বর্ণিল সাজে নারী-পুরুষের ঘরের বাইরে আনন্দযজ্ঞে শুরু হল বঙ্গাব্দ ১৪২৪, যার সূচনায় ডাক এল সংস্কৃতির বার্তা নিয়ে মানুষের কাছে যাওয়ার।
অগ্রগতির বিপরীতে যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে উগ্রপন্থা; শুভবোধের বিপরীতে যখন শোনা যাচ্ছে সাম্প্রদায়িক হুঙ্কার, তখন বাংলার হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক শক্তিকে নতুন করে জাগিয়ে তোলার এই আহ্বান এল।
জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে পহেলা বৈশাখের এই উৎসব বাঙালির ঐকতানের যে সুর বেঁধেছে, তা-ই সবার কাছে নিয়ে যেতে বলা হল।
দেশজুড়ে বৈশাখী উৎসবে অংশ নেওয়া লাল-সাদা শাড়ি, কপালে টিপ, খোপায় ফুলের মালা নিয়ে নারীর বর্ণিল সাজের সঙ্গী পুরুষের পোশাক ও চলায়ও ছিল আনন্দের ছোয়া।
এদিন পুরনো জঞ্জাল সরিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নতুন বছরে দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করে জনগণের কল্যাণ বয়ে আনার শপথ করেছেন খালেদা জিয়া।
শুক্রবার সর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার রমনা বটমূলে সরোদ বাদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নতুন বছর বরণের আনুষ্ঠানিকতা। এরপর দিনভর নাচ-গানসহ নানা আয়োজনে, নানা আঙ্গিকে চলে বর্ষবরণ।
সমাজে সাম্প্রদায়িক অন্ধকারের নতুন সঞ্চার রুখতে আরেক ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের’ ডাক আসে রমনার বটমূল থেকে।
রমনা বটমূলে শুক্রবার বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে গান গাইছেন ছায়ানটের শিল্পীরা।
পাঁচ দশক আগে এই জায়গায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা করা সংগঠন ছায়ানটের সভাপতি সনজীদা খাতুন বলেন, এই সংগ্রাম হবে বাঙালির আত্মপরিচয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আর সত্য ধর্ম নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর সংগ্রাম। অস্ত্র নয়, এই সংগ্রামের হাতিয়ার হবে সংস্কৃতি।এই সংগ্রামে জয়ের জন্য সব জায়গায় কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। সংস্কৃতি কর্মীদের নগরকেন্দ্রিক ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংস্কৃতির বার্তা পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। গান দিয়ে, আবৃত্তি দিয়ে, নাটক দিয়ে বাংলাদেশের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালিত্বের বোধ, দেশপ্রেম এবং সত্য ধর্মের পরিচয়’ সবার কাছে তুলে ধরতে বলেন এই সংস্কৃতিকর্মী।
পাশাপাশি তথ্য-প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়ে সনজীদা খাতুন বলেন, “শুধু ছায়ানাটের কথা বলছি না, সমস্ত সাংস্কৃতিক কর্মীদের, সমস্ত সাংস্কৃতিক সংগঠককে বলছি, তাদের যা কিছু ভালো জিনিস, সেগুলো তারা দিন ইন্টারনেটে। তাতে যা হবে, আমাদের সন্তানরা সব কিছুর নিদর্শন দেখবে। তাতে যেটা সুবিধা হবে, তারা জানবে, বাঙালিরও কিছু দেখাবার মত জিনিস আছে।”
পহেলা বৈশাখে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাগ সংগীতে রমনা বটমূলে শুরু হয় ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।
গান, নাচ, কবিতা আবৃত্তি এবং পালা মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করেন ছায়ানটের শিল্পীরা।রমনার বটমূলে ওই আয়োজন চলার মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শাহবাগ এলাকা ভরে ওঠে পহেলা বৈশাখ উদযাপনকারীদের পদচারণায়। এর পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।
‘আনন্দলোকে মঙ্গল আলোকে বিরাজ সত্যসুন্দর’- এই প্রতিপাদ্য নিয়ে অনুষ্ঠিত মঙ্গল শোভাযাত্রায় এবারও পুরনো সেই ঘোড়া, বিশাল বাঘের মুখ, সমৃদ্ধির প্রতীক হাতি আর টেপা পুতুল থাকলেও তাদের নেতৃত্ব দেয় আঁধার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা নতুন সূর্যমুখ। সূর্যের সেই আলোতেই পুরনো পঙ্কিলতা আর উগ্রবাদের কালোকে রোখার প্রত্যাশা জানান এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা।
বাবার কাঁধে চড়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় এক শিশু।
চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড়-রূপসী বাংলা হোটেল-শাহবাগ-টিএসসি ঘুরে ফের চারুকলার সামনে এসে এই বর্ণিল যাত্রার শেষ হয়।সব বয়সের সব শ্রেণি-পেশার হাজারো মানুষের এই শোভাযাত্রায় সামনে-পেছনে ঢাকের বাদ্যের তালে তালে চলে নৃত্য, হাতে হাতে ছিল বড় আকারের বাহারি মুখোশ।
টেপা পুতুল আর বাঁশের কাঠামোতে মাছ, পাখির মত নানা লোকজ মোটিফে ফুটিয়ে তোলা হয় বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য। সেসব প্রতীক আবার ধারণ করেছে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের চিহ্ন, অমঙ্গলের আঁধার ঘোচানোর প্রত্যয়।
প্রকৃতির প্রতি সচেতনতার প্রতীক হিসেবে গাছ-পাখি-সূর্যের একটি শিল্পকাঠামো ছিল এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায়।
মঙ্গলের আকাঙ্ক্ষায় এই শোভাযাত্রার মূল কাঠামোতে ছিল অনেকগুলো সূর্যের মুখ, যার একপাশে সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত রূপ, অন্যদিকে সূর্যের বিপরীতে অন্ধকার কদাকার রূপ।
মানব মনের অন্তনির্হিত এ দুই রূপ ফুটিয়ে তুলেছে শুভ আর অশুভর চিরায়ত লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি।
শোভাযাত্রার আয়োজক চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, “জঙ্গিবাদের মতো অন্ধকার শক্তির সঙ্গে যারা যুক্ত হচ্ছেন তাদের শুভবুদ্ধির উদয়ের আহ্বান জানানো হচ্ছে এ আয়োজনে। এ শোভাযাত্রা অপশক্তির বিরুদ্ধে এক বড় প্রতিবাদ।”
মঙ্গল শোভাযাত্রা
শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “কুসংস্কার, অন্ধকারাচ্ছন্ন সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী যে অপশক্তি আছে মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে আমরা তাদের নির্মূল কামনা করি। সেই সঙ্গে শান্তি সমৃদ্ধি ও সফলতা কামনা করি। এটা হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল উদ্দেশ্য।“অপশক্তি, সন্ত্রাসীদের নির্মূল করে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাব। সেই এগিয়ে যাওয়া কেউ বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।”
বৈশাখের উৎসবে যোগ দিতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ সাম্প্রতিক সময়ে ‘মাথাচাড়া দেওয়া বিপদের’ বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রত্যাশা জানান।
তিনি বলেন, “সাম্প্রদায়িকতা, পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িক পরিবর্তন ও ভাস্কর্য অপসারণের মতো নতুন বিপদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সেসব দূর করাই হবে আজকের দিনের প্রত্যয়। আশা থাকবে, যথার্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে আমরা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে এগিয়ে যাব।”
শোভাযাত্রাকে ঘিরে র্যা ব ও পুলিশ সদস্যরা নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলেন। তাদের অতি কড়াকড়িতে উৎসব ‘বাধাগ্রস্ত হওয়ায়’ ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বর্ষবরণ উৎসবে এসে এক বিদেশির সেলফি।
স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে আসা বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা তৌফিক হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাম্প্রদায়িক শক্তির নানা হুমকির কারণে আমরা নিরাপত্তা কড়াকড়ি করছি, সেটা ঠিক। কিন্তু এর মাধ্যমে আমরা বৈশাখ উদযাপনকে সঙ্কুচিত করে ফেলছি না তো?”রমনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাড়াও ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রসহ ঢাকার আরও অনেক জায়গায় সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া হয়।
‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানের মধ্য দিয়ে সকালে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শুরু হয় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে। সেখানে দলের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন শেখ হাসিনা। অতিথিদের আপ্যায়িত করা হয় বাঙালির উৎসবের খাবার মোয়া, মুরকি, মুরালি, কদমা, জিলাপি এবং বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি দিয়ে।
নতুন বছরে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে-প্রত্যাশা ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “পুরনো বছরের জঞ্জাল সরিয়ে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাবে। দেশের মানুষ আনন্দলোকে বাস করবে, সুন্দর জীবন পাবে।”
গণভবনে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান
অনুষ্ঠান শেষ হয় ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ গানটির মধ্যে দিয়ে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকেও কণ্ঠ মেলাতে দেখা যায়।বিকালে নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জাসাস আয়োজিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যোগ দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
নতুন বছরে দেশবাসীর কল্যাণ করার শপথ নিতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আজকে প্রয়োজন ঐক্যের, প্রয়োজন শান্তির, প্রয়োজন কল্যাণের। আসুন বাংলা নতুন বছরে আমরা আজকে শপথ করি, দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করব এবং জনগণের কল্যাণ করব।”
দেশের উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র ‘পুনরুদ্ধারে’ জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কারও হস্তক্ষেপ ‘জনগণ মেনে নেবে না’ মন্তব্য করে খালেদা জিয়া বলেন, “বাংলাদেশের অবস্থা দেখে অনেকে এগিয়ে আসতে চায়, অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার জন্য এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের নামে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে দেশকে দুর্বল করার জন্য। বাংলাদেশে যখন ৮ কোটি লোক ছিলো নিজেরা ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল। আজকে ১৬/১৭ কোটি লোক ঐক্যবদ্ধ, তাদের কারোর সাহায্যের প্রয়োজন নাই।
নয়া পল্টনে দলের বর্ষবরণ উৎসবে যোগ দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া
“আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, আমরা সকলকে বন্ধু হিসেবে দেখতে চাই, কিন্তু কেউ যদি আমাদের বন্ধু হয়ে প্রভু হতে চায়, সেটা আমরা কখনো মেনে নেব না, মানব না। কারো প্রভুত্ব বাংলাদেশের মানুষ স্বীকার করবে না।”ঢাকার মতো বিভাগীয় শহরগুলোতে বড় আয়োজনের পাশাপাশি প্রশাসনের উদ্যোগে প্রতিটি জেলা-উপজেলায়ও বর্ষবরণ উৎসব হয় এবার।
চট্টগ্রামে প্রতিবারের মতো চারুকলা ইনস্টিটিউটের আয়োজনে মঙ্গল শোভাযাত্রার পাশাপাশি নববর্ষ বরণের মূল দুই আয়োজন ছিল ডিসি হিল ও সিআরবি শিরিষ তলায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রা
সকাল ১০টায় শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা মেহোদী বাগ কাজীর দেউড়ি ও জামালখান হয়ে সার্সন রোড হয়ে ফের চারুকলা ইনস্টিটিউটে গিয়ে শেষ হয় । শোভাযাত্রায় চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। ঢোল বাজিয়ে নানা রকমের টেপা পুতুল, মুখোশ নিয়ে সবাই আনন্দে মেতে ছিল শোভাযাত্রায়।চট্টগ্রামে বর্ষ বরণের আয়োজনের জন্য আঁকা দেয়ালচিত্র পোড়া মবিল দিয়ে মুছে দেওয়ার পরও কোনো কমতি ছিল না এ আয়োজনে। নতুন করে আবার দেয়ালে এঁকেছেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা।
এই চট্টগ্রামভিত্তিক ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য অপসারণের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন।
চট্টগ্রামে নাচে-গানে বর্ষবরণ
এই প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘আঁধারের অপশক্তির কাছে মাথা না নোয়ানোর শপথ’ হিসেবে বর্ণনা করেন চারুকলা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক জিহান করিম।তিনি বলেন, “একটি কঠিন পরিস্থিতিতে বাংলা নববর্ষকে বরণ করা হচ্ছে। আঁধারের অপশক্তির কোনো জায়গা নেই বাঙালিদের।”
অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে প্রত্যেককে নিজ নিজ জায়গা থেকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ৮:১৫:১৬ ৫৮৮ বার পঠিত