প্রতিটি বর্ণ আমার স্মৃতির সেলুলয়েড থেকে নেয়া ও সযত্নে লিখছি।
তখন আমার বয়স ১১ বছর ৬ মাস ৪ দিন। আমি তখন সিদ্বেশ্বরী বয়েজ স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়তাম।
————————————————————————————–
স্থানঃ ইস্কাটন গার্ডেন রোড
আবাসস্থলঃ বর্তমান নৌবাহিনী প্রধান এর বাসার সামনে দুটো ৬ তলা ভবন যেগুলো তদানিন্তন পাক মটর্স ও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের মাঝামাঝি জায়গায় এয়ারপোর্ট রোডের উপর (এখনো আছে)
আমরা ঐ ভবনের প্রথমটি ”অফিসার্স হোষ্টেল এর রুম ১ ও ২ অর্থাৎ নীচতলায় থাকতাম।
বাবার পেশাঃ পুলিশ সুপার, স্পেশাল ব্রাঞ্চের এন্টি করাপশান এর ডেপুটি ডাইরেক্টর ও অবসর প্রস্তুতিতে ছিলেন।
বাসার সদস্য সংখ্যাঃ ৭ জন। ৪ ভাই, এক বোন ও বাবা-মা
রাত সাড়ে ৮ টার দিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান টিভিতে ভাষণ দিলেন জাতির উদ্দেশ্যে। জেনারেল টিক্কা খান এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাতেই চলে গেলেন পাকিস্তান।
রাত ১০টার দিকে বা আগে পরে একটা সাদা জীপ এসে এয়ারপোর্ট রোড ও ইস্কাটন গার্ডেন রোডের কোণায় দাড়ালো।
হ্যান্ড মাইকে পাড়ার সব তরুণ ও যুবকদেরকে রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে বললো এবং প্রতিরোধ যুদ্ধ সংগঠন করতে বলে চলে গেল।
বিল্ডিং এর ভেতরে যুবকদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিল।
যে যা পেলো, লোহার রড, বাঁশ, লাঠি নিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকলো।
আমার ৩ ভাই মন্জু, বাবুল ও জালাল, ঐ বিল্ডিং এর আরো গোটা দশেক তরুন যুবক ও ইস্কাটন গার্ডেন কলোনীর আরো কয়েকজন পাক মটর্স এর দিকে দৌড়ে গেল।
তখন জহুরা মার্কেট ছিল ও তার পাশে কয়েকটা কার মেকানিকের গ্যারেজ ছিল। সবাই মিলে একটা অচল গাড়ী ধাক্কা দিয়ে মেইন রোডে এনে ব্যারিকেড দিতে থাকলো। আমি ও আমার বন্ধু আজিজ, খোকন, প্রজিত, বজু ওদের ঐ কাজ দেখছিলাম লুকিয়ে লুকিয়ে, ঠিক তখনকার হোটেল ডেফোডিলস্ এর সামনে থেকে।
একটা প্রাইভেট কার এসে দাড়ালো তাদের সামনে। বাকবিতন্ডা হলো।
হঠাৎ গুলির শব্দ। লুতফর ভাই শহীদ হলেন।
সবাই দৌড়ে বিল্ডিং এ চলে এলো ও ৬ তলার ছাদে উঠে গেলো।
সেখান থেকে তেজগা এয়ারপোর্টের প্লেন উঠানামা দেখা যেতো।
আমাদের চোখ যতদূর যায় দেখলাম বর্তমান সার্ক ফোয়ারা থেকে জাহাঙ্গির গেট পর্যন্ত শুধুই ট্রাকে সাড়ি ও প্রতিটি ট্রাক পাঞ্জাবী সেনায় ভর্তি।
২৩ মার্চ থেকেই ঢাকার অবস্থা ছিল থমথমে। যেকোন সময় যেকোন কিছু হয়ে যাবে এরকম।
রাত এগারোটার আগে পরে আকাশে একটা ফ্লেয়ার নিক্ষেপ করা হলো।
পুরো আকাশ আলোকিত হওয়ার সাথে সাথে শুরু হলো গুলির বৃষ্টি। সেই সাথে শত শত ট্রাক, ট্যাঙ্ক, সাজোয়া বহর, ভারী অস্ত্রে সজ্জিত জীপ ঢাকার এই এয়ারপোর্ট রোড ধরে বের হয়ে এলো। বেশীরভাগ শাহবাগ এর দিকে চলে গেল।
ছাদ থেকে এসব দেখে ও ভাইদের ধমক খেয়ে নীচে নেমে এলাম। গুলি চলছে। কোনভাবে বাসায় এসে বাবা-মা ও বোনসহ বিছানার নীচে। সেখানেই সারারাত ছিলাম।
সারারাত ভাইরা বাইরে ছিল। বিছানার নীচ থেকেই অবিরত গুলি, মর্টার, ট্যাঙ্কের গোলার আওয়াজে কান তালা লেগে যাচ্ছিল।
মনে হচ্ছিল আমাদেরকেও মেরে ফেলবে।
সারারাত ৫ সেকেন্ডের জন্য গুলি থামেনি। কাওরান বাজারে বোমাবর্ষণ হয়। রমনার জয়কালি মন্দির, শহীদ মিনার ও সাকুরার পেছনে ‘দ্য পিপল্’ অফিস ট্যাঙ্কের গোলায় উড়িয়ে দেয়া হয়। সেই ভারী শব্দে বারবার যেন মরে গিয়ে আবার জীবন ফেরত পাচ্ছিলাম।
২৬/৩/৭১ আর ২৭/৩/৭১ এর কথা না হয় কাল পরশু লিখবো।
বাংলাদেশ সময়: ৬:২০:৩২ ৫৪২ বার পঠিত