বঙ্গ-নিউজঃ সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে সরানো হয়েছে আলোচিত ভাস্কর্যটি। হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দল পবিত্র রমজানের আগেই এটি সরানোর জন্য দাবি জানিয়ে আসছিল। ভাস্কর্য সরানোর ঘটনায় আজ শুক্রবার সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ করেছে কয়েকটি ছাত্রসংগঠন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভাস্কর্য অপসারণের বিষয়টি সরকারের এখতিয়ারে নেই। এটি সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত। পুরো বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে চার বিশিষ্ট নাগরিক।
আমরা এগুলো মেনে নেব? : কামাল লোহানী
এটা তো বিশ্ববিবেককে নাড়া দেবে। কারণ, গোটা পৃথিবীর বিচারের প্রতীক হিসেবে সব উচ্চ আদালতের সামনে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্যটি দাঁড় করানো থাকে। এটি আমাদের এখানেও ছিল। এটাকে সরানোর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছিলেন, এটা ভালো লাগছে না, শাড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর এ ব্যাপারে হেফাজতে ইসলামের চাপের মুখে তিনি বলেছেন, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তিনি কথা বলবেন।
আমার মনে হয়, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলার পর এটাকে সরানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জা ও উদ্বেগের বিষয় যে আমরা কোন পথে চলছি। সাম্প্রদায়িক শক্তি যদি এভাবে আমাদের পদানত করে রাখার চেষ্টা করে এবং ক্ষমতাসীন দল তাদের কাছে নতজানু হয়ে যায়, তাহলে এ দেশের সাধারণ মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতার যে স্লোগান ছিল, সেটাকে আজ জলাঞ্জলি দিয়ে হেফাজতে ইসলামের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বইপত্রে পরিবর্তন করা হচ্ছে।
এর আগে তারা অপরাজেয় বাংলার কথা উঠিয়েছিল। এরপর বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের কথা বলবে। বিমান অফিসের সামনে বলাকার কথা, জয়দেবপুর মোড়ের মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্যের কথা বলবে। আমরা এগুলো মেনে নেব?
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে মানুষগুলো এবং লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে আমরা এগুলো কিছুতেই মেনে নেব না।
কামাল লোহানী : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আপসকামিতার রাজনীতি : সুলতানা কামাল
এ তো বিরাট আপসকামিতার রাজনীতি। আওয়ামী লীগ যে মৌলবাদীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তার একটা অংশ হিসেবে এটা হলো। শুধু তো এটা না, পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন এবং তাদের অন্যান্য দাবির প্রতি আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থন তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। তারা নিজেরাও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের কথা বলছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কোনো না কোনো কারণে তারা একেবারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী যেই চিন্তাভাবনা, কার্যকলাপগুলো রয়েছে, সেটির সঙ্গে একটা আপস করে যাচ্ছে।
সুলতানা কামালসুলতানা কামাল
নারীর হাতে ন্যায়বিচারের একটা দায়িত্ব, একটা ক্ষমতা কিংবা নারী যে ন্যায়বিচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত, অনেক বিষয় এটার সঙ্গে ছিল। একটা মৌলবাদী গোষ্ঠী ভাস্কর্যটি সরানোর দাবিটা তুলেছে এবং প্রধানমন্ত্রী মনে করেছেন তাদের দাবির সঙ্গে তিনিও একমত। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা এবং মৌলবাদীদের যে দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এটা সরানো হলো এর পেছনে রক্ষণশীলতা, পশ্চাৎগামিতা, এগুলোর সঙ্গে একটা আপসের অংশ হিসেবেই পুরো বিষয়টিকে দেখছি।
সুলতানা কামাল : মানবাধিকারকর্মী
সিদ্ধান্ত নিতে হবে শিল্পের বিচারে : নিসার হোসেন
আমার দুটো মতামত। একটা শিল্পের দিক থেকে। আরেকটা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা শক্তির তৎপরতার দিক থেকে। সাম্প্রদায়িকতার শক্তির তৎপরতার দিক দিয়ে আমি অবশ্যই এর বিরোধিতা করি। কিন্তু শিল্পের বিচারে শুধু এটাই নয়, ঢাকা শহরের ৯০ ভাগ ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়া উচিত। এত নিম্নমানের, লজ্জাজনক, কী বলব। আমি একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম ঢাকা শহরের অধিকাংশ সড়কদ্বীপ, রাস্তার ওপরে, রাস্তার মধ্যে, যেসব ভাস্কর্য আছে, অধিকাংশের দিকে তাকানো যায় না, নিম্নমানের, কুরুচিপূর্ণ। তার মানে এই নয় যে ভাস্কর্য থাকবে না।
নিসার হোসেননিসার হোসেন
খুব ভালো একটা কমিটি করে, যাঁরা মানসম্পন্ন শিল্পকর্ম কিছুটা বোঝেন, তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে এবং ভালো শিল্পীদের নির্বাচন করে তাঁদের দিয়ে অবশ্যই প্রতিটি সড়কদ্বীপে ভালো ভাস্কর্য ও শিল্পকর্ম স্থাপন করা উচিত। এটি হচ্ছে শিল্পের জায়গা থেকে। বাংলাদেশে কোথায় ভাস্কর্য থাকবে, কোথায় থাকবে না, এটা যাঁরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন, বাংলাদেশকে মানেন, তাঁরা বলবেন। যারা বাংলাদেশ চায়নি, সেই আলবদর-রাজাকারদের কথার ওপর চলবে নাকি দেশ! তাদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কেন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে? এটা লজ্জাজনক। সরকার সিদ্ধান্ত নেবে ঠিকই, কিন্তু নেবে শিল্পের বিচারে। এখন যেভাবে নেওয়া হচ্ছে, তার তীব্র প্রতিবাদ করি। শিল্পের বিচারে ভালো একটি শিল্পকর্ম এখানে বসানো উচিত।
নিসার হোসেন : ডিন, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সবকিছুর জন্যই অশনি-সংকেত : শাহদীন মালিক
এটি দুটো ধারণার বহিঃপ্রকাশ। প্রথমত, সরকারের সুপ্রিম কোর্টকে নিয়ন্ত্রণ করার ধারাবাহিক চেষ্টার একটি বহিঃপ্রকাশ। দ্বিতীয়ত, সরকার তথাকথিত ধর্মীয় ভোটের কাছে ক্রমাগত নতি স্বীকার করার আরেকটা বহিঃপ্রকাশ। সুপ্রিম কোর্ট নিয়ন্ত্রণ আর ধর্মীয় জুজুর ভয় এই দুটোই আমাদের আইনের শাসন, গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ-কোনো কিছুর জন্যই শুভ নয়। সবকিছুর জন্যই খুবই অশুভ ও অশনি-সংকেত।
বাংলাদেশ সময়: ১৯:২০:৪৩ ৪৪৬ বার পঠিত