“কল্পনা, পাগল এবং পাগলা ভাবনা” (যেতে যেতে পথে- ৫২)-ড. মনিরুস সালেহীন

Home Page » সাহিত্য » “কল্পনা, পাগল এবং পাগলা ভাবনা” (যেতে যেতে পথে- ৫২)-ড. মনিরুস সালেহীন
বুধবার, ৭ জুন ২০১৭



Image may contain: 1 person, outdoorমানসিকভাবে অসুস্থ হওয়া অর্থে পাগল হওয়া যতোই অনাকাঙ্খিত হোক না কেন, পাগলদের প্রতি যে আমাদের একধরণের প্রীতি ও প্রশ্রয় আছে, সেটা নিয়ে বোধহয় কোনো বিতর্ক নেই। বাংলা ভাষায় যে মমতা ও প্রশ্রয়ের সাথের পাগল শব্দটা ব্যবহার করা হয় অন্য কোনো ভাষায় তা আছে কী না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র ‘কোনো এক মাকে’ কবিতায়, “পাগল ছেলে! মা পড়ে আর হাসে” পড়ে কার না ইচ্ছে করে মায়ের অমন পাগল ছেলে হতে? লালনের ‘তিন পাগলে হলো মেলা ন’দেয় এসে’ কিংবা দিলরুবা খানের ‘ও পাগল মন, মনরে’- এসবও বুঝিয়ে দেয় আমাদের পাগলপ্রীতির কথাই।

অবশ্য শেক্সপিয়ার যেভাবে পাগল, প্রেমিক ও কবিকে একসূত্রে গেঁথেছেন, এরপর নিজেকে পাগল ভাবতে অনেকেরই তেমন আপত্তি থাকার কথা নয়। তাঁর ভাষায়, কল্পনার ক্ষেত্রে উন্মাদ, প্রেমিক ও কবি এক সূত্রে গাঁথা ( The lunatic, the lover and the poet/ Are of imagination all compact:)। যদি নিজের কথা বলি, আমার মধ্যে কিঞ্চিৎ কাব্য, বা বৃহদর্থে, সাহিত্য রোগ আছে, আর জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে প্রেমরোগে তো আমরা সবাই কমবেশী আক্রান্ত হয়েছিই। শেক্সপিরীয় যুক্তির বিচারে পাগলের সাথে আমার মিল থাকাটাই তো স্বাভাবিক, নাকি?

মিল কতটুকু আছে তা আমার চেয়ে ভালো বলতে পারবেন আমার পরিপার্শ্বের লোকজন। তবে, মিল থাকুক বা না থাকুক, আমার মধ্যে যে পাগলপ্রীতি আছে এটা জানি বেশ ভাল করেই। হুমায়ুন আহমেদের নাটক উপন্যাসে ঢাকা শহরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রনে ব্যস্ত পাগলদের বেশ দেখা পাওয়া যায়। সেদিন বাঙলা মোটর মোড়ে দেখলাম এমন একজনকে। অবশ্য ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করেও নিশ্চিত হতে পারলাম না লোকটা পাগল নাকি ট্রাফিক পুলিশের সহায়তাকারী কোনো স্বাভাবিক মানুষ। তবে যেটা হলো আমার দেখা বেশ ক’ জন ভালো লাগার পাগল হাজির হলেন আমার ‘ যেতে যেতে পথে’র চিন্তায়। আজ তাদের কয়েক জনের কথাই বলি।

আমাদের পাশের গ্রামের একজন লোক। ছিপছিপে নির্মেদ শরীর, মাথায় কাশফুলের মতো চুল, বাবরী করা। পরনে ফতোয়া। চেহারার মধ্যে এক ধরণের আভিজাত্য। আমার কিশোর বেলায় প্রায় প্রতিদিন দুপুরে বা বিকেলে দেখতাম তিনি বসে আছেন আমাদের গলাকাটা বাজারের কারুর দোকানের বেঞ্চিতে। লোকটাকে সবাই পাগলা অমুক বলেই জানতো। তার পাগলামিটা কী বা কীরকম তা বোঝা যেত অল্পই। আমি যা লক্ষ করেছি তা ছিল কোনো নাম শুনেই বা কাউকে দেখেই তিনি ইতিহাস বা দূর অতীত থেকে টেনে আনতেন অনেক নাম। আমার ডাকনাম টিপু। আমাকে দেখেই বলতেন, হুম টিপু সুলতান। হায়দ্রাবাদের টিপু সুলতান, কোথায় তোমার বন্ধু ফরাসী লালি? আমাদের বন্ধু বকলুকে, যার নাম আসলে ছিল বহুলুল, দেখে বলেছিলেন, উহু, বকলু নয়, বহুলুল। খলিফা হারুন উর রশীদের কাছে তুমিই না বেহেস্ত বিক্রি করতে চেয়েছিলে! কেউ হয়ত কোনো এক হামিদের নাম উচ্চারণ করেছে নিজেদের আলাপচারিতায়। সেটা তার কানে যেতেই তিনি স্বগতোক্তির মতো করে বলছেন, হু হহু, মওলানা হামিদ খান ভাসানী। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য সাড়ে সাত কোটি কম্বল, আমার কম্বল গেল কই, কী ঠিক না? হেসে জিজ্ঞেস করেন পাশে বসে থাকা কাউকে। তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত, সচ্ছল এক পরিবারের সন্তান। আর দশজন পাগলদের নিয়ে যা করা হয়, কেউ তার পিছনে লাগত না। যেন তিনি কোনো আড্ডায় অংশ নিচ্ছেন এভাবে চুপচাপ বসে থাকতেন আর কয়েক মিনিট পরপর একটা হাত দিয়ে নিজের মুখ মুছতেন। কী এক অজ্ঞাত কারণে তিনি আমাকে পছন্দ করতেন। অতি স্বল্পভাষী মানুষটার আচরণে আমার মতো ছোট বয়সী মানুষকে গুরুত্ব দেয়াটা আমার জন্য ছিল বেশ ভালো লাগার। আমিও তাকে পছন্দ করতাম বিশেষ করে কোন নামের সাথে কাকে টেনে সেটা দেখার জন্য।

প্রসংগক্রমে বলি, বিটকেলে, খিটকেলে, বোকা চালাক, ধুরন্ধর, চোর, নানান সাইজের দারোগা, ভবঘুরে, পকেটমার, এবং ভূতপ্রেত ইত্যাদি হাজারো ধরণের মজার চরিত্র আছে মানবজমিন, দূরবীন, পার্থিব বা পারাপার- খ্যাত শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কিশোর গল্প, উপন্যাসে। তাঁর ‘মনোজদের অদ্ভূত বাড়ি’তে আছে শ্রুতিধর ঘোষ নামের এক চরিত্র যার কী না আমাদের উল্লেখিত পাগলের মতোই ‘ এক অভ্যাস, কিছু দেখলে বা শুনলেই তার আর- একটা কিছু মনে পড়ে যায়। কিন্তু ঠিক মনে পড়ে বলাও যায় না। কী যেন একটা মনে আসি আসি করে, কিন্তু আসে না।‘ কী জানি কিঞ্চিৎ পাগলপ্রীতি কিংবা শীর্ষেন্দুর মতো লেখকদের সৃষ্ট উদ্ভট চরিত্রের সাথে অত্যাধিক মেলামেশার কারণেই কী না, আমারো কিছুটা আছে ওই অভ্যাস- একটা কিছু দেখলে অন্য একটা কিছু মনে পড়া। একটা শব্দ থেকে মনের ভেতর জেগে উঠে আরো দশটা শব্দ। অবশ্য, আমার ক্ষেত্রে বাস্তবের এই প্রথম দেখার সাথে মনের ওপর হামলে পড়ে আমার পড়ার জগতের হাজার ঘটনা। আমার এই ধারাবাহিক লেখার পাঠকরা ইতোমধ্যেই নিশ্চয় তার কিছু পরিচয় পেয়েছেন।

ছোটবেলায় আমাদের পাশের গ্রামে ছিলেন একজন মহিলা পাগল-মানে পাগলী। তিনি ছিলেন শিক্ষিত এবং এক সময়ে ধনাঢ্য পরিবারের বউ। অপচয় আর অমিতাচারে সেই পরিবার যখন প্রায় নি:স্ব হয়েছে তখনই নাকি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন তিনি। খুকীদের মতো বেণী দুলিয়ে, কখনো নেচে আবৃত্তি করতেন একটা ইংরেজি চছড়া। যাঁর মুখ থেকে বার বার শুনে আমার জীবনের প্রথম ইংরেজি ছড়া টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার মুখস্থ হয়েছিল তিনি হচ্ছেন অমুক ডাক্তারের বউ, আমাদের পাগলী ভাবী।

একজন পাগল মাঝেমধ্যেই আসতেন আমাদের গলাকাটা বাজারে । শুনেছি গফরগাঁও স্টেশনের আশেপাশেই থাকতেন। মর্জি হলে পা বাড়াতেন আমাদের মতো অজ পাড়াগাঁয়ে। প্যান্ট পরা তাগড়া জোয়ান সেই পাগলের উর্ধাংগ থাকত খালি। কিছুক্ষণ পর পর ছরছতি মাই হো বলে, আশেপাশের লোকজনের পিলে চমকিয়ে প্রচন্ড জোরে থাপ্পড় বসাতেন নিজের বুকে। এখনো চোখ বন্ধ করলে সেই পাগলের ক্রমাগত থাপ্পড়ে কালো হয়ে উঠা বুকটা ভেসে উঠে মনের পর্দায়। ছরছতি মাই হো মানে তখন বুঝতাম না, পরে বুঝেছি স্বরসতী মাই হো। হিন্দুদের বিদ্যার দেবী স্বরসতীকে কতোটুকু তিনি পেয়েছিলেন জানিনা, কিন্তু তার কল্পনায় সেই দেবী থাকত অনুক্ষণ।

কলেজে পড়ার সময় দেখতাম আরেক জন পাগলকে । লোকজন অবশ্য তাঁকে পাগল না বলে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পন্ন বিশেষ কেউ ভাবতো। পাক্কা ছ’ ফুটের বেশি লম্বা, মাথা কামানো, কৃষ্ণ বর্ণের সেই ব্যক্তির নিম্নাংগে থাকতো চটের আবরণ। তাঁর ঋজু ভংগিরত হাঁটা দেখে মনে হতো কোনো গ্রীক ভাস্কর্য হেটে চলছে উদ্যত ভংগিতে। হাটতে হাটতে মনের খেয়ালে উঠে পড়তেন পাশ দিয়ে যাওয়া কোনো খালি বা একজন যাত্রী নিয়ে যাওয়া রিক্সায়। যে রিক্সায় তিনি সওয়ার হয়েছেন কিংবা যে যাত্রীর সাথে তিনি বসেছেন, তারা নিজেদের ভাগ্যবান করতো কোন এক দুর্জ্ঞেয় কারণে। ঘটনাক্রমে বাড়ি থেকে গফরগাঁও আসার পথে তিনি আমার সহযাত্রী হয়েছিলেন একদিন। গফরগাঁও বাজারের দোকানদাররা অপেক্ষা করতো তখন তিনি তাদের দোকান থেকে কিছু একটা, হয়তো কোনো খাবার, তুলে নেবেন। তাঁকে কেউ কখনো কোনো কথা বলতে শুনেছে বলে শুনিনি।

শুনেছি মৃত্যুর পর তাঁর কবর ঘিরে নাকি তৈরি হয়েছে মাজার। এখানেও হয়তো কাজ করেছে ভক্তের কল্পনায় রাঙানো আশাবাদ যে তাঁর দোয়ায় তিনি পার হয়ে যাবেন জগত সংসারের সব বৈতরণী। আসলেই কল্পনা সর্বব্যাপী। আইনস্টাইন যেমনটি বলেছেন, ‘কল্পনাই সব; জীবনের অনাগত সব আকর্ষণের পূর্ব-দর্শন হচ্ছে কল্পনা’( Imagination is everything. It is the preview of life’s coming attractions.)। আর সেই কল্পনা যদি আমাকে একসূত্রে গাঁথে একজন পাগলের সাথে, ক্ষতি কী?আজ যখন ফেলে আসা জীবনের সেই সব প্রিয় পাগলদের কথা ভাবি তাদের জন্য আমার আরো বেশি মায়া হয়, কবি বা প্রেমিকের মতো তারাও কল্পনার সাগরে ভাসতেন, শুধু তাদের কল্পনাটা ছিল একটু বেশী বাস্তববোধ বিবর্জিত, এই যা।

বাংলাদেশ সময়: ১০:৪৯:১২   ৫২৬ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ