তোমাকে অভিবাদন মারিও পিয়ারে রায়ম্যান্স - রোকসানা লেইস

Home Page » এক্সক্লুসিভ » তোমাকে অভিবাদন মারিও পিয়ারে রায়ম্যান্স - রোকসানা লেইস
শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬



15570916_10154880389412754_395490004_n.jpgস্বপ্নগুলো হৃদয়ে ধারন করে রাখি । স্বপ্নগুলোকে যত্ন করে মজবুত ভাবনায় জড়িয়ে জীবন্ত করি। ইচ্ছেটা জেগে ছিল বছর আট আগে। তখনও অতটা দৃঢ় ছিল না। কিন্তু ঘটনাটা জানার পরই মনের মধ্যে একটা বিদ্যুত চমকের মতন আকাঙ্খা জেগে ছিল। ইচ্ছেটাকে লালন করে বড় করেছিলাম। সেই ইচ্ছেটা পূরন হলো। আসলে গত ছাব্বিশ অক্টোবর বেলজিয়ামে এই ইচ্ছেটা পূরণ করলাম।
অনেকটা স্বপ্নর মতনই মনে হলো ব্যাপারটা। অনেকটা নিজের ইচ্ছাকে যেমন ভেবেছিলাম ঠিক তেমন ভাবে বাস্তব রূপে দেখতে পাওয়াটা অলৌকিক মনে হচ্ছিল। নিজের কাছেই মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল আসলে কি বাস্তবে ঘটনাটা ঘটছে, নাকি আমি এখনও ভাবছি।

১৯৭১ সনে বাংলাদেশের মানুষের উপর যখন চলছিল বর্বর নির্যাতন। আভ্যন্তরিন অরাজগতা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল পাকিস্তান সরকার। সে সময় প্রচার ছিলনা তেমন। বিদেশী সাংবাদিক যারা ছিলেন, তাদের দেশ থেকে রাতারাতি বের করে দিয়েছিল। তারপরও কিছু সংবাদ কিছু ছবি বিদেশে প্রচার হয়। বিদেশি সাংবাদিকদের লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া ছবির মাধ্যমে।
মারিও পিয়ারে রায়ম্যান্স নামের এক যুবক বেলজিয়ামে বসে বাংলাদেশের উপর এই নিষ্ঠুরতার খবর জেনে অস্থির হয়ে উঠেন সে দেশের মানুষকে সাহায্য করার জন্য। আর এই সাহায্য করার জন্য তিনি বেছে নেন এক অভিনব পন্থা।

১৯৭১ সনে বেলজিয়ান মারিও রয়ম্যান্স বাইশ বছরের যুবক। সাধারন একটি ছেলে হোটেলে কাজ করে কিন্তু মানবতার জন্য সে একটা অসাধারন কাজ করে ফেলে। ১৯৭১ সনে নির্যাতিত বাংলাদেশের মানুষের জন্য একজন বিদেশীর প্রাণ কীভাবে কেঁদেছিল। অসহায় যুদ্ধ বিদ্ধস্ত মানুষদের সাহায্য করার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করে সে ব্রাসেলসস, মিউজিয়াম থেকে ১৬৬৬ শতকে চিত্র শিল্পী জ্যান র্ভামীনের আঁকা, ” দ্যা লাভ লেটার” ছবিটি চুরি করে । চুরি করা সেই পেইন্টিং বিক্রির টাকা যুদ্ধরত বাংলাদেশিদের সাহায্যের জন্য দান করবে, এই ছিল তার মনের ইচ্ছা। ওর মন কেঁদে উঠে পৃথিবীর অচেনা একটি দেশের মানুষের উপর অত্যাচার দেখে। ঠিক যখন সে দেশের স্বদেশীরা রাজাকার হয়ে সাহায্য করছিল, মুক্তিযুদ্ধাদের এবং বুদ্ধিজীবীদের চিনিয়ে দিতে। তখন সুদূর বেলজিয়ামে বসে মানুষের জন্য মানবতায় নিজের জীবন বিপন্ন করতে দ্বিধা করেনি মারিও। মানুষের ভালোবাসায় অস্থির হয়ে মনেই পরে না তার, সে সাদা সাহেব। সে বাদামী রঙের মানুষগুলোর উপর অমানবিক অত্যাচারে সে কেবল মানুষের জন্য মানুষ হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চায়।

মিউজিয়ামের জিনিস চুরি করার দায়ে, মারিওকে দুবছরের জেল খাটতে হয়। কিন্তু সে যে দুঃসাহসী ভূমিকাটি নিয়েছিল তার মানবতাটুকু মনে পরলে তাকে আমার দেশের মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না।
“এই ঘটনাটি জানার পর থেকে মনে মনে স্বপ্ন বুনেছিলাম। একদিন মারিওর কবরের পাশে দাঁড়াব খানিক সময়। তাকে অভিবাদন জানাতে যাব। যেহেতু তাকে জীবিত পাওয়ার আর উপায় নাই, তাই গোরস্থানেই যেতে হবে। যদিও আমি গোরস্থানে যেতে পছন্দ করি না। কিন্তু মারিওকে আর কোন ভাবে পাওয়ার উপায় নাই। তাই তার কবরের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা ঠিক করে রাখি মনে মনে। সুযোগ পাওয়া মাত্রই যাবো।
এবং সুয়োগটা এসে গেলো এ বছর। বেলজিয়াম গেলাম। অক্টোবরের বাইশে সে ঘটনাটি ঘটিয়েছিল ১৯৭১ সনে। তাই ভেবেছিলাম ঠিক বাইশ অক্টোবরেই যাবো তার সমাধীতে। কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। তারিখটা ঠিক না থাকলেও মাসটা ধরলাম। ২৬ শে অক্টোবর স্বপ্নের মতন বাস্তবতার হাত ধরে মারিওর কবরের পাশে দাঁড়ানের জন্য পৌঁছে গেলাম। যেদিন এসে পৌঁছেিছলাম এখানে। সে দিন ছিল ঘন কুয়াশার আভরণে ঢাকা শহর। গত কয়েকদিন ধরে চলছে একই রকম অবস্থা কুয়াশা, শীত আর বৃষ্টি। অথচ আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই মন ভালো হয়ে গেলো আজ ঝকঝকে আকাশ। চকচক করছে রোদের আলো। ঝলমলে সকাল মন ভালো করে দিল। সাথে দারুণ শরতের উষ্ণতা। সকালে বেরিয়ে পরলাম। সব প্রস্তুতি নিয়ে। প্রায় দেড় ঘন্টার ড্রাইভ সেরে পৌঁছে গেলাম নর্মড়ি শহরে। দূর থেকে গ্রীর্জার চূুড়া দেখা যাচ্ছে।
শহর পেরিয়ে যাচ্ছি কিন্তু ফুল কেনার কোন দোকান দেখছি না। আবার কি ঘুরে শহরের দিকে আসতে হবে কিনা ভাবছি এমন সময় পেয়ে গেলাম বড়সর একটা ফুলের দোকান। এবং পছন্দ মতন ফুল। ফুল কিনে মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পরই সেমেটারী। সাজানো সব সারি দেয়া কবর। তার মাঝে খুঁজে পেলাম মারিওকে। ওর পরিবারের আর দুজন সদস্যর সাথে শুয়ে আছে সে যুবক, যার প্রাণ কেঁদেছিল বাংলাদেশিদের উপর পাকিস্থানীদের নিপীড়ন দেখে। নিজের মতন তাদের সাহায্য কারার চেষ্টা করেছিল।

আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, প্রিয় মারিও রয়ম্যান্স, তুমি যে দেশের মানুষের জন্য ভালোবাসা দেখেয়েছিলে সে দেশটি এখন একটি স্বাধীন দেশ। আমি সে দেশের একজন নাগরিক। সে দেশের জাতিয় সঙ্গীতের কয়েকটি চরণ তোমাকে শুনিয়ে যাচ্ছি। আর তোমার বীরত্বের জন্য ছোট একটা ভালোবাসার চিঠি লিখে রেখে গেলাম আমার বইয়ের মলাটের উপর তোমার জন্য। সকল শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা মিশ্রিত আমার এই নিবেদন তুমি গ্রহণ করো।
ফুল এবং ভালোবাসার চিঠি লিখে মারিওর সমাধির পাশে বেশ খানিকক্ষণ কাটালাম, আমার মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস আলোর যাত্রা বইয়ের মলাটের উপর ইংরেজি এবং ফ্রাঞ্চ ভাষায় লিখেছিলাম, বাংলাভাষাটা যেহেতু কেউ ওখানে পড়তে পারবে না তাই।
প্রিয় মারিও পিয়ারে রায়ম্যান্স,
তুমি আমার দেশের নায়ক। তুমি যাদুঘর থেকে লাভলেটার চুরি করে ছিলে, ১৯৭১ সনে বাংলাদেশের মানুষদের সাহায্য করার জন্য। যখন পাকিস্থানিরা সাধারণ জনগণকে নির্দয়ভাবে হত্যা করছিল, আমরা মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছিলাম। মানবতার লাঞ্ছনায় তোমার প্রাণ কেঁদেছিল ভালোবাসায়। তুমি আমার দেশ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা। আমি তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা জানাচ্ছি। এই ভালোবাসার চিঠিটি তোমাকে লিখছি শ্রদ্ধা জানিয়ে।
আমাকে সাথে নিয়ে যাওয়া আরেক বেলজিয়ান নাগরিক এবং আমি। অনেকটা অলিগলির পথ হয়তো আমার পক্ষে চিনতে অসুবিধা হতো। কিন্তু সে কষ্ট টুকু সহজ করে আমার অনুভুতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নিজের অনেকটা সময় ব্যয় করে আমাকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করল। আমার সাথে অনুভব করল ভালোবাসা। কারণ সেও জানে জার্মান সৈন্যের ভয়াবহ আক্রমণে যুদ্ধের বিভৎষতা কী ভাবে পরিবার এবং তার শহরের মানুষসহ অগুনতি মানুষের উপর নেমে এসেছিল। ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়ে ছিল সব কিছু। কিছু অল্প সংখ্যক মানুষের আগ্রসী ইচ্ছার কারণে। মানবতা এবং মানুষে আসলে কোন ভেদাভেদ নাই পৃথিবী জুড়ে।
মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা বিষয় রয়েছে এতদিনেও আমরা সে সব জানি না। কিছু তরুণ ছেলে সে সব বিষয়ে আগ্রহী হয়ে খুঁজে আনে নানা তথ্য। এভাবেই আমি জানি মারিওর কাজটি এই অল্প কয়েক বছর আগে। আমরা অনেকে জানি জর্জ হ্যারিসন নামে একজন বাংলাদেশের জন্য গান করেছিলেন আমেরিকায়। তার সহযোগি হয়েছিলেন রবি শংকর। বব ডিলান গান করে অর্থ সংগ্রহ করে ছিলেন। আরো একজন গান করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছিলেন। উনার নাম জোয়ান বায়েজ। এ ছাড়া ফ্রান্সের জ্যা কুয়ে নামের এক যুবক একটি বিমান ছিনতাই করেছিল। দাবীছিল যুদ্ধরত বাংলাদেশে এইড পাঠানোর। ফরাসীরা সে দাবী মেনে বাংলাদেশে সাহায্য পাঠিয়েছিল সে সময়। বিদেশী হয়েও বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাদের প্রাণ কেঁদেছিল।
আমাদের দেশটা কি ভাবে বিজয় পেয়েছিল সে বিষয়টা সবার হৃদয়ে ধারন করে রাখা দরকার। এবং তার জন্য যারা যে ভাবে যতটুকু অবদান রেখেছেন তাদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা।

বাংলাদেশ সময়: ১:২১:০৭   ৬২৫ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

এক্সক্লুসিভ’র আরও খবর


এস এস সি পাশের হার কমছে বেড়েছে জিপিএ-৫
শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রবেশপত্রে সানি লিওনের ছবি!
শক্তিশালী প্রসেসরে নতুন স্মার্টফোন বাজারে আনছে মটোরোলা
ভারত ৩৬টি স্যাটেলাইট স্থাপন করল একসঙ্গে !!
স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস, পরে কথিত স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে পদযাত্রা
রাশিয়ার নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সাবমেরিন!
টিকিট দুর্নীতির প্রতিবাদে রনি, সহজ ডটকমকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
ট্রাকচাপায় মেয়েসহ তারা তিনজন নিহত; রাস্তায় গর্ভস্থ শিশু ভুমিষ্ঠ
রোহিঙ্গা যুবক নুর বারেক আটক ,২০ লাখ টাকা উদ্ধার

আর্কাইভ