্রন্থের আখ্যান জানলেই জানা যায় সাজ, গফরগাঁও এর চলতি ভাষায় হাজ, এর কথা। সাজ হচ্ছে জমি বা চর দখলের জন্য দুই পক্ষের মধ্যে পূর্বনির্ধারিত বড় ধরণের সশস্ত্র ঝগড়া বা কাজিয়া (ছোটখাটো যুদ্ধ)। (এরকম একটা সাজেই / কাইজ্যা/ কাজিয়াতে নক্সীকাথার মাঠ এর নায়ক গফরগায়ের রূপাই ছুটে যায় লড়কি-সড়কি হাতে বনগেঁয়োদের প্রতিরোধ করতে। সেখানে লড়াই হয়, কয়েকটি খুন হয় এবং ফলশ্রুতিতে রূপাইয়েরফেরারি হয়ে যাওয়া আর রূপাই সাজুর ট্র্যাজিক বিচ্ছেদ) । বাংলাদেশের কোনো মিউজিয়ামে এ ধরণের গ্রামীন হাজের কোনো থিম্যাটিক সংগ্রহ আছে কী না আমার জানা নেই, কিন্তু তা খুব সজীব হয়েই আছে আমার মন মিউজিয়ামে।
‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে’ ভালোবাসে কম মানুষই। কিন্তু খুব ভালোবেসেই আমি দাঁড়াই মন মিউজিয়ামের গ্যালারীর সামনে। তখন পেছন থেকে কে যেন ফিসফিস করে বলে, দ্যাখো বাপু, এতো কেরদানি কিসের? বাতানুকূল অফিস, বাসা, গাড়ি ছাড়া তোমাদের চলে না,আর দ্যাখো ছয় বেহারার ওই পাল্কিতেই তোমার মা বউ হয়ে এসেছিলেন; দামী ব্র্যান্ডের বডি লোশন ছাড়া তোমাদের এখন রোচে না,কলুর বলদ ঠেলা ঘানির সর্ষে তেলেই কিন্তু সিঞ্চিত হতো তোমার শৈশব শরীর।’
আমার আবারো মনে পড়ে কোন মাটির গভীরে প্রোথিত আমার শেকড়।
কন্যার শেষ পরীক্ষার অপেক্ষার প্রহরে
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র
জুন ৯, ২০১৭
বাংলাদেশ সময়: ১৩:০৩:৩৩ ৫২১ বার পঠিত