মুখ ও মুখোশ আমাদের এক প্রিয় পরিচিত নাম। বাংলা ভাষার প্রথম চলচ্চিত্র হয়েছে এই নামে। কিন্তু ‘সাধু শয়তান’ ছবিতে আবদুল জব্বারের কন্ঠে সেই অবিস্মরনীয় গান- ‘মুখ দেখে ভুল করো না/মুখটা তো নয় মনের আয়না/মানুষের ভেতরে খবর তো কেউ পায় না’- শুনে আমাদের চিন্তাস্রোত ধাক্কা খায় প্রচন্ডভাবে, কোনটা মুখ, আর কোনটা মুখোশ সেই দ্বন্দ্ব আমাদের ভাবিয়ে তোলে। শুধু ভাবনাই নয়, জীবনে প্রতিনিয়ত কতভাবেই পড়তে না মুখ ও মুখোশের গ্যাড়াকলে! অবশ্য অনেক সময় পড়তে হয় নির্দোষ মুখোশও।
মুখ ও মুখোশের ব্যবধান সাধারণভাবে নেতিবাচক। এই ব্যবধানের কালজয়ী শৈল্পিক উচ্চারণ আছে শেক্সপিয়ারের অমর সৃষ্টি ম্যাকবেথ নাটকে। রাজা আসছেন অতিথি হয়ে সদ্য যুদ্ধজয়ী বীর সেনাপতি ম্যাকবেথের বাড়ি। ততোদিনে রাজাকে হত্যা করে নিজে রাজা হওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলেছেন ম্যাকবেথ দম্পতি। রাজা যেন তাদের ষড়যন্ত্র এতোটুকু আঁচ না করতে পারেন সেজন্য লেডি ম্যাকবেথ পরামর্শ দিচ্ছেন ম্যাকবেথকে- ‘তোমার মুখ দেখেই সবাই সবকিছু বুঝে ফেলে…(কিন্তু আজ তোমাকে মনের ভাব লুকোতে হবে মুখের দর্পণে)… মুখ থাকবে নিষ্পাপ ফুলের মতো, কিন্তু তুমি হবে তার নীচে লুকিয়ে থাকা সর্প ( Look like th’ innocent flower,/But be the serpent under ‘t.)’।
কিংবা, ওথেলো নাটকে ইয়াগোর স্বগতোক্তি, আই এম নট, হোয়াট আই এম, শুনে একবারও কি মনে হয়, এমন হাজারো ‘ আমি যা, আমি তা নই’ দিয়েই পরিবেষ্টিত আমাদের চারপাশ। হাহ, আবারো সেই মুখ ও মুখোশের গ্যাড়াকল!
আমরা বা আমাদের অনেকেই যে এক ধরণের খোলসের ভেতর বাস করি, আমাদের মুখটা আসলে মুখ নয়, মুখোশ, তার আরেক কালোত্তীর্ণ শৈল্পিক উপস্থাপন ব্রিটিশ নাট্যকার জেবি প্রিস্টলির কালজয়ী নাটক ” অ্যান ইন্সপেক্টর কলস’ । দেশে দেশে অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বাংলা ভাষায় সিনেমাও হয়েছে একাধিকবার। উত্তম-সুপ্রিয়ার এর অভিনয়ে ‘থানা থেকে আসছি’ নামে। একই নামে পরে সম্ভবত রিমেকও হয়েছে কোলকাতায়। বাংলাদেশে এই গল্পের অসাধারণ মঞ্চ উপস্থাপনা দেখেছিলাম সম্ভবত ১৯৯৫ সালে, বৃটিশ কাউন্সিলে। তৎকালীন মঞ্চ ও টিভির শক্তিমান অভিনেতা জামাল উদ্দীন হোসেনের দেয়া সৌজন্য টিকেটে সস্ত্রীক দেখেছিলাম ” খোলস” নামে প্রিস্টলির রূপান্তরিত গল্পের মঞ্চায়ন।
গল্পটা অসাধারণ। উচ্চবিত্ত পরিবারের আনন্দঘন সান্ধ্য অনুষ্ঠানে হঠাৎ করে হাজির হন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। জানান একজন তরুণীর আত্মহত্যার খবর। ইন্সপেক্টরের জেরার মুখে আর ঘটনা পরম্পরায় বেরিয়ে আসে ওই পরিবারের বাবা, মা, ছেলে মা ও মেয়ের হবু জামাই সবাই কোন না কোনভাবে দায়ী ওই তরুণীর আত্মহত্যার জন্য- বাবা অন্যায়ভাবে তাকে চাকুরিচ্যুত করে, মা সমাজকল্যাণ কেন্দ্র থেকে তার প্রত্যাশিত সহযোগিতার দ্বার রুদ্ধ করে, ছেলে মদ্যপ অবস্থায় মেয়েটিকে ধর্ষণ করে এবং হবু জামাই মেয়েটিকে রক্ষিতার মতো ব্যবহার করে। পরিবারের মেয়েটিই একমাত্র ব্যতিক্রম যে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয় ওই তরুণীর করুণ পরিণতির সাথে। অন্যান্য সদস্যদের খোলসের নিচে থাকা আসল চেহারাটা যখন বেরিয়ে আসে তখন পরবর্তী অবস্থা সামলানোর কথা বলে বিদায় নেন পুলিশ ইন্সপেক্টর।
নিজেদের কুৎসিত আসল চেহারাটা দেখে আর একটা আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার ঘটনায় যখন পরিবারের সবাই নিজেদের আংগুল কামড়াচ্ছে বাবা তখন স্থানীয় থানায় টেলিফোন করে জানেন যে তাদের বাসার আগুন্তুক ইন্সপেক্টরের নামে কোনো ইন্সপেক্টর ওই থানায় নেই। স্বস্তির বিরাট নি:শ্বাস ফেলেন বাবা, ইতোমধ্যে গুমোট হয়ে ওঠা পরিবেশকে হাল্কা করার চেষ্টা করেন এই বলে যে ইন্সপেক্টর ব্যাটা আমাদের বোকা বানিয়ে গেছে। স্বস্তি ফিরে আসে অন্য সবার মধ্যেও, শুধু মেয়েটি বলে, হতে পারে ওই পুলিশ ইন্সপেক্টর ভূয়া। কিন্তু নিজেদের কৃতকর্মের যে পরিচয় আমরা পেয়েছি তাতো আর মিথ্যে নয়!
এই খোলস এর কথা আমার মনে পড়ে মাঝেমধ্যেই। কখনো এমন হয় কোনো ঘটনা ঘটে যা জল পড়া পাতা নড়ার মতো নয় , একেবারে শেকড় উপরে ফেলা ঝড়ের মতো আলোড়ন তোলে আমাদের চেতনায়। তারপর ঝড় হয়তো এক সময় থেমেও যায়। কিন্তু উন্মোচিত করে দিয়ে যায় আমাদের খোলস, খোলসের আড়ালে থাকা দগদগে পচন। ঢাকনা খোলা ম্যানহোল থেকে আমরা আমাদের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখি ঠিকই, কিন্তু জানি ওই পচনের উপর ভনভন করে উড়ছে ডুমো নীল মাছি ।
যেতে যেতে পথে নয়, রমজানে ছুটির দিনে বাসায়
৩ জুন ২০১৭
বাংলাদেশ সময়: ২০:৪৪:০২ ৬৮০ বার পঠিত