স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর যেদিন জাতীয় সংসদে বিবৃতি দিয়ে দেশের পরিস্থিতি সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে বলে দাবি করেছেন, তার চার দিন পরও বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলার খবর আসছে, মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। গতকাল শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কাছে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে নাগরিক কমিটির নেতা ও গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম উদ্যোক্তা রফিউর রাব্বির ছেল তানভীর মোহাম্মদ তৌকির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে। গত বুধবার বিকেলে বাসা থেকে বের হওয়ার পর সে নিখোঁজ ছিল।তাহলে মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? এর আগে ৪০টি জেলা থেকে জেলা প্রশাসকেরা জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা রোধে এবং নিজেদের নিরাপত্তা চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। তাঁরা কোনো কোনো জায়গায় সেনাবাহিনী মোতায়েনেরও অনুরোধ জানিয়েছেন। নিজের প্রতি মহা-আস্থাশীল সরকার সেসব আমলে নিলে পরিস্থিতি এতখানি নাজুক হতো না।
আর রাজনৈতিক সমস্যা যে কেবল প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে সামাল দেওয়া যায় না, তা আবারও প্রমাণিত হলো। এই সংকটকালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া মহাজোট সরকারের মহানিষ্ক্রিয়তায় দেশবাসী শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায় ঘোষণার পর দলটি যে পরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধভাবে সারা দেশে তাণ্ডব চালিয়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাদের সেই সর্বগ্রাসী তাণ্ডবের হাত থেকে জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় সরকার কী করেছে? ক্ষমতাসীন দলের নেতারই বা কী ভূমিকা পালন করেছেন? যেখানে সরকার পুলিশ বাহিনীর সদস্য, সরকারি কর্মকর্তাদেরই নিরাপত্তা দিতে পারছে না, সেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দেবে কীভাবে? জনগণের প্রতি গণতান্ত্রিক যে দায়িত্ব থাকে, তারা তা যথাযথভাবে পালন করেনি, করার প্রয়োজনও বোধ করছে না। কয়েকটি স্থানে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বেশ কিছু ইউএনও অফিস এবং থানার পুলিশও সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র আক্রমণের শিকার হয়েছে। ঢাকায় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে মন্ত্রীদের অগ্নিবাক্য কিংবা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বুলন্দ আওয়াজ সন্ত্রাসীদের আক্রমণ থেকে অসহায় মানুষকে রক্ষা করতে পারেনি।
গত সপ্তাহের ধ্বংসযজ্ঞ ও সহিংসতার সময় অধিকাংশ স্থানে সরকারি দলের স্থানীয় নেতা, সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা এলাকায় ছিলেন না। জনগণ ভোট দিয়ে তাঁদের কেন নির্বাচিত করেছে? সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদ প্রশাসকদের বেতন-ভাতার জোগান দেয় জনগণ। জনগণের বিপদের সময়ই যদি জনপ্রতিনিধিদের কাছে পাওয়া না যায়, তাহলে তাঁদের থাকার প্রয়োজনটাই বা কী? সরকার যদি মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে না পারে, তাহলে তারাই বা কেন সরকারের ওপর আস্থা রাখবে?
এই চরম দুঃসময়ে জনপ্রতিনিধিদের এলাকায় না থাকার দুটি কারণ থাকতে পারে। এক, প্রতিপক্ষের হামলা মোকাবিলার ক্ষমতা তাঁদের নেই, যে কারণে তাঁরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দুই, এই জনপ্রতিনিধিরা গত চার বছরে এত অন্যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন যে জনগণের পাশে থাকার নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। এর সঙ্গে আছে ক্ষমতাসীন দলটির স্থানীয় পর্যায়ের কর্মীদের মাস্তানি, দুর্নীতিসহ নানা গণবিরোধী কর্মকাণ্ড। আছে সাংগঠনিক বিভক্তি ও বিরোধ।
গতকাল প্রথম আলোয় ইফতেখার মাহমুদ ও কল্যাণ ব্যানার্জির প্রতিবেদনে জানা যায়, সাতক্ষীরা সদর এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ হলেও স্থানীয় সাংসদ জাতীয় পার্টির আবদুল জব্বার এলাকায় আসেননি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, যিনি সাতক্ষীরার আরেকটি আসনের সাংসদ, তিনিও এলকায় না যাওয়ার জন্য সংসদ অধিবেশনের দোহাই দিয়েছেন। তাঁর মতো মন্ত্রী-সাংসদদের অনেকেই নাকি ঢাকা থেকে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস দমনের কাজটি তদারক করছেন। বগুড়া, দিনাজপুর, চট্টগ্রাম বা সাতক্ষীরায় সংঘটিত সন্ত্রাসে আক্রান্ত ও বিপন্ন মানুষকে ঢাকা থেকে রক্ষা করতে চাইছেন মহাজোটের পরাক্রমশালী নেতারা। এটি বোধ হয় ডিজিটাল সরকারের মন্ত্রী-সাংসদদের পক্ষেই সম্ভব।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যখন ধানমন্ডি বা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর অফিসে বসে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে হুংকার ছাড়ছেন, তখন মাঠপর্যায়ের অবস্থা কী? গত মঙ্গলবার শিবগঞ্জে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের হাতে যুবলীগের এক নেতা খুন হয়েছেন। সাতক্ষীরায় আওয়ামী লীগের নেতা নজরুল ইসলাম পাড়া-প্রতিবেশীদের দয়াদক্ষিণায় বেঁচে আছেন। তাঁর ঘরে চুলা জ্বালানোরও অবস্থা নেই। সন্ত্রাসীরা সবকিছু পুড়িয়ে দিয়েছে। অন্যের কাছ থেকে কাপড় ধার করে এনে পরছেন। সাতক্ষীরা সিটি কলেজের প্রভাষক ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এ বি এম মামুনকে যখন ঘাতকেরা টেনেহিঁচড়ে ঘর থেকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা ও জেলা প্রশাসকের কাছে টেলিফোন করেছিলেন সহায়তা চেয়ে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি। তাঁরা ‘চিন্তা কোরো না, কিচ্ছু হবে না’ বলে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। সেই সান্ত্বনা তাঁকে বাঁচাতে পারেনি। এই হলো জনহিতৈষী দলটির নেতা ও গণমুখী সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্ববোধ।
আমাদের ধারণা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংকটের গভীরতা উপলব্ধি না করেই প্রতিটি এলাকায় প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। মনে রাখা দরকার, এটি ১৯৭১ সাল নয় যে প্রতিরোধ কমিটি গঠনের আহ্বান জানালেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা স্বীকার করুন আর নাই করুন, দেশটাকে তাঁরাই দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছেন। সেটি কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে নয়। যাঁরাই সরকারের সমালোচনা করেন, তারাই শত্রু-বুশ সাহেবের এই তত্ত্বে আওয়ামী লীগের নেতারাও বিশ্বাসী। একটি গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্ব সমাজের বিভক্তি ও বৈরিতা কমিয়ে আনা। এর অর্থ এই নয় যে সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে আপস করবে। বিচার অবশ্যই হবে, কিন্তু এই বিচারের সঙ্গে ক্ষমতায় যাওয়ার বা থাকার রাজনীতির হিসাবকে মেলানো যাবে না। জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায় বিরোধীদলীয় নেতার ওপর চাপালে আসল অপরাধীদের ছাড় দেওয়ার একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়। বিএনপি যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করছে কিংবা জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছে। সে জন্য আমরা বিএনপির সমালোচনা অবশ্যই করব। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে উদোর পিন্ডি ভুধোর ঘারে চাপাতে হবে।
যখন দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে, যখন প্রশাসন ও পুলিশ আক্রান্ত হচ্ছে, তখন মাথা গরম না করে ধৈর্য, যুক্তি ও সহনশীলতা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। সরকারের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। দ্বিতীয় কর্তব্য হলো, যারা সন্ত্রাস, লুটপাট ও মানুষ খুনের মতো নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছে, অবিলম্বে তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারে সোপর্দ করা। তাতে এলাকাবাসী ভরসা পাবে। কিন্তু যেকোনো ঘটনার জন্য হাজার হাজার ব্যক্তির নামে মামলা করলে প্রকৃত অপরাধীদের ধরা যেমন কঠিন হয়ে পড়বে, তেমনি পুলিশি বাণিজ্য এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের কমিশন খাওয়ার মওকাও বাড়বে। পত্রিকায় খবর এসেছে, জামায়াতের কাটা গাছ এখন আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের নেতারা ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। তাই বলব, প্রতিরোধ কমিটি না করে সব দলের নেতাদের নিয়ে শান্তি কমিটি করুন, যেমনটি হয়েছে কানসাট, শিবগঞ্জ, বগুড়া ও সিলেটে। সবাইকে সঙ্গে নিয়েই পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। একদিকে সংকট নিরসনে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেবেন, আন্যদিকে সেই দলকে ‘বাংলাদেশে পাকিস্তানের নয়া দালাল’ বলে আখ্যায়িত করবেন-এটি হয় না। বাংলাদেশে থেকে কোনো দল পাকিস্তান বা অন্য যেকোনো দেশের দালালি করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব সরকারেরই।
প্রধানমন্ত্রী শিবিরের তরুণ কর্মীদের প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চয়ই। শিবিরের নেতা-কর্মীদের বোঝাতে হবে, একাত্তরে জামায়াতের যেসব নেতা অপরাধ করেছেন, তাঁদের দায় কেন তরুণেরা নেবে?
একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নিজ দলের নেতা-কর্মীদের সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলে জনগণ আশ্বস্ত হতো। সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধাপরাধের বিচারের পাশাপাশি দলীয় সন্ত্রাস-দুর্নীতি বন্ধ করাও কম জরুরি নয়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
বাংলাদেশ সময়: ১৪:০৭:২৫ ৫০৮ বার পঠিত