বঙ্গ-নিউজঃ সারা শরীরে সিগারেটের আগুনের ছ্যাকা। কোনো কোনোটি ফুলে ফোসকা উঠেছে।
অধিকাংশ ফোসকাই ফেটে দগদগে ঘাঁ হয়েছে। চোঁখের উপরিভাগে নির্যাতনের ফলে চোঁখ ফুলে উঠেছে। ফলে তাকেতেও পারছেন না। দীর্ঘ ১৩ দিন ধরে ঘরে আটকে এই নির্যাতন করা হয়েছে। বরিশালের হিজলা উপজেলা চেয়ারম্যানের ছেলে তার ঘরে আটকে রেখে এই নির্যাতন করেছেন। নির্যাতিত যুবকটি হলেন পাশ্ববর্তী মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার আন্দারমানিক ইউনিয়নের আজিমপুর গ্রামের কামাল হোসেনের ছেলে মো.মোছাদ্দেক। সে ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহ মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হচ্ছেন। ঢাকায় ভর্তি না হওয়ার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যানের ছেলে তন্ময় শিকদার ১৩ দিন আটকে রেখে নির্যাতন করে। এ ব্যাপারে তন্ময়ের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, সার্জারি ১ এর ২৫ নম্বর বেডে সুয়ে আছে মোছাদ্দেক। পুরো শরীরে এতো পরিমাণ আঘাত রয়েছে যা আবৃত করতে চিকিৎসকরাই নিষেধ করেছে। কারণ ইনফেকশন হতে পারে। মোছাদ্দেক এর দুই হাত, দুই পা, পিঠ ও বুকে সিগারেটের আগুনের দেওয়া অসংখ্য ছ্যাকা যা ফোসকার মতো ফুলে রয়েছে। মাথায় কুপিয়ে জখম করার চিহ্ন, পায়ে চাপাতি দিয়ে কোপানোর চিহ্ন, চোখে আঘাতের চিহ্ন ও সমগ্র শরীরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের ক্ষত চিহ্নত রয়েছে।
মো. মোছাদ্দেক নামের ওই শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলা হলে তিনি জানান, হিজলা উপজেলা চেয়ারম্যান সুলতান মাহামুদ শিকদারের ছেলে তন্ময় শিকদার তাকে পহেলা রমজান বাসা থেকে ডেকে নেয়। এরপর
মোটরসাইকেলযোগে তার বাসায় (উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসায়) নিয়ে একটি কক্ষে আটকে রাখে। প্রথম রমজানের দিন রাত থেকেই তার ওপর নির্যাতন শুরু হয়। রাত ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সিগারেটের আগুন দিয়ে তার শরীরে ছ্যাকা দেওয়া হতো। এরপর তন্ময় বাহির থেকে কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে চলে যেত। সারা দিন কক্ষের মধ্যে আটকে রাখা হতো। আর রাতের বেলায় চলতো নির্যাতন।
মোছাদ্দেক আরো জানায়, সিগারেটের আগুন দিয়ে প্রতি রাতে তাকে ছ্যাকা দেওয়া হতো। এরপর চাপাতি দিয়ে কোপাতো, রামদার পেছনের অংশ দিয়ে মাথার ওপর আঘাত করতো, এর পর বলাৎকারও করতো তাকে। পুরো বিষয়টি উপজেলা চেয়ারম্যান সুলতান মাহামুদ সিকদার ও তার পরিবারের সদস্যরা জানতো বলেও সে জানায়।
তার সাথে এমনটি কেন করা হতো জানতে চাইলে মোছাদ্দেক বলে, সে কাউরিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছে এ বছর। তন্ময় ওই স্কুলের হর্তাকর্তা ছিলো। এসএসসি পরীক্ষার পর থেকে তন্ময় তাকে জোরপূর্বক সাথে থাকতে বাধ্য করতো। তখন নির্যাতন করতো না।
তবে এ বিষয়টি মোছাদ্দেক তার বাবার সাথে শেয়ার করলে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর তার বাবা ঢাকার একটি কলেজে তাকে দিয়ে অনলাইনে ভর্তির আবেদন করায়। সে নবাব হাবিবুল্লাহ মডেল কলেজে চান্সও পায়। ফলে তার ঢাকায় চলে যাবার কথা ছিলো দ্বিতীয় রমজানের দিন। বিষয়টি জানতে পেরে প্রথম রমজানেই তাকে আটকে ফেলে তন্ময়। এছাড়া তন্ময় তাকে সিগারেটের আগুনের ছেকা দিতো আর বলতো তুই আমার চাচার পক্ষ হয়ে এসেছিস আমাদের মারতে।
মোছাদ্দেকের দাদী রিজিয়া বেগম জানান, প্রথম রমজান মোছাদ্দেক তাকে ফোন করে বলে সে চেয়ারম্যানপুত্র তন্ময়ের সাথে তার বাড়িতে রয়েছে ফিরবে না। এরপর ওইদিন আর খোজ নেইনি। পরদিন খোজ নিলে একই কথা বলে। এর পর মোছাদ্দেকের ফোন চেয়ারম্যানপুত্র তন্ময় ধরতো। সে বলতো মোছাদ্দেক তার সাথে রয়েছে এখন কথা বলতে পারবে না। বেশ কয়েকদিন এ রকম হলে আমি খোঁজ নেবার জন্য চেয়ারম্যানের বাড়িতে যাই। তখন চেয়ারম্যানের ছেলে আমাকে মারধর করে পাঠিয়ে দেয়। এরপর আমার বাড়িতে হামলা চালায় ও মোছাদ্দেকের দাদাকে মারধর করে। বিষয়টি আমি আমার মেয়ে জামাই ও মোছাদ্দেকের বাবাকে জানাই। এর পর শুক্রবার তাদের নিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়িতে গেলে চেয়ারম্যান সুলতান মাহামুদ শিকদার মোছাদ্দেককে মুমূর্ষ অবস্থায় নিয়ে আসে। তখন সে মূলাদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তাকে চিকিৎসা দিতে বলে এবং বিষয়টি যাতে জানাজানি না হয় বলে দেন। পরে ওইদিন দুপুরে আমরা মোছাদ্দেককে মুলাদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসলে সেখানেও অস্ত্র নিয়ে এসে তন্ময় বাধা দেয়। এর পর শনিবার সকালে শেবাচিমে নিয়ে আসা হয় মোছাদ্দেককে।
মোছাদ্দেকের ফুফা মো. ফজলে করিম বলেন, গতকাল শুক্রবার উপজেলা চেয়ারম্যান সুলতান মাহামুদ এর বাসভবনে গেলে তিনি মোছাদ্দেকের কাছে আমাদের নিয়ে যায়। আমরা গিয়ে দেখি একটি কক্ষের মেঝেতে মোছাদ্দেক অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। চেয়ারম্যান বলেছে- তার ছেলে তাকে আটকে রেখে নির্যাতন করেছে কিন্তু তিনি চেস্টা করেও বন্ধ করতে পারেননি। তবে এখন চিকিৎসার সকল ব্যায় বহন করবে। কিন্তু বিষয়টি পুলিশ এবং মিডিয়া কাউকে না জানানোর জন্য নিষেধ করেছে উপজেলা চেয়ারম্যান। জানালে খারাপ হবে বলে হুমকিও দিয়েছেন।
শেবাচিম হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. সরফুজ্জামান রুবেল বলেন, মোছাদ্দেককে কয়েকদিন আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। পুরো শরীরে ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। কোথাও সিগারেটের আগুনের ছ্যাকা, কোথাও কোপের দাগ আবার কোথাও লোহা দিয়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ওই আঘাতগুলোর কারণে ইনফেকশন হয়েছে। এ কারণে শরীরে প্রচণ্ড জ্বর রয়েছে। তবে চিকিৎসা শুরু করা হয়েছে। ক্রমান্বয়ে সুস্থ হবে।
এ ব্যাপারে হিজলা উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সুলতান মাহামুদ বলেন, মোছাদ্দেক তার ছেলে সাথে থাকতো। প্রায়ই তাদের বাড়িতে আসতো। দুজনের মধ্যে সখ্যতা ছিলো। এ কারণে আমার বাসায় থাকায় সন্দেহ হয়নি। তবে সিগারেটের ছ্যাকা ও কোপের দাগ তার শরীরে কিভাবে আসল তা আমি বলতে পারি না। আমার ছেলে তন্ময়ের সাথে কথা বললেও সে কিছু জানায়নি। তাই মোছাদ্দেক সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বলতে পারব না।
বাংলাদেশ সময়: ১৮:৫৮:২০ ৪৮০ বার পঠিত