বঙ্গ-নিউজঃ যুদ্ধের ময়দান। চারদিকে তাক করা শত্রুর ‘অস্ত্র’। খুব কাছে ওঁত পাতা হিংস্র চোখ। হঠাৎ সৌম্য-ইমরুল নামের দুই যোদ্ধার পতন। সারা বাংলায় ‘আহহহ’ বলে আর্তনাদ। এরপর সুইপ, রিভার্স সুইপে ওই আর্তনাদে প্রলেপ দিয়ে সাব্বিরের জেগে ওঠা। সঙ্গে তামিমের ৮২। ‘মহাযুদ্ধ’ শেষে ইতিহাসে যে নামটি লেখা হল সেটি পাঁচ অক্ষরের- বাংলাদেশ!
যদি কোন প্রলয়ের পর পৃথিবী থেকে ‘ক্রিকেট’ শব্দটি মুছে যায়। এবং আবার যদি কখনো ওই শব্দটি এই গ্রহে ফিরে আসে, তবে বাঙালির স্মরণে ৪ উইকেটের এই জয়টি সবার আগে স্থান পাবে। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে চতুর্থ দল হিসেবে নিজেদের শততম ম্যাচে জয়ের জন্য এই প্রাধান্য নয়। এই প্রাধান্য ক্লাসিক এক ক্রিকেট ম্যাচ জেতার জন্য।
মাঠে পর্দার সামনে যে যুদ্ধগুলো হয়, তা হাতে গোনা। পর্দার ওপাশে ভেসে বেড়ায় শিরোনামহীন শত-শত যুদ্ধ। যার কয়েকটা চোখে পড়ে। কয়েকটা মিলিয়ে যায় ইতিহাসে। কলম্বো টেস্টে তেমনি কিছু যুদ্ধের দেখা মিলেছে।
তামিম অল্প সময়ের ভেতর দুটি চার হাঁকানোর পর বাংলাদেশের কোচ হাথুরুসিংহে আসন ছেড়ে উঠেছিলেন। ইশারায় বলছিলেন, ‘মারার দরকার নেই। শেষ করে আসো।’ কোচের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিলো তামিমকে বোঝাতে নিজেই মাঠে নেমে পড়বেন! এরপর বড় শট খেলতে যেয়ে যখন চান্দিমালের হাতে ধরা পড়েন, তখন যে হাথুরুকে দেখা গেছে সচরাচর এই হাথুরুকে দেখা যায় না।
রোববার সকালে ১৯১ রানের লিড দিয়ে গুটিয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। এই রান টপকাতে যেয়ে ২২ রানে পরপর সৌম্য সরকার (১০) আর ইমরুল কায়েসকে (০) তুলে নেন হেরাথ। এই অবস্থায় মাঠে নেমে খেলা ধরেন সাব্বির রহমান। পাহাড়সমান চাপের মুখেও স্কুপ, সুইপ, রিভার্সসুইপ করতে দেখা গেছে তাকে। পরিস্থিতি বিবেচনায় শটগুলো বড় বেমানান হলেও সাব্বিরের কাছে উপায় ছিল না। ওই সময় টার্ন পাচ্ছিলেন হেরাথ এবং ‘চায়নাম্যান’ সান্দাকান। দুজনে শতকরা ৯৩টি বল গুড লেন্থে ফেলছিলেন। সৌম্য-ইমরুল স্বাভাবিক ডিফেন্স করতে যেয়েও টিকে থাকতে পারেননি। ব্যাটের কানা নিয়ে বল প্রথম স্লিপে গেলে ফিরতে হয় ইমরুলকে। সৌম্য টার্ন থেকে বাঁচতে ডাউন দ্য উইকেটে এসে ধরা পড়েন। সাব্বির তাই এদিক-ওদিক করে খেললেন। তিনি করতে পেরেছেন ‘মাত্র’ ৪১। বাংলাদেশের কাছে এই ‘মাত্র’ মানে ‘সাত রাজার ধন’!
পেশাদার ক্রিকেটে খেলোয়াড়কে নাকি প্রতিনিয়ত নতুন করে জন্মাতে হয়। যদি এই কথা সত্য হয়, তবে কলম্বো টেস্টে সাকিবের আরেকবার জন্ম হয়েছে- সে কথা বলতেই হবে। কয়েকটি ম্যাচে মাথা গরম করে খেলে সাকিব ‘সাকিব’কে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। কোচের দাবি, বল হাতেও এই সাকিব সেই সাকিব নেই। কিন্তু পি সারায় প্রথম ইনিংসে স্বাগতিকদের ৩৩৮ রানে আটকাতে সাকিবের ভূমিকা ছিল অনেকখানি। উইকেট পেয়েছিলেন দুটি। কিন্তু দাপট দেখিয়েছিলেন ‘নায়কে’র মতো। এরপর ব্যাটে হাতে বিপদের মুখে ১১৬ রান করে দলকে ৪৬৭ রানের সংগ্রহ এনে দেন। পরে আবার বল হাতে জ্বলে ওঠেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ৪ উইকেট নিয়ে লঙ্কানদের ৩১৯ রানে আটকে ফেলেন। সেই সঙ্গে বাঁহাতি স্পিনারদের মধ্যে উইকেট দখলের দিক থেকে সেরা পাঁচে ঢুকে পড়েন।
এক নায়কে একটা সেশন জেতা যায়। কিন্তু ম্যাচ জিততে হলে একাধিক নায়কের প্রয়োজন পড়ে। এই ম্যাচে সেই প্রয়োজন মিটেছে বাংলাদেশের। সৌম্য প্রথম ইনিংসে ৬১ রান করে অবদান রাখেন। সঙ্গে ফিল্ডিং করেছেন দুর্দান্ত। তামিম প্রথম ইনিংসে ৪৯ করার পর দ্বিতীয় ইনিংসে করেন ৮২। এছাড়া বলে তাইজুল, মিরাজরাও সমানতালে লড়াই করেছেন। মুশফিক মিডলঅর্ডারে ৫২ করে হাল ধরেছিলেন। অভিষিক্ত মোসাদ্দেক শেষ দিকে ৭৫ করে স্কোর বড় করেন। দ্বিতীয় ইনিংসেও দুজন শেষ দিকের কঠিন সময় দাঁতে দাঁত রেখে পার করেন।
দলকে ১৮৫তে নিয়ে যেতে চার মারেন মোসাদ্দেক। ‘জয় বাংলা কাপে’ ভাগ বসাতে দরকার ৬ রান। টিভি পর্দায় ভেসে ওঠে কালো চশমাপরা হাথুরুসিংহের মুখ। গ্যালারিতে লাল-সবুজের পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে যুবকের দল। এভাবে ১৯১। এভাবে ইতিহাস। এভাবেই মহাকাব্য! ধারাভাষ্যকার চৌধুরী জাফরউল্লা শরাফত তখন কী করছিলেন তা কে জানে। নিশ্চয়ই কোথাও বসে সুকান্তকে উচ্চারণ করেছেন-সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়!
সৌজন্য ;চ্যানেল আই
বাংলাদেশ সময়: ২০:৩০:৫১ ৩৮৩ বার পঠিত