সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী মহামহিম ও একক সৃষ্টিকর্তা আপন ইচ্ছায় সৃষ্টি করেছেন অনন্ত এক মহাজগত। তাতে তিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং এই গ্রহকে মনুষ্যবাসের উপযুক্ত করে এতে তিনিই মানুষকে বিচরণের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন।
মানুষকে তিনি চিন্তাশীল জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষকেই শুধু জ্ঞান চর্চার ও জ্ঞান ধারণের ক্ষমতা দান করেছেন। জীব হিসেবে মানুষ সৃষ্টিতেই কেবল আমাদের সৃষ্টিকর্তা
‘শরীরের সাথে মন ও আত্মা’র সমন্বয় ঘটিয়েছেন।
আমাদের জানা মতে, অন্য কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি বলেই, সমগ্র প্রাণীকুল ও অনন্ত এই সৃষ্টি-জগতের মধ্যে ‘মানুষ’ই শ্রেষ্ঠত্বের আসন দখল করে নিয়েছে।
সৃষ্টিকর্তাকে বুঝার জন্যেই তিনি (সৃষ্টিকর্তা নিজে) মানুষের মধ্যে চিন্তা করার এবং বুদ্ধি খাটিয়ে বিচার-বিবেচনা করার ক্ষমতা দিয়েছেন।
তা নইলে তো সৃষ্টিকর্তা নিজেই অপ্রকাশিত থেকে যান!
তাঁর সীমাহীন ক্ষমতা, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র থেকে অতি-বৃহৎ সৃষ্টির চমৎকারিত্ব, রহস্যপূর্ণ নানা সৃষ্টির সৌন্দর্য-কারুকাজ ও বৈজ্ঞানিক সমাহার- এইসব বুঝার জন্যে, বিবেচনা করার জন্যে ও বিমোহিত হয়ে প্রশংসা করার জন্যে জ্ঞান ও ধীশক্তি কেবল মানুষকেই দেয়া হয়েছে!
স্রষ্টা ছিলেন অপ্রকাশিত।
মানুষ সৃষ্টির মাধ্যমেই তিনি নিজের রূপকে প্রকাশ করলেন। এর ফল হলো এইঃ সৃষ্টিকর্তা, যিনি আমাদের দৃশ্যমান এবং দৃষ্টির অগোচরের সকল কিছুই সৃষ্টি করেছেন, আল্লাহ-গড-ঈশ্বর-ভগবান-সৃষ্টিকর্তা বা অন্যকিছু, যে নামেই তাঁকে ডাকা হোক না কেন,
‘তিনি কি?’
‘কী তাঁর ক্ষমতা?’
‘কত গভীর, কত বিশাল ও রহস্যময় তাঁর সৃষ্টি?’
- এসব বিষয় নিয়ে সেই অনাদিকাল থেকেই মানুষ চিন্তা করেছে এবং বুঝতে চেষ্টা করেছে। এতে মানুষের আচার-আচরণ প্রভাবিত হয়েছে এবং সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কিত কর্মকান্ড আচরিত ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
নানা দেশের, নানা বর্ণের, নানা ভাষার ও পরিবেশের মানুষ হরেক রকম আচার ও কৃষ্টির সমন্বয় ঘটিয়ে সমগ্র মানবতার চাদরকে এক বর্ণিল টাপেস্ট্রিতে রূপান্তরিত করেছে!
(টাপেস্ট্রীঃ নানা বর্ণের সুতা বা তন্তু দিয়ে সুক্ষ্ম কারুকাজে ভরা চাদর বা দেয়াল-কার্পেট, যাতে কোন কাহিনী বা উপাখ্যানকে ফুটিয়ে তোলা হয়।)
এই মানুষই আবার প্রধান প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যেও নানা দল-উপদলে বিভাজিত হয়ে এই বর্ণিলতার ভেতর আরো ব্যাপকতার সুষমা সংযোজন করেছে।
সৃষ্টিকর্তাও হয়তো এভাবেই চেয়েছেন!
যেভাবে তিনি একই মানব জাতিকে নানা পার্থক্যের মধ্যে সংস্থাপন করেছেন বিভিন্ন প্রকার গায়ের রঙ, আকৃতি, আচরণ, পরিবেশ ও প্রতিবেশের মাধ্যমে।
একক সৃষ্টিকর্তার এই পৃথিবীতে নানা ধর্মের অধিষ্ঠান ও বিকাশ সৃষ্টিকর্তার অমতে বা অগোচরে নিশ্চয় হয়নি! সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী মানুষ এভাবেই বিষয়গুলো সম্পর্কে ভেবে থাকে।
সমগ্র পৃথিবীব্যাপী মানব সমাজের মধ্যে যে বৈচিত্র বিদ্যমান, জাতি-বংশ-বর্ণ-কৃষ্টি ও ধর্মের ভিত্তিতে, তাকে আমাদের বিচার করতে হবে
ভালবাসা ও সহমর্মীতা দিয়ে, হিংসা বা ঘৃণা দিয়ে নয়!
যদি হিংসা ও ঘৃণাকে প্রাধিকার দেয়া হয়, তা হবে সৃষ্টিকর্তার যে স্বাভাবিক প্রকৃতি তার বিরূদ্ধাচরণ! কারণ, সৃষ্টিকর্তা নিজে এক এবং একক হলেও তিনি বৈচিত্র এবং বর্ণিল সমাহারকে পছন্দ করেন।
তিনি এক ও একক ক্ষমতাশালী না হলে, বহু সৃষ্টিকর্তার পারস্পরিক দ্বন্ধ-সংঘাতে সৃষ্টি-জগতে এতদিনে বহুবিধ বিপর্যয় ঘটে যেত! সৃষ্টি-জগতের সর্বত্র সুশৃঙ্খল পরিচালনা দেখে সৃষ্টিকর্তার এককত্ব সম্পর্কে মানুষের অন্তরে মজবুত বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা পাওয়া স্বাভাবিক।
সৃষ্টিকর্তা যদি বৈচিত্রকে পছন্দ না করতেন তা হলে পৃথিবীর সকল মানুষ হতো একই রকম!
অনেকটা ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত যে কোন জিনিসের মতো।
তিনি চাইলেই মনুষ্য-প্রজাতির সকলকেই একই বর্ণ, আকৃতি ও স্বভাব দিয়ে সৃষ্টি করতে পারতেন! সৃষ্টিকর্তা চাইলেই সকল মানুষের আচরণ হতে পারতো একই ধর্ম-বিশ্বাস ও কৃষ্টি-সংস্কৃতির উপর! তা যেহেতু হয়নি,
আমাদের উচিত হবে মহামহিম, মহাকৌশলী সৃষ্টিকর্তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক সকল মানুষকে ভালবাসা এবং সকল ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।
যেসব সৃষ্ট-জীবের মন আছে তাদের মধ্যে
বৈচিত্রতার স্বভাবগত একটি রীতি হচ্ছে, তারা এই বৈচিত্রকেই নিজেদের মাঝে প্রতিযোগিতার একটি উপাদান বানিয়ে নেয়!
একটি উদাহরণ দিই এইভাবেঃ
যদি মন থাকতো তবে রঙধনুর প্রত্যেকটি রঙ দাবী করতে পারতো যে, চমৎকার এই রঙধনু সৃষ্টির জন্যে সে’ই বেশী গুরুত্বপূর্ণ! যেমনঃ লাল বলতো, আমিই প্রধান; নীল বলতো, আমিই সর্বব্যাপী; সবুজ বলতো, আমি তো অপরিহার্য্য; সোনালী বলতো, আমি সবচেয়ে ঐশ্বর্যময়; এবং একই ধারায় সবচে’ পানসে ধরণের যে রঙ সে’ও তো বলতে পারতো,
আমাকে বাদ দিলে তো রঙধনুরই অপূর্ণতা রয়ে যাবে!
মানুষের যেহেতু মনও আছে মুখও আছে, সুতরাং নানা ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে এধরণের কথাবার্তা চলতেই পারে
কিন্তু তা যেন ‘পারস্পরিক সম্মানবোধ’কে তিরোহিত না করে,
ক্ষুন্ন না করে!
নিন্দা বা ঘৃণা যেন এখানে কোন ভাবেই অবস্থান গ্রহণ করতে না পারে!
নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠতর প্রমাণের চেষ্টা সীমিত থাকবে একাডেমিক ও গঠনমুলক প্রতিযোগিতার মধ্যে; অপপ্রচার, মিথ্যাচার আর হুমকি-ধমকির এখানে কোন স্থান নেই!
তাহলে তো বলতেই হয়,
বর্তমানকালের মানব-সমাজের মধ্যে আচরিত সবগুলো ধর্মকেই মানব-সভ্যতার দৃষ্টি-নন্দন এক টাপেস্ট্রীর জন্য অপরিহার্য্য গণ্য করা যায়!
উদার হবে মানুষ, আর সমাজ জায়গা ছেড়ে দেবে প্রত্যেক ধর্মীয় মতবাদের জন্যে।
এভাবে, সদাহাস্য সহনশীল পরিবেশে আমরা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মান নিয়ে এগোতে পারবো এবং
শান্তির পায়রা আমাদের চোখের সামনেই পাখা ঝাপটে আনন্দে উড়াল দিতে পারবে অবারিত খোলা আকাশে!
আমাদের বিশ্বাস করতেই হবে যে, সৃষ্টিকর্তা কোন কিছুকেই অনর্থক সৃষ্টি করেন নি! প্রত্যেক সৃষ্টিরই কিছু মূল্য আছে। এই মূল্যায়ন মানুষ হিসেবে আমাদেরকেই করতে হবে।
আমাদের মানব সমাজের বহু-ধর্মানুসারী মানুষের সমন্বিত চিত্রটা হবে,
একটি বিশাল বাগানে বর্ণিল সব প্রজাপতির নানা ছন্দে নানা দিকে উড়ে বেড়ানোর মতো!
এই যে সৌন্দর্য্য, এই যে ঐশ্বর্য্য! প্রজাপতিগুলো নিজেদের মধ্যে উম্মত্ত হানাহানিতে লিপ্ত হলে, ঘৃণায় কুন্ঠিত হয়ে মূক্ত ওড়াওড়িতে ব্যাঘাত ঘটালে, শেষমেষ সেই ঐশ্বর্য্যময়তারই ক্ষতি! একইভাবে, নানা ধর্মের এবং/ অথবা একই ধর্মের বিভিন্ন দল-উপদলের মত-পার্থক্য ও বিরোধ যদি আক্রমণ আর হানাহানিতে রূপ নেয় তবে
যে ‘মানব-কল্যাণে’র জন্য ধর্মের উদ্ভব সেই কল্যাণমুখীতাই বিপর্যস্থ হয়ে পড়ে আর ব্যর্থ হয়ে যায় মানব-শ্রেষ্ঠত্বের দাবী!
মানুষ সৃষ্টিকর্তার এক অপূর্ব সৃষ্টি!
তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই অসাধারণ সৃষ্টিলীলার এক এক রহস্যময় জগৎ!
বিজ্ঞানের বিচিত্র সব আবিস্কার আমাদের জানিয়ে দিয়েছে যে, মানুষের চোখ, মগজ, শ্রবণেন্দ্রীয়, ঘ্রাণেন্দ্রীয়, হৃৎপিন্ড, রক্ত, শিরা-উপশিরার জটিল জাল, সদ্য-আবিস্কৃত ডিএনএ- ইত্যাদির প্রত্যেকটিই সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম সৃষ্টিকর্মের জ্ঞানপূর্ণ ভুবন!
বলা যায়,
মানুষের দেহাবয়ব সৃষ্টি করাটা মহান সৃষ্টিকর্তার সীমাহীন ক্ষমতার এক ঝলক প্রকাশ যেন!
সৃষ্টিকর্তার আপন ঐশ্বর্য্য!
এমন মর্যাদা যে মানুষের অঙ্গে, তাকে আমাদের সম্মান করতেই হবে।
আমরা কেউ একজন মানুষকে জীবন দেয়ার কথা দূরে থাক, তার সামান্য কোন প্রত্যঙ্গও আমরা তৈরী করতে সক্ষম নই। তাই,
কোন মানুষের জীবন নাশ করা বা হত্যা করার তো প্রশ্নই আসে না; তার কোন অঙ্গের ক্ষতি করারও অধিকার কোন মানুষের নেই!
ধর্মটা তো মানুষের কল্যাণের জন্যেই।
তাই ধর্মের নামে মানুষের ক্ষতি বা মানুষ-হত্যার কোন বৈধতা থাকে না।
আজ দেশে দেশে নানা ধর্মের ছদ্মাবরণে যেসব অত্যাচার-হানাহানি-রক্তপাত ও হত্যাযজ্ঞ চলছে, এতে প্রকৃতপক্ষে কোন ধর্ম নেই!
যা আছে তা হলোঃ অধর্মের উম্মত্ততা!
প্রতিক্রিয়ায় আমাদেরকে জ্ঞানবান ও ধৈর্য্যশীল হতে হবে এবং সহনশীলতা চর্চা করতে হবে। নিন্দা, ঘৃণা ও প্রতিশোধ-প্রবণতাকে পরাজিত করতে হবে সম্মান, ভালবাসা ও উদারতা দিয়ে!
জ্ঞান-বিজ্ঞানে এযুগের মানুষ অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
অনুসন্ধিৎসা-প্ররোচিত নবতর প্রজন্ম গোঁড়ামী বাদ দিয়ে জ্ঞানের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে! তাই, ধর্ম নিয়ে গবেষণা-আলোচনা-ডায়লগ চলতেই থাকবে।
একথা ঠিক যে,
পৃথিবীর বেশীর ভাগ ধর্ম-প্রিয় মানুষই পৈত্রিকসুত্রে বা জন্মসুত্রে প্রাপ্ত ধর্মকেই আপন ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে তাতেই জীবনপাত করে থাকে।
তবে,
মূক্তচিন্তার সত্যানুসন্ধানী মানুষের সংখ্যা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে, ক্রমশঃ বাড়ছে বলা যায়।
এই জ্ঞান-বোধ-বিবেচনা মানুষকে সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে সঠিকভাবে জানার মাধ্যমে ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ হতে সাহায্য করবে, আশা করা যায়।
জ্ঞান, সত্য ও ঐক্যই মানবসমাজে সুখ-শান্তির সুবাস ছড়াবে একদিন।
# রচনাকালঃ ২২ মার্চ ২০১৭, মীরপুর, ঢাকা।
বাংলাদেশ সময়: ০:০৪:৫৮ ৬৫০ বার পঠিত