হাসনাত কাদীর -এর ছোটগল্প ‘বাঁশি’

Home Page » সাহিত্য » হাসনাত কাদীর -এর ছোটগল্প ‘বাঁশি’
শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৭



Image may contain: 1 person, close-upসদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি হরিপদর বিয়ের বয়স পেড়িয়ে যাচ্ছিলো। অথচ সেদিকে তার কোন খেয়াল ছিল না। বিয়ে-থা’র বিষয় সে অনেক আগেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। মাসিক পঁচিশ টাকা বেতনে কেরানির চাকরী। দত্তদের বাড়িতে ছেলে পড়িয়ে তার তিনবেলা খাবার জোটে। সে রাত কাটায় কিনু গোয়ালার গলির দোতলা বাড়ির একতলায় একটা স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে মাথা গুঁজে। ঘরটা পথের ধারেই। লোনাধরা দেয়ালের কোথাও বালি খসে গেছে, কোথাও বা স্যাঁতাপড়া দাগ। ছাপোষা কেরানির এমন জীবনে আরেকটা জীবন জড়ানো মানে ফুলের পাপড়ি ছিড়ে তা নর্দমায় ছুড়ে ফেলা। সুতরাং, হরিপদ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো এ-জীবনে বিয়ে-সাদি নয়।

হরিপদর রুটিনবাঁধা একা জীবন। আপনজন তার এমন কেউ ছিল না যে তার বয়সের দিকে তর্জনী তুলে বিয়ের কথা স্মরণ করাবে। দিনে দিনে সে তাই ভুলেই গিয়েছিলো বিয়ে-সাদি বলেও জগৎ সংসারে কিছু আছে। কিন্তু এতদিন পরে সেই ভুলে যাওয়া বিষয়টাই মনে করানোর মহান দায়িত্ব নিয়ে এক দূরসম্পর্কের পিসি তাকে প্রতিসপ্তাহে রুটিন করে চিঠি পাঠানো শুরু করেছে।

সন্ধ্যার কিছু আগে অফিস শেষে ঘরে ফিরছিলো হরিপদ। তখন গলির মোড়ে কান্তবাবুর সঙ্গে দেখা। কান্তবাবু মোড়ের বাড়িটাতে থাকে। তার যত্নে-পাট-করা লম্বা চুল, বড় বড় চোখে সুরমা লাগানো– বড়ই সৌখিন মেজাজের লোক। কর্নেট বাজানো তার শখ। তার কর্নেট বাজানোর সময়-অসময় বলে কিছু নাই। মাঝেমাঝেই গুমোট গলিটার মধ্যে তার কর্নেটের সুর জেগে ওঠে। প্রায় রাতেই কান্তবাবুর কর্নেটের সুর শুনে শুনে হরিপদর চোখে ঘুম নেমে আসে। কখনো কখনো শেষ রাতে কর্নেটের সুরে তার ঘুম ভেঙে যায়। সে তখন একধরণের বিরক্তি আর ভালোলাগা নিয়ে কান খাড়া করে থাকে। কান্তবাবু হরিপদকে দেখে হাসিমুখে বললো, ‘নমস্কার হরিপদ বাবু।’

হরিপদকে দাঁড়াতে হলো।
কান্তবাবু বললো, ‘খবর-টবর সব ভালো তো?’
জৈষ্ঠ মাসের কাঁঠাল পাকা গরম। ঘামে জামা ভিজে গেছে। গা চটচট করছে। স্নান না করা পর্যন্ত ঠিক হবে না। কূয়োর ঠাণ্ডা জলে স্নানের জন্য মনটা মুখিয়ে আছে। এখন এই গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হরিপদর মোটেই ইচ্ছে ছিল না। তবু ভদ্রতার হাসি মুখে এটে সে বললো, ‘জ্বী, নমস্কার। আমি ভালো আছি। আপনার শরীর ভালো তো? তা ইদানিং কর্নেট যেন কম কম বাজাচ্ছেন মশায়।’
‘হ্যা, তা ঠিকই ধরেছেন। যা গরম পড়ছে না!’
‘আপনি কিন্তু মশায় বাজান চমৎকার! আপনার কর্নেটের সুর শুনে ঘুমাতে ঘুমাতে এমন অভ্যাস হয়েছে যে– ‘
কান্তবাবুর দু’ঠোটের হাসি বিস্তৃত হলো, ‘চিন্তা করবেন না। একটু বৃষ্টি-টৃষ্টি নামুক, গরমটা একটু কমুক দেখবেন আবার নিয়ম করে আপনাদের ঘুম পাড়াচ্ছি, ঘুম ভাঙাচ্ছি।’
হরিপদ মুখে সাজানো হাসি ছড়িয়ে বন্ধ ছাতাটা ফোটালো। কান্তবাবু সেটা লক্ষ করে পকেটে হাত ঢুকিয়ে বললো, ‘আপনাকে বড় কষ্ট দিলাম মশায়। একটা চিঠি ছিল আপনার। পিয়ন আপনাকে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলো আমি রেখে দিলাম।’
হরিপদ কান্তবাবুর হাত থেকে চিঠিটা নিতে নিতে বললো, ‘না-না কষ্ট বলছেন কেন? ছিঃ ছিঃ! হয়েছে কী মশায় ঘরে এতো ইঁদুর বাসা বেঁধেছে– দেখুন দেখুন আবারো ছাতাটা কেটেছে। আরে বাবা কেরানির সাত বছরের পুরোন ছাতা। এতগুলো তালি! আবারো কাটলি? এই ছাতাটা না থাকলে বর্ষায় আমি অফিস যাব কীভাবে সে কি আর তোরা বুঝবি?’
কান্তবাবু মুখের হাসি আরো প্রশস্ত করে বললো, ‘তা মশায়, পথে দাঁড়িয়ে কথা বলছি– অফিস থেকে ফিরলেন– আসুন না বাড়ির ভেতরে যাই।’
‘না না, ধন্যবাদ মশায়। এখন যাই। আরেকদিন আসবো।’
হরিপদ ঘরের দিকে পা’ বাড়ালো।

০২

হরিপদ কূয়া থেকে জল তুলে স্নান শেষ করলো। ঘরে এসে ঢুকতে ঢুকতে সন্ধ্যা নেমে এলো। কাপড় বদলে ভাঙা চিরুনিতে মাথা আচড়ে নিলো সে। আশে-পাশের বাড়ি থেকে তখন শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসছে। ঘরে ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলছে। কেবল হরিপদর ঘর ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারে। সে দ্রুত বাইরে বেড়িয়ে এলো। প্রতিদিন এই সময় সে শেয়ালদা স্টেশনে যায়। কাটিয়ে আসে সন্ধ্যেটা। ঘরে আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে। স্টেশন থেকে সে যায় দত্তদের বাড়ি। খোঁজ নেয় ছেলেদের সকালে যা পড়িয়েছে তাতে কারো কোন সমস্যা আছে কি না? থাকলে তা বুঝিয়ে দেয়। তারপর রাতের খাবার খেয়ে গুটিগুটি পায়ে তার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে ফিরে আসে। রাত ততক্ষণে সাড়ে দশটা বেজে যায়। তারপর একাকী ঘরে নিরালা নিঝুম অন্ধকার।

ইস্টিশনে এঞ্জিনের ধস্ ধস্। বাঁশির আওয়াজ। যাত্রীদের ব্যস্ততা। কুলিদের হাঁকাহাঁকি। এসব ছাড়িয়ে হরিপদ একটু দূরে গিয়ে বসেছিলো। কংক্রিটের বেঞ্চির পাশে মিটিমিটি জ্বলছে গ্যাসের বাতি। একঝাঁক পতঙ্গ তাকে ঘিরে উড়াউড়ি করছে। বসে আছে গা লেপ্টে।

ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছিলো। আবেশে ছোখ দু’টি বুজে বুজে আসছিলো হরিপদর। এমন সময় পকেটে রাখা চিঠিখানার কথা তার মনে পড়লো। পিসি লিখেছেন, সুতরাং সেই পুরনো কথাই– তোর বিয়ের বয়স চলে যাচ্ছে। একটা বিয়ে-থা করে সংসারী হ। মেয়ে দেখবো? ত্রিভূবণে আপনজন বলতে তো তোর আমি ছাড়া কেউ নেই। মেয়ে তো আমাকেই দেখতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

হরিপদর মনে হলো সেই পুরনো কথাই তো লিখেছে, কী হবে পড়ে? তারপরই মনে হলো– পড়ি, পড়বো না কেন? আর তো কেউ লেখে না আমাকে। লেখার মতো কেউ আর নেইও আমার। ধীরেধীরে হরিপদ চিঠির খামটা ছিড়লো। তারপর চিঠির ভাঁজ খুলে মেলে ধরলো চোখের সামনে। আর পড়া শেষ করে হরিপদ বরফের মতো জমাট বেধে বসে রইলো– পিসি গুরুতর অসুস্থ! জীবনের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন! এখন এই শেষ বেলায় তাকে দেখার জন্য অধীর হয়ে বসে আছেন!

০৩

ইস্টিশন থেকে ফিরে কান্তবাবুর কর্নেট বাজানো শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো হরিপদ। মাঝরাতে বাতাসের হুঁ-হুঁ শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেলো। বাইরে দমকা বাতাস বইছে। জানালায় আমগাছের একটা চিকন ডালের বাড়ি লেগে শব্দ হচ্ছে। পিসির মুখখানি মনে পড়ে হরিপদর। ধীরেধীরে বাতাস কমে শুরু হয় ঝুমবৃষ্টি।

ক’টা বাজে এখন?
শেষরাতের ট্রেনে হরিপদ পিসিকে দেখতে যাবে বলে ঠিক করেছিলো। বৃষ্টি থামবে কখন? এরই মধ্যে ঘরে জল ঢুকতে শুরু করেছে। একটু বৃষ্টি হলেই এ-ঘরে জল ঢুকে পড়ে। দরজার ঠিয়েটার নিচ দিয়ে জল ঢোকে, জানালার ফাঁক গলে জল ঢোকে, জল ঢোকে ছাদের ছিদ্র দিয়ে। চৌকির নিচে খচমচ শব্দ করে বোধহয় ইঁদুর দৌড়ে গেলো। কোথায় যেন টিকটিকিটা ডেকে উঠলো– এ-ঘরে একটা নিঃসঙ্গ টিকটিকি বাস করে। অন্ধকারে হরিপদ টিকটিকিটা দেখতে পাচ্ছে না। আচ্ছা টিকটিকি কি অন্ধকারে চোখে দেখে– হরিপদর মনে প্রশ্ন জাগলো। আর তখন কোথায় যেন বাজ পড়লো প্রচন্ড শব্দে।

বেশ কিছুক্ষণ পর কমতে শুরু করলো বৃষ্টির বেগ। তখন গলির মোড়ে কান্তবাবুর বাড়ি থেকে কর্নেটের সুর ভেসে আসছে। পিসির মুখখানি মনে করে হরিপদর বুকের ভেতর কেমন হু-হু করতে লাগলো।

অন্ধকারেই হাতড়ে কাপড় পালটে নিলো হরিপদ। চৌকি থেকে নেমে মেঝেতে পা দিতেই পায়ের পাতা ভিজে গেলো। হরিপদ তার একহাতে চটি আর অন্য হাতে বহুছিদ্র ছাতা ধরে পা বাড়ালো স্টেশনাভিমুখে।

০৪

ধলেশ্বরী নদী-তীরে পিসিদের গ্রাম।
ট্রেন থেকে নেমে হরিপদ দ্রুত নদী-তীর দিয়ে পা’য়ে চলা পথ ধরে হাটছিলো। সামনেই নদীর একটা ঘাট। এই ঘাটে পিসিদের গ্রামের মানুষ গোসল, ধোয়ামেলা করে। ঘাটের একটুখানি আগে মোড়ের সামনে গেরুয়া পোশাকধারী একজন বাউলকে দেখা গেলো। বাউল আপন মনে একতারায় সুর তুলে সামনে এগোচ্ছে। হরিপদ তার পেছন পেছন। সে যখন ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে গেলো সূর্য তখন পূর্বাকাশে গাছপালার মাথা ছুঁয়েছে। নদীর ঘাটে সাদা-কালো ডুরে শাড়িপড়া এক ছিপছিপে তরুণী। পা’য়ের পাতা জলে ডুবিয়ে সে উবু হয়ে হাত-মুখ ধুচ্ছিলো। একতারার টুংটাং সুরে তরুণী ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকালো। তরুণীর মুখে চোখ পড়তেই হরিপদর বুকের ভেতর মূহুর্তেই তীব্র তরঙ্গের সহস্র ঢেউ খেলে গেলো। মায়া-মায়া দু’টি হরিণী চক্ষু। নেশা-নেশা রক্তাভ অধর। কলঙ্ক-কালো দীঘল কেশ। কী তীব্র নেশা-নেশা মাধুর্য জড়ানো সেই কোমল গৌরী মুখখানায়! তরুণী দ্রুত ঘোমটা টেনে দিলো। চোখ নামিয়ে নিলো হরিপদ।

হরিপদ যখন পিসিদের বাড়ির ভেতর ঢুকছে তখন তার বুকের ভেতর একটা কাঁসার ঘন্টা যেন দ্রুত বেজে চলেছে। না জানি কী অবস্থা এখন পিসির শরীরের!

সদর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালো হরিপদ। পিসি উঠোনে কাপড় মেলছেন– এইমাত্র গোসল করে এসেছেন! তাকে দেখে প্রায় ছুটে এসে হাত জড়িয়ে ধরলেন পিসি। বিধবার বয়স্ক মুখখানি জুড়ে শিশুর মতো সরল হাসি। হরিপদর মাথায় হাত বুলিয়ে পিসি ফোকলা দাঁতে বললেন, ‘এতো দিনে তুই এলি?’
‘পিসি তোমার না অসুখ?’ হরিপদ জিজ্ঞেস করলো।
‘আরে না। কীসের অসুখ?’ পিসি হরিপদর হাত ধরে তাকে ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
হরিপদ বললো, ‘তবে যে চিঠিতে লিখেছ–!’
পিসি তেমনই হাসিমুখে বললেন, ‘সে তো তোকে আনবো বলে।’
উত্তর শুনে বিরক্তিতে গা জ্বলতে শুরু করেছিলো হরিপদর। এতো দূর থেকে সে বীনা ছুটিতে এতো কষ্ট করে ছুটে এসেছে একটা মিথ্যে সংবাদে! তারপরই অন্য একটা বোধ যেন শান্তির হাওয়া ছড়ালো। যাক, পিসি তো ভালো আছেন! এতোক্ষণের সেই উদ্বেগ, শঙ্কা, দুঃশ্চিন্তা আর নাই। আর এমন করে কে-ই বা তাকে ডাকে!

এই সময় একটা কিন্নরী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ঘরের জানালা থেকে, ‘জেঠি, অতিথিকে বাইরেই দাড় করিয়ে রাখবে নাকি?’
হরিপদর বুকের ভেতর মূহুর্তেই সহস্র তরঙ্গের তীব্র ঢেউ খেলে গেলো। তার দৃষ্টি চকিতে পৌঁছে গেলো জানালায়। জানালায় সেই দুটি মায়া-মায়া চোখ, নেশা-নেশা ঠোট, কলঙ্ক-কালো কেশ, সেই মধুর গৌরী মুখশ্রী!
হরিপদর জগৎ জুড়ে কর্নেটের সুমধুর সুর!

০৫

দুপুরে খাবার সময় তালপাতার পাখায় বাতাস করতে করতে পিসি বললেন, ‘হ্যারে হরি, আমাদের লতা রে কেমন দেখলি?’
হরিপদ পিসির মুখে তাকালো।
পিসি বললেন, ‘জানালায় যারে দেখলি। আমার দেওরের পালক মেয়ে। আমারও বলতে পারিস।’
‘ও। নদীর ঘাটেও দেখেছিলাম।’
‘বাদরটা আজও বুঝি ঘাটে গেছে? নদী খুব পছন্দ করে। লুকিয়ে-চুরিয়ে যায় মাঝেমধ্যে। তবে বড় ভালো মেয়ে। এমন মেয়ে আর পাবিনে রে।’
‘মানে পিসি?’
‘ও মা, মানে আবার কী? বিয়ে-টিয়ে করবি না জীবনে?’
হরিপদ কোন কথা না বলে একমূহুর্ত অপলক দৃষ্টিতে পিসির মুখে তাকালো। পিসি তার কী অর্থ করলেন তা তিনি আর তাঁর ঈশ্বরই ভালো জানেন। পিসির মুখে শিশুর মতো হাসি ফুটলো।
‘তা মুখফুটে বলবি তো মেয়েটা কেমন লাগলো?’
‘ভালো।’
‘কেমন ভালো?’
‘উঃ পিসি বড় যন্ত্রণা দাও। ভালো, ভালো, অনেক ভালো।’
হরিপদর খাওয়া শেষ হয়েছিলো। প্লেটে হাত ধুয়ে সে উঠে পড়লো।
পিসি বিজ্ঞের মতো মাথা দুলিয়ে বিড়বিড় করলেন, ‘পাগল ছেলে! বুড়ো ধামড়া হলো তবু মেয়ে মানুষের মতো লজ্জা গেলো না।’

পিসি তাঁর দেওরকে গিয়ে বললেন,’সবকিছু ঠিকঠাক। দ্রুত জোগাড়-যন্ত্র কর। ছেলে আমার পরের চাকরি করে। ছুটি নিয়ে আসেনি। আজকে রাতেই আয়োজন কর। ছেলের যে অস্থির মতি! এবার বিয়ে না দিয়ে আমি ওকে হাতছাড়া করবো না।’

কৃষিজীবী দরিদ্র পরিবার।
বিয়ের আয়োজন সাদামাটা। পিসির ছেলে সুভাস আর তার কাকা মিলে সন্ধ্যার মধ্যেই সব ব্যবস্থা করে ফেললো। গ্রামের লোকজনও হাত লাগালো কাজে-কর্মে। উঠোনে কলাগাছ পোতা হলো। তৈরি হলো মঞ্চ। বাজার থেকে বর-কনের বিয়ের পোশাক কেনা হলো। লগ্ন ঠিক হলো রাত দশটায়। লতার দশ বছর বয়সী ছোট ভাই এসে হবু জামাইবাবু কে বার কয়েক দেখে গেলো। এসবের কিছুই অবশ্য হরিপদ জানলো না।
দুপুরে খাওয়ার পর সে দিবা নিদ্রায় গেছে।

সন্ধ্যার সামান্য আগে হরিপদ কে ডেকে তোলা হলো গায়ে হলুদের জন্য। সব শুনে হরিপদ হতভম্ব।
পিসি কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন, ‘তুই ছন্নছাড়ার মতো এভাবে ঘুরে বেড়াস আমার কি তা ভালোলাগে? তোর মা বেঁচে থাকলে পারতো সহ্য করতে? আমার তো সময় শেষ হয়ে এলো। যাবার আগে তোর একটা গতি হয়েছে দেখতে পেলে আমি শান্তিতে যেতে পারি। তাছাড়া তুই এখন না বললে কি চলে? মেয়েটার গায়েহলুদ হয়ে গেছে। ঢাকাই শাড়ি পড়ে কত স্বপ্ন নিয়ে সে বসে আছে।’

হরিপদর হৃদয় আদ্র হলো। লতার মুখখানি চোখে ভাসতেই বুকের ভেতর সেই অদ্ভুত তরঙ্গ খেলা করে গেলো। বেজে উঠলো কর্নেটের সেই সুমধুর সুর। কিন্তু সকলই মাত্র কয়েক মূহুর্তের জন্য। পরক্ষণেই একটা দরিদ্র অনাহারী, দুঃখ-কষ্ট জর্জরিত সংসারের ম্লান ছবি ভেসে উঠলো চোখের সামনে। কঠিন বাস্তব তাকে চাপা গলায় শাসিয়ে গেলো–সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি তুই পঁচিশ টাকার বাঁধা চাকর। দত্তদের ছেলে পড়িয়ে তিনবেলা পেটের রাক্ষস ভুলাস। ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপের খরচ বাচাতে সন্ধ্যা কাটাস শেয়ালদা ইস্টিশনে। বর্ষায় তোর ট্রাম খরচা বাড়ে। আপিস কামায় হওয়ায় মাইনেও কাটা যায় মাঝেমাঝে। জরিমানা-দেওয়া মাইনের মতো তোর বহুছিদ্র ছাতার অবস্থা। বৃষ্টি হলেই তোর আধমরা গলির ঘরে একহাঁটু জল জমে। তুই করবি বিয়ে?! বৌ কে খাওয়াবি কী? রাখবি কোথায়? হরিপদ, তুই বিয়ে করবি! কেন? একটা মেয়ের জীবন নর্দমায় ছুড়ে দিতে? বিবেকে বাধে না হরিপদ, লজ্জা করে না তোর?!

০৬

বিয়ের আসর থেকে সেদিন পালিয়ে এসেছিলো হরিপদ।
এসে নিঃশ্বাস ফেলেছিলো স্বস্তির– মেয়েটা তো রক্ষা পেলো!
কিন্তু হৃদয় কে সে লুকাবে কোথায়? চোখ বুজলেই যে সেই মায়া-মায়া চোখ, নেশা-নেশা ঠোট, কলঙ্ক-কালো দীঘল কেশ, সেই মধুর গৌরী মুখশ্রী– পড়নে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর!

জৈষ্ঠ অতীত এখন। বর্ষা ঘনঘোরা।
কাজে মন বসে না হরিপদর। দু’চোখে সেই ছবি শুধু ভাসে। ট্রামে, বাসে তারে মনে পড়ে। কাজের মাঝে তারে মনে পড়ে। মনে পড়ে তারে স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ঘরে। ট্রেন ইস্টিশনের সন্ধ্যার আলো-আধারিতে মনে পড়ে। মনে পড়ে রাতজাগা গহীন নিশিথে। মনে পড়ে অঝর শ্রাবণধারায় তারে মনে পড়ে।

এই ঘনঘোর বর্ষায় কান্তবাবুর কর্নেট বাজানোর শখ আরো বেড়ে গেছে। গহীন নিশিথে, উদাস মধ্যাহ্নে, বিবাগী গোধূলিতে, অঝর বরষণে, সময়ে-অসময়ে বেজে ওঠে কর্নেট। হরিপদর পোড়া-পরান কেঁপে ওঠে ভীষণ। যেন মূহুর্তেই বুকে তীব্র তরঙ্গে সহস্র বেদনা ভেঙে ভেঙে পড়ে। কী যেন কী শূন্যতায় হরিপদর সারা পরান কেমন করে ওঠে!

এইসব তীব্র বেদনার দিনে হরিপদ হঠাৎ যেন আবিষ্কার করে– এ-গলিটা ঘোর মিছে দূর্বিষহ মাতালের প্রলাপের মতো। গলিটার কোনে কোনে জমে উঠছে, পঁচে থাকছে আনাজের খোসা, মাছের কানকা, মরা বিডালের ছানা– ছাইপাঁশ আরো কত কী। হরিপদর মনে হয় ঘরের ইঁদুর টিকটিকির সঙ্গে তার যেন কোনই প্রভেদ নেই। তার এ-জীবন যেন মানুষের জীবন নয়– কোন আধমরা জগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে থাকা।
কেন যেন তার মনে এই বোধও উদয় হয় যে, আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোন ভেদ নেই। বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে ছেড়া ছাতা, রাজছত্র মিলে চলে যায় একই বৈকুন্ঠের দিকে।

পরিশিষ্ট

সেদিন রাত্রি দ্বিপ্রহরে ধরণী জুড়ে অবিরাম ধারাপাত। কান্তবাবুর কর্নেটের সুর ভেসে আসছে বিষাদী মর্সিয়ার মতো। হরিপদ কেরানির চোখে ঘুম নেই। বুক জুড়ে তার আকাশের মতো সীমাহীন শূন্যতা।

বাইরে বেড়িয়ে এলো হরিপদ।
অঝর বৃষ্টির মাঝে ভিজে ভিজে সামনে এগোতে লাগলো। তার পা’য়ের নিচে নোংরা জল। সেদিকে তার খেয়াল নেই। তার দু’চোখে তখন ভাসছে অনন্ত গোধূলিলগ্নে বহতা ধলেশ্বরীর তীরে তমালের ঘন ছায়া– লগ্নভ্রষ্টা এক মাধুর্যময়ী তরুণী অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে, তার পড়নে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।।

(গুরু কবি রবী ঠাকুরের ‘বাঁশি’ কবিতা অবলম্বনে রচিত।)

হাসনাত কাদীর
১২ এপ্রিল ২০১১
মীরপুর, ঢাকা।

বাংলাদেশ সময়: ০:২৭:২৩   ৪৬১ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ