সারা বছর পেয়ারা চাষের উন্নত প্রযুক্তি

Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » সারা বছর পেয়ারা চাষের উন্নত প্রযুক্তি
শুক্রবার, ৭ এপ্রিল ২০১৭



Image result for guava fruit

প্রফেসর ড. এমএ রহিম ও ড. শামছুল আলম মিঠু:
পেয়ারা একটি দ্রুত বর্ধনশীল গ্রীষ্মকালীন ফল। বাংলাদেশের সর্বত্রই এ ফল জন্মে থাকে। তবে বাণিজ্যিকভাবে বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, চট্টগ্রাম, ঢাকা, গাজীপুর, কুমিল্লা, মৌলভীবাজার, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি প্রভৃতি এলাকায় এর চাষ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষ হয় এবং এর মোট উৎপাদন ৪৬ হাজার মেট্টিক টন। পেয়ারাকে অনেকে বলে থাকেন ‘গরীবের আপেল’। পেয়ারার গুণাগুণ আপেলের থেকে কোন অংশেই কম নয়। পেয়ারাতে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে থাকে ভিটামিন ‘সি’ যা মানবদেহের গঠন ও বৃদ্ধিতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পেয়ারার গুণ এখানেই শেষ নয়- শিকড়, গাছের বাকল, পাতা এবং অপরিপক্ক ফল কলেরা, আমাশয় ও অন্যান্য পেটের পীড়া নিরাময়ে ভালো কাজ করে। ক্ষত বা ঘাঁতে থেতলানো পাতার প্রলেপ দিলে উপকার পাওয়া যায়। পেয়ারা পাতা চিবালে দাঁেতর ব্যাথা উপশম হয়। পেয়ারা পেকটিনের একটি অন্যতম উৎস। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পেয়ারা থেকে তৈরি হয় সুস্বাদু জ্যাাম, জেলী, শরবত, আচার, আইসক্রীম প্রভৃতি। পেয়ারার পাতা থেকে চা তৈরি করা যায়। পেয়ারা পরিণত হলে কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থাতেই খাওয়া যায়। টাটকা অবস্থায় পরিপক্ক ফল থেকে সালাদ, পুডিং, প্রভৃতি তৈরি করা যায়।

সাধারণতঃ বছরে দুইবার পেয়ারা হয়, একবার বর্ষাকালে ও আরেকবার শীতে। তাছাড়াও সারা বৎসরেই গাছে দু-একটা ফল ধরতে দেখা যায়। বর্ষার সময় ফলন সাধারণতঃ শীত অপেক্ষা অনেক বেশি হয়। তবে বর্ষার সময়কার ফলে জলীয়ভাব বেশি থাকার জন্য মিষ্টতা ও অন্যান্য গুণাগুণ শীতকালের ফলের থেকে অনেকাংশেই কম থাকে। তাছড়াও জলীয় ভাব বেশী থাকার দরুণ পাকা ফল তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়, ফলে বাজারে তেমন দর পাওয়া যায় না। পরীক্ষার সাহায্যে দেখা গেছে, সমস্ত জাতের পেয়ারার ক্ষেত্রেই শীতকালে এর গুণাগুন বেড়ে যায়, রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হয়। ফলের আকৃতি, রং সব দিক থেকেই সুন্দর হওয়ায় এই সময়ে পেয়ারার বাজার দরও খুব ভালো থাকে। পেয়ারার ক্ষেত্রে সারা বছর ফল উৎপাদনের জন্য নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে ফল ধরা নিয়ন্ত্রণ তিনভাবে করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রথমতঃ মৌসুমী ফল উৎপাদনের সময়ে কিছু ফুল ও ফল ছিঁড়ে দিয়ে অমৌসুমী ফল ধরাকে উৎসাহিত করা, দ্বিতীয়ত সার, পানি ও হরমোন প্রয়োগ করা এবং সবশেষে বাঁকানো পদ্ধতি প্রয়োগ করা।

ফল ধরা নিয়ন্ত্রণ
বর্ষাকালের ফলন পুরোপুরিভাবে বন্ধ করতে পারলে বা কমাতে পারলে শীতকালের ফলন অনেকটা বাড়ানো যেতে পারে। এর জন্য সাধারণতঃ বসন্তকালে গাছের চারদিকের মাটি খুঁড়ে শিকড় বের করে দেয়া হয়। এমতাবস্থায় ১০-১৫ দিন রাখার ফলে সমস্ত পাতা হলদে হয়ে ঝড়ে পড়ে। এরপর গাছের গোড়ায় সার দিয়ে সেচ দিতে হয়। ফলে বর্ষার সময় নতুনভাবে ডালপালা ও ফুল ধরে এবং শীতের সময় এই ফল পাকার উপযুক্ত হয়। তাছাড়াও এপ্রিল-মে মাসে সেগুলোকে ছিঁড়ে দিলে বর্ষায় ফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। পরে আগস্ট-অক্টোবর মাসে প্রচুর ফুল আসে এবং শীতের সময় ফলন বেড়ে যায়। তবে এই দুই উপায়েই ফলন নিয়ন্ত্রণ করা খুবই ব্যয়বহুল ও সময়সাধ্য ব্যাপার।

‘হরমোন’ প্রয়োগ
‘হরমোন’ জাতীয় পদার্থ গাছে স্প্রেয়ার যন্ত্রের সাহায্যে স্প্রে করে এপ্রিল-মে মাসের ফুল নষ্ট করে দেয়া যেতে পারে। পরীক্ষায় দেখা গেছে- এপ্রিল-মে মাসে গাছে যখন সবেমাত্র ফুল আসে সেই সময়ে ২, ৪-ডি (১০০ লিটার পানিতে দেড় থেকে ২ গ্রাম) অথবা ন্যাপথেলিন এসিটিক অ্যাসিড (১০০ লিটার পানিতে ১০ ১২ গ্রাম) অথবা ইউরিয়া ১০% ভালো করে ফুলের উপর ছড়িয়ে দিলে শতকরা ৭০ ভাগ ফুল ঝরে পড়ে। এইসব রাসায়নিক দ্রব্যের গুণাগুণে গাছে আগস্ট-অক্টোবর মাসে সাধারণভাবে আসা ফুলের তুলনায় প্রায় ২০০-৩০০ শতাংশ ফুল বেশি আসে। ফলন নিয়ন্ত্রণ না করে সাধারণত এল-৪৯ জাতের পেয়ারা গাছের গড় ফলন হেক্টরপ্রতি বৎসরে ৯৪-১০০ কুইন্টাল পাওয়া যায় (৪-৫ বৎসরের গাছে) আর বিভিন্ন প্রকার হরমোণ প্রয়োগে ফলন বেড়ে দাঁড়ায় হেক্টর প্রতি প্রায় ১১২-১২৮ কুইন্টাল। হরমোণ খুবই সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন হওয়ায়, খুব একটা ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার নয়। হরমোণ প্রয়োগের ফলে শুধু যে শীতকালে বাড়তি ফলন বা মোট আয়ের পরিমাণ বাড়ে তা নয়, ঐ সমস্ত  হরমোণগুলোই ফলের মিষ্টতা, ভিটামিন ‘সি’ প্রভৃতি গুণাগুণ যথেষ্ট পারিমাণে বাড়িয়ে তোলে, এতে বাজারে এই সমস্ত ফলের চাহিদাও একটু বৃদ্ধি পায় (সূত্রঃ উন্নত প্রথায় পেয়ারা চাষ, ২০০৮)।

শাখা-প্রশাখা বাঁকানো পদ্ধতির মাধ্যমে অসময়ে ফল ধারণ
শাখা প্রশাখা নিয়ন্ত্রিত বিন্যাসের মাধ্যমে পেয়ারার অসময়ে/সারা বছর ধরে ফুল ও ফল ধারণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। গাছের বয়স দেড় বছর হতে দুই বছর হলেই এই পদ্ধতি শুরু করা যাবে এবং ৫-৬ বছর পর্যন্ত এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।

সাধারণতঃ বছরে দু’বার এই পদ্ধতিতে পেয়ারার ফুল ও ফল নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে । গ্রীষ্মকালে অর্থাৎ এপ্রিল-জুন মাস পর্যন্ত একবার ডাল টানা বা বাঁকানো হয়। আবার হেমন্তকালে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে দ্বিতীয়বার ডাল বাঁকানো হয়।

ডাল বাঁকানোর ১০-১৫ দিন আগে সার ও পানি দিতে হবে। ডাল বাঁকানোর সময় শাখাটির অগ্রভাগের প্রায় এক-দেড় ফুট মত পাতা ফুল ফল রেখে বাকী অংশের পাতা, ফুল, ফল ও ছোট ডাল কেটে ফেলতে হবে। এইভাবে সব শাখা-প্রশাখা গুলোকে তৈরি করে নেয়া হয়। সূতলী দিয়ে গাছের ডালের মাথায় বেঁধে গাছের শাখা প্রশাখাগুলোকে বেঁকিয়ে মাটির কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়। তারপর ডালটিকে সুতলির সাহায্যে গাছের কা-ের সঙ্গে বেঁধে দেয়া যেতে পারে অথবা মাটিতে খুঁটি পুঁতে খুঁটির সাথেও বেঁধে দেয়া যেতে পারে। গাছের সবকটি ডালকে একইভাবে টেনে বেঁধে দেওয়ার পরে ঠিক ছাতার মত দেখতে লাগে।

গ্রীষ্মকালে ডাল বাঁকানোর ১০-১২ দিন পর নতুন ডাল বেরোতে শুরু করে। নতুন ডাল ১ সে.মি. মত হলে বাঁধন খুলে দেয়া হয়। আবার হেমন্তকালে ডাল বাঁকানো হলে ডাল বাঁকানোর ২০-২৫ দিন পরে নতুন ডাল গজাতে শুরু করে।

সাধারণতঃ ডাল বাঁকানোর ৪৫-৬০ দিন পরে ফুল ধরতে শুরু করে। আরো দেখা গেছে যে নতুন ডালে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ জোড়া পাতার কোলে ফুল আসে। নতুন ডালে ফুল আসার আগে চার জোড়া পাতার বেশি হলে আর ফুল আসে না। অর্থাৎ ডাল বাঁকানো বা টানার ৪-৬ সপ্তাহ অবধি বৃষ্টি বা অতি আর্দ্র আবহাওয়া ক্ষতিকারক।

এটা লক্ষ্য করা গেছে যে ডাল বাঁকানোর পরে যদি বৃষ্টি আসে বা আর্দ্র আবাহাওয়া ৩-৪ দিন থাকে তাহলে নতুন ডালের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে যার ফলে ফুলহীন অঙ্গজ বৃদ্ধি ঘটে।

এইভাবে এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে ডাল বাঁকানো হলে ফল পাকতে শুরু করে অক্টোবর-জানুয়ারি মাসের মধ্যে। আবার সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে ডাল বাঁকানো হলে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসে ফল পাকে। এই সময়ের ফল মিষ্টি হয় ও অন্যান্য সবগুণাগুণ বেশি থাকে। ফলের আকৃতি, রং সুন্দর হওয়ায় এই সময়ে পেয়ারার বাজরদর খুব ভালো থাকে।

চার থেকে পাঁচ বছর এই পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। তারপর থেকে ফলন কমতে থাকে ও সহজে ডাল বাঁকানো যায় না। গাছ লাগানোর ৬-৭ বছর পরে দুই সারি গাছের মধ্যে নতুন গাছ লাগান হয়। এর এক বছর পরে পুরানো গাছগুলিকে কেটে ফেলা হয়।

ফলন
এই পদ্ধতিতে গ্রীষ্মকালে গাছ প্রতি ৬০-৭০ কেজি ফলন ও হেমন্তকালে অবলম্বন করে গাছ প্রতি ৫০-৬০ কেজি ফলন পাওয়া যেতে পারে।

ফল সংগ্রহ
বীজ থেকে তৈরীকৃত গাছে ফল আসতে সময় লাগে চার থেকে পাঁচ বৎসর, অপরদিকে কলম করা আছে দু-তিন বৎসরের মধ্যেই ফল পাওয়া যায়। গাছ লাগানোর পর গাছ বেড়ে ওঠার আগে প্রথম ১-২ বৎসর দুই সারির মাঝে বিভিন্ন রকম সব্জির চাষ করা যেতে পারে। এভাবে কিছু বাড়তি আয়ও হতে পারে।

ফল পাকার সময় ফলের রং সবুজ থেকে ধীরে ধীরে হলদে রং ধারণ করে। পাকা ফল গাছে রাখা সম্ভব হয় না তার কারণ বিভিন্ন প্রকারের পাখী ও বাদুড় অনেক ফল নষ্ট করে দেয়। তাই ফল পাকার ঠিক দুই একদিন আগেই ফল তোলা প্রয়োজন। দূরে চালান দেওয়ার জন্যও একটু কাঁচা অবস্থাতেই পেড়ে চালান দেওয়া ভালো। নিয়মিত সার, সেচ ও অন্যান্য পরিচর্যার অভাবে অবশ্য এই ফলন কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে যেতে পারে।

তথ্য সুত্রঃ AgriNews24.com

বাংলাদেশ সময়: ১১:৪৮:৫৫   ৫৩৬ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

অর্থ ও বানিজ্য’র আরও খবর


অর্থনীতি নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি কমে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ
ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ, সরানো নিয়ে প্রশ্ন
চেক ডিজঅনার মামলার রায় দুই মাসের জন্য স্থগিত
মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসের আড়ালে হুন্ডি, গ্রেপ্তার ৬
১৮ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১০৫ কোটি ৯৯ লাখ ডলার: বাংলাদেশ ব্যাংক
বৈশ্বিক নানা সংকট সত্ত্বেও বাড়লো মাথাপিছু আয়
বাংলাদেশ গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে : মার্টিন রাইজার
আইএমএফ এর সাথে সমঝোতা : সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে
আইএমএফ এর ঋণ গ্রহণ করা হবে নিরাপদ রিজার্ভ গড়ে তোলার জন্য: বাণিজ্যমন্ত্রী
টবগী-১ কূপে পাওয়া যাবে দৈনিক ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস

আর্কাইভ