মোঃফজলুল হক,গাজীপুর প্রতিনিধি।বঙ্গ নিউজ ডটকমঃ গাজীপুরের জেলার কালিয়াকৈরে অরক্ষিত একটি লেভেল ক্রসিংয়ে ঢাকা থেকে কলকাতাগামী মৈত্রী এক্সপ্রেসের ধাক্কায় দুই মা ও তাদের দুই শিশু সন্তানসহ পাঁচজন নিহত হয়েছেন। তারা একটি প্রাইভেট কারে চড়ে স্কুলে যাচ্ছিলেন। নিহত আরেকজন হলেন প্রাইভেট কারের চালক। রোববার সকাল প্রায় ৯টার দিকে কালিয়াকৈরের গোয়ালবাথানের নয়ানগর-সোনাখালী ক্রসিংয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর কিছুদূর গিয়ে মৈত্রী এক্সপ্রেসের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে ঢাকা থেকে জমোনা সেতু হয়ে উত্তরবঙ্গের পথে ট্রেন চলাচল ৫ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। নিহতরা হলেন- গোয়ালবাথান গ্রামের রিপন মাহমুদের স্ত্রী নুসরাত জাহান লাকি আক্তার (৩৬), তাদের ছয় বছরের মেয়ে রুবাইদা নুশরাত রিভা, রিপনের চাচাতো ভাই বিদ্যুতের স্ত্রী সোনিয়া আক্তার (৩০), তাদের পাঁচ বছর বয়সী ছেলে তহসিন আহমেদ তালহা এবং চালক মিনহাজ উদ্দিন (৪৫)। এর মধ্যে লাকি আক্তার ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। রিভা স্থানীয় একটি মিশনারি স্কুলে প্লে গ্রুপ এবং তালহা নার্সারিতে পড়ত। নিহতদের পরিবারে এখন শোকের ছায়া চলছে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, সকাল প্রায় ৯টার দিকে চালক মিনহাজ প্রাইভেট কারটি নিয়ে ঢাকা-রাজশাহী রেললাইনের গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার গোয়ালবাথান রেলক্রসিংয় দিয়ে পার হচ্ছিলেন। এ সময় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় প্রাইভেট কারটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এরপর দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া প্রাইভেট কারটি ট্রেনের সঙ্গে আটকে প্রায় এক মাইল দূরে পাশের গ্রাম ভোঙ্গাবাড়ী এলাকায় ঘাটাখালী নদীর রেলওয়ে ব্রিজের ওপর থেকে নিচে পড়ে যায়। ট্রেনের এডি-৪ নম্বর বগিটি ওই ব্রিজের ওপর থেকে লাইনচ্যুত হয়ে হেঁচড়ে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে বাজ হিজলতলী এলাকায় থেমে যায়। এ দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই প্রাইভেট কার চালক মিনহাজ, সোনিয়া আক্তার ও তার ছেলে তহসিন আহমেদ তালহা এবং লাকি আক্তার ও তার মেয়ে রিভা আক্তার মারা যান। খবর পেয়ে পরিবারের লোকজন এসে লাশ উদ্ধার করে।
এদিকে ট্রেনটি লাইনচ্যুত হওয়ায় ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ট্রেনে বাংলাদেশী ও ভারতীয় নাগরিকসহ প্রায় ৩৮৭ জন যাত্রী চরম দুর্ভোগে পড়েন। খবর পেয়ে কালিয়াকৈর ফায়ার সার্ভিস, থানা পুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ ও রেলওয়ে উদ্ধার কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। একপর্যায়ে বেলা পৌনে ১২টার দিকে রেলওয়ের উদ্ধার কর্মীরা ট্রেনের পেছনের ইঞ্জিনসহ ৬টি বগি উদ্ধার করে পাশের রেলওয়ে স্টেশন রতনপুর নিয়ে যান। পরে ট্রেনের ইঞ্জিনসহ লাইনচ্যুত বগিটি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর রেলস্টেশনে সরিয়ে নিলে বেলা ২টার দিকে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। এরই মধ্যে নিহতদের লাশ তাদের বাড়িতে পৌঁছলে স্বজনদের আহাজারিতে এলাকার বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।
মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবর পেয়ে কালিয়াকৈর উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রাসেল, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন, কালিয়াকৈর পৌরসভার মেয়র মজিবুর রহমান, কালিয়াকৈর থানার ওসি আবদুল মোতালেব মিয়া, রেলওয়ে পুলিশের ওসি ইয়াছিনসহ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
কালিয়াকৈর ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার অর্পূব বল জানান, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ট্রেন-প্রাইভেট কারের সংঘর্ষের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার টিম ও অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সেখানে যাই। ঘটনাস্থল থেকে নিহতদের মধ্যে চালক মিনহাজ উদ্দিনের লাশ উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করি। বাকি চারটি লাশ আমরা পৌঁছানোর আগেই তাদের পরিবারের লোকজন নিয়ে যায়। এছাড়া চূর্ণ-বিচূর্ণ প্রাইভেট কারটি উদ্ধার করা হয়েছে।
অ্যাডভেন্টিস্ট ইন্টারন্যাশনাল মিশন স্কুলের (এইমস) ভাইস প্রিন্সিপাল লতিকা পলিয়া জানান, এক বছর আগেও ওই রেলক্রসিংয়ে এক বাবা-মেয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন। ওই স্থানে রেলওয়ের কোনো গেট ও সিগন্যাল নেই, নেই কোনো গেটম্যান। এখানে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ওই রেলক্রসিং দিয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের লোকজন ঝুঁকির মুখে চলাচল করে।
কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি ইয়াছিন জানান, দুর্ঘটনার পর ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হলে ঢাকা-রাজশাহী রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। পরে দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেন ও লাইনচ্যুত বগিটি সরিয়ে নিলে প্রায় ৫ ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। তিনি বলেন, অবৈধ অরক্ষিত রেলক্রসিংগুলোর ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
স্থানীয় লোকজন ও জয়দেবপুুর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, শুধু কালিয়াকৈর উপজেলার গোয়ালবাথান রেলক্রসিং নয়, জয়দেবপুর থেকে যমুনা বহুমুখী সেতু পর্যন্ত প্রায় ৯১ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে লেভেল ক্রসিং রয়েছে ৮১টি। এ নিয়ে জয়দেবপুর-যমুনা সেতু রেললাইন পর্যন্ত ৮১টি ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ২২টিতে গেটম্যান রয়েছে। বাকি ৫৯টি ক্রসিং এখনো ঝুঁকি রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২২:৩৪:১১ ৫৭৭ বার পঠিত