পি.আর. প্ল্যাসিড : আমি ফেসবুকপ্রিয় হয়ে উঠেছিলাম, যার জন্য তার নাম পাখি। আবার এই ফেসবুক ছাড়তেও চেয়েছিলাম পাখির বেশামাল বিচরণের জন্য। এই বেশামাল বিচরণের কারণে পাখিকে কয়েকবার আল্টিমেটাম দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমার কাজ করলে ফেসবুক ছাড়তে হবে, আর ফেসবুক রাখলে কিছু ফ্রেন্ড বাদ দিতে হবে। পাখি এ আল্টিমেটাম উপেক্ষা করে তার কিছু হাবিজাবি বন্ধু নিয়ে ফ্রেন্ডলিস্ট বড় করে রেখেছে। শুধু তাই নয়, আমি বুঝতে পেরেছি সে অনেকের সঙ্গেই সময়-অসময় চ্যাট করে সময় কাটায়। এসব নিয়ে একবার ভেবেছিলাম পাখিকে বাদ দেব, আবার ভাবলাম সামাজিক এ সাইট ফেসবুক ছেড়ে দেব। কিন্তু ছাড়তে আর পারিনি কোনোটিই। যখন মনে হলো এক পাখি চলে গেলে যা, থাকলেও তা, চাইলে আরও পাখি এসে ভিড় করবে। আর এসব পাখি আমার জন্য কষ্টের কারণ হবে না, এমনও হতে পারেÑ ওরা আমার জন্য তথ্য সংগ্রহের এক বাহক হিসেবে কাজ করতে পারে। আমি যে চিন্তা করেছি, তাই হয়েছে। আমার আগের সেই পাখিকে বাদ না দিলেও আমার লিস্টে অনেক পাখি এসেছে, ওরা সব ক্রিয়েটিভ মাইন্ডের। ওদের ক্রিয়েটিভিটি দেখে আমার খুব ভালো লাগে। যা ছিল না আমার আগের সেই পাখির মধ্যে। নতুন পাখিগুলো আমাকে সংবাদ দেয়, দেয় গল্প, কবিতা কিংবা ভালো কোনো উপাদান, যা নিয়ে আমার লেখা আরও ভালো হয়। সেই পাখিদের জন্য আমি ফেসবুক আর ছাড়িনি, ছাড়িনি বলতে ছাড়তে পারিনি। পুরান পাখিকে আমি এখনও ছাড়িনি, রয়ে গেছে আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। কাউকে বাদ দেওয়া আমার ইচ্ছা নয়। বরং পরিবর্তন করে ভালো পথে আনতে পারাই আমার উদ্দেশ্য। একদিন অবশ্য পাখিকে বলেই ফেলেছিলাম, তুমি তো ক্রিয়েটর না, ব্রেকার। এতে সে খুব কষ্ট পেয়েছিল জানি। কিন্তু সত্য বলেছি বই মিথ্যা নয়।
ফেসবুকও যেহেতু আর ছাড়িনি তাই না ছাড়ার কারণে আমার যে লাভ হয়েছে তা অনেকদিন আগে দেখা টেলিভিশনের একটি ধারাবাহিক নাটকের কয়েক মিনিটের একটি ফুটেজ নতুন করে আবার দেখার সুযোগ। সদ্য প্রয়াত দুই বাংলার জনপ্রিয় লেখক নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের লেখা বহুব্রীহি নাটকের ছোট্ট একটি অংশ আমাকে শেয়ার করেছিল এক বন্ধু। অনেক আগে দেখা সেই নাটকের কাহিনী আমি ভুলে গিয়েছিলাম। তাই ফুটেজে কী থাকতে পারে তা স্মরণ করে দেখার জন্য প্লে করলাম। দেখতে দেখতে হঠাৎ দেখি নাটকের এক জায়গায় একটি টিয়া বলে উঠেছেÑ ‘তুই রাজাকার’। আর এই ‘তুই রাজাকার’ কথাটি শুনে একজন অভিনেতার গায়ে আগুন ধরে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো।
টিয়ার মুখে ‘তুই রাজাকার’ কথাটি শুনে সত্যি আমি থমকে গিয়েছিলাম। এরপর কয়েকবার ফুটেজটি টেনে টেনে দেখলাম। কয়েকবার দেখার পর একা একাই খুব হাসলাম। মনে হয়েছিল এই হাসি শেয়ার করার জন্য কাউকে দরকার। কিন্তু কাকে শেয়ার করতে পারি, ভেবে পাচ্ছিলাম না। পাখির সঙ্গে আমার ফেসবুকে অ্যাড নেই। থাকলে শেয়ার করতে পারতাম। পাখি আমাকে অ্যাড না করার দুঃখে অনেকবারই তার সঙ্গে আমার রাগারাগির মতো বাজে এক ঘটনা ঘটিয়েছি। যা কাম্য ছিল না। ভিডিওটি শেয়ার করতে না পেরে পূর্বের রাগারাগির সেকথা মনে করে পরক্ষণেই শেয়ার করে দিলাম থাইওর (জুনিয়র প্ল্যাসিড) ‘আমি বাঙালি’ একাউন্টে। এতে মন কিছুটা হলেও শান্ত হলো। একজন নতুন প্রজš§ বাঙালির একাউন্টে শেয়ার করতে পেরে। এরপর থেকে আমি প্রতিদিন একবার অন্তত ফুটেজটি দেখি। এ পর্যন্ত আমার মনে হয় ভিডিও ফুটেজটি কয়েকশবার দেখেছি।
ভিডিও ফুটেজটি দেখার সময় বারবার আমি লেখক-নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের এ অকল্পনীয় সেরা সৃষ্টির কথা ভাবতে চেষ্টা করেছি। আজ থেকে বহুদিন আগে হুমায়ূন আহমেদ যখন এ বহুব্রীহি নাটক লিখেছেন, তখন ইচ্ছা করলেই একজন রাজাকারকে রাজাকার বলার সৎসাহস অনেকেই করতে বা দেখাতে পারেননি। যে কারণে লেখক হুমায়ূন আহমেদ নিজেও বলতে না পেরে একটি পাখিকে দিয়ে কথাটি বলিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের দ্বারা অনুপ্রাণীত হয়ে পাকিস্তানি আর্মিদের হাতেই নাকি লেখক হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফাইজুর রহমান আহমেদ নিহত হয়েছিলেন। বর্তমানে হুমায়ূন আহমেদরা তিন ভাই বাংলাদেশে খুব আলোচিত, পরিচিত আর খ্যাতিমান। তিনজন ইচ্ছা করলেই পারতেন এ রাজাকারপ্রীতি নিয়ে বা রাজাকারদের প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে। তাঁরা কিন্তু তা করেননি, হয়তো কোনো কারণে করতে পারেননি। যেমনটি সৎ সাহস নিয়ে হাজার, লাখ, কোটি বাঙালিকে জাগ্রত করেছিলেন শহীদ রুমির মাতা জাহানারা ইমাম। তিনি বিচার চেয়েছিলেন রাজাকারদের, যারা যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী তাদের বিচার ও শাস্তি দাবি করেছিলেন জনতার কাঠগড়া তৈরি করে। বিচার বা শাস্তি তিনি দেখে যেতে না পারলেও প্রদীপ তিনি জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন এ আন্দোলনের। আজকে শ্রদ্ধেয়া জাহানারা ইমাম নেই, নেই হুমায়ূন আহমেদও। তার পরও তাদের দুজনকে মানুষ আজ স্মরণ করছে বরণীয় হিসেবে। জাহানারা ইমাম যেই আন্দোলনের শুরু করে গিয়েছিলেন, আজ ঢাকার প্রজš§ চত্বরে তার বিস্ফোরণ ঘটেছে। সারা বাংলার বাঙালি জাতি জেগেছে আজ সেই শহীদ রুমির মা জাহানারা ইমামের চাওয়াটার বাস্তব রূপদান করতে। আর হুমায়ূন আহমেদ যে কথাটি বলতে পারেননি জীবনের ভয়ে কিংবা অন্য কোনো কারণে, সেটি বলিয়েছিলেন তার পাখিকে দিয়ে নাটকে। যেই পাখি এখন মানুষের মনকে শক্ত করছে, জাগ্রত করছে ওদের (রাজাকার) ঘৃণা করতে। পাখির মুখ দিয়ে বলানো সেই দুটি শব্দের কী শক্তি, যা এখন একটি এটম বোমার চেয়েও মনে হচ্ছে ভয়াবহ।
ঢাকা শহরের কোথাও যদি আজ অ্যাটম বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, তাহলে গোটা ঢাকা শহর ধ্বংস হয়ে যাবে, কিন্তু টিয়া পাখির মুখ দিয়ে যা উচ্চারিত হচ্ছে তা গোটা পৃথিবীর বাঙালিকে চোখে আঙুল দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে তোমরা পারোনি, আমি পেরেছি, যা কিনা অ্যাটম বোমার চেয়েও শক্তিশালী। এখন বাঙালি লজ্জায় হলেও পাখির মুখে এই ‘তুই রাজাকার’ কথাটি শুনে মনে মনে বলতে চাইছে ‘তুই রাজাকার’। যদিও কারো ধারেকাছেই এখন আর রাজাকার নেই। তার পরও বলতে চাইছে। এ যে নতুন জাগরণ। নতুন করে প্রতিবাদের ঝড়।
হুমায়ূন আহমেদ প্রমাণ করে দিলেন মাত্র সাতদিনের মধ্যে পাখিকে কথা বলানো সম্ভব। এ লেখা যখন শুরু করি তখন আমাকে একজন বললেন, তিনি নাকি দুদিনেই পাখিকে কথা বলাতে পারেন। কিন্তু একজন মানুষকে দিয়ে বিয়াল্লিশ বছরেও বলানো সম্ভব হয়নি একথাটি, যে কথাটি পাখি বলছে।
নাটকের মেয়েটি বললেন, ‘কী আশ্চর্য, পাখি কথা বলছে। আহারে! আরে স্যার শুনতে পেলেন না।’ সত্যি কী আশ্চর্য, নাটকের ডায়ালগের মতই মিলে গেল, আহারে স্যার শুনতে পেলেন না, বাংলার মানুষ এখন জেগেছে। বাঙালি নির্ভয়ে এখন রাজাকারকে বলতে পারছেÑ ‘তুই রাজাকার’। এখন আর পাখিকে দিয়ে বলাতে হবে না। স্যার যদি থাকতেন কতই না খুশি হতেন। আমি একজন বাঙালি হয়ে, একজন মুক্তিযোদ্ধার ভাই হয়ে বলতে পারি, অনেক দেরি হলেও রাজাকারকে রাজাকার বলার সময় হয়েছে। রাজাকার যেই দলেই থাকুক না কেন, যেই মুখোশ পরেই থাকুক না কেন, অপরাধ যদি স্বাধীনতা যুদ্ধে করেই থাকে বিচার তার করতেই হবে। বিচারের রায় অনুযায়ী শাস্তি তাকে দিতেই হবে। এর বিকল্প অন্য কিছুই আর ভাবা ঠিক হবে না। এ প্রসঙ্গে একটা কথাই বলতে পারি, কানার (অন্ধ) হাতে লাঠি দিতে নেই। প্রয়োজনে কষ্ট হলেও কানা বা অন্ধকে পথ দেখিয়ে দেওয়া অধিকতর ভালো। তা না হলে কানা বা অন্ধ যদি কোনো কারণে ক্ষিপ্ত হয় সেই লাঠি দিয়ে আপনাকেও (লাঠিদাতা) আঘাত করতে পারে।
শুরুতে আমি আমার পাখি প্রসঙ্গে বলছিলাম, কিছুদিন আগে পাখি বলেছিলÑ আমরা বন্ধুরা মিলে শাহবাগ প্রজš§ চত্বরে যাব দেখতে। পাখির সেই দেখতে শব্দটা শুনে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। যেই প্রজš§ চত্বর মাতিয়ে রেখেছে লাকী আক্তার নামের একটি মেয়ে, যে মেয়েটি জাগিয়ে তুলেছে পুরো বাঙালি জাতিকে। যেই জাতি আবার যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে, সেই লাকী আক্তারের বয়সও পাখিরই সমান। আমি কষ্ট পেলাম এই জন্য যে, পাখি যাবে তার বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে আর দেখতে। সেখানে গিয়ে হয়তো কিছু সময় বসবে ওরা পাশাপাশি, বসে বাদাম খাবে আর হাসাহাসি করবে। এর বাইরে দেখতে যাওয়া ঘুরতে যাওয়া পাখিদের আর কি করণীয় থাকতে পারে সেই প্রজš§ চত্বরে?। পাখিকে আমি যতই বলি, তুমি অন্য দশটা পাখির মতো না। তোমাকে অনেক কিছু বুঝেশুনে করতে হবে। মানুষের জন্য ভাবতে হবে, করতে হবে। তোমার ভাবনা আর কাজ দিয়ে মানুষ তোমাকে আলাদা করবে। নাটকের সেই দুটি মরা পাখির মতো যেন ফেলে দিতে না হয়। আমি চাই পাখিকে গড়ে তুলতে। কিন্তু পাখির ইচ্ছা আর অনিচ্ছার কাছে সময় সময় আমি খুব অসহায় হয়ে পড়ি। না পারি কিছু বলতে, না পারি সইতে। মনে হয় পাখি কিনা আবার ওদেরই পক্ষের লোক, তাই বলতেও আর মন চায় না।
মাঝে মাঝে নাটকের মতোই রাগে দুঃখে বলতে ইচ্ছা হয়Ñ আমার এই পাখি যেন মাকাল ফল। তার পরও আমার বিশ্বাস, ধৈর্য ধরেও চেষ্টা করলে পাখি আমার কথা শুনবে। তাই চেষ্টা করে যাচ্ছি পাখিকে আমার কথা শোনার জন্য। আমার কথা মানার জন্য। দেখি পাখি আমার বদলায় কিনা? ইচ্ছে হয় পাখিকে বলিÑ পাখি, তুমি কথা কও, সকলেই শুনুক তোমার সেই কথা।
লেখক : জাপান প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক।
বাংলাদেশ সময়: ১১:২৫:১৭ ৬৪৯ বার পঠিত