বঙ্গনিউজঃ ভারতে সরকারের হঠাৎ ঘোষণার ফলে সে দেশে ৫০০ আর ১০০০ রুপির নোটগুলো ব্যাংকে জমা না পড়লে, সেগুলো যে বাতিল হয়ে যাবে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই তা জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এখন আরও জানা যাচ্ছে,বাংলাদেশে যে লাখ লাখ নাগরিকের নিয়মিত ভারতে যাতায়াত আছে এবং সেই সুবাদে তাদের কাছেও বহু পুরনো ৫০০ ও ১০০০ রুপির ভারতীয় নোট রয়ে গেছে,সেগুলোও এখন পুরোপুরি বাতিল বলে পরিগণিত।
বাংলাদেশে থাকা এই নোটগুলো ইতোমধ্যেই তামাদি বলে গণ্য করা হচ্ছে। কারণ, ভারত থেকে বাংলাদেশে রুপির নোট নিয়ে যাওয়াটাই নাকি ‘সম্পূর্ণ অবৈধ’।
নেপালেও লাখ লাখ নাগরিকের হাতে এ ধরনের প্রচুর ভারতীয় নোট আছে। সেগুলোর গতি করার জন্য নেপালের প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ড নরেন্দ্র মোদির সাহায্যও চেয়েছেন। মোদি তাকে বিষয়টি বিবেচনা করার আশ্বাস দিলেও বাংলাদেশ থেকে একই ধরনের অনুরোধ এলে, সম্ভবত তার কিছুই করার থাকবে না। কারণ, ভারতের আইন অনুসারেই বাংলাদেশে চলে যাওয়া নোটগুলো বেআইনি।তাছাড়া নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিও আলাদা।
এ ব্যাপারে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার দুবছরের পুরনো একটি বিজ্ঞপ্তির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের একটি পদস্থ সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, বিদেশি পর্যটকরা ভারত ছাড়ার সময় পঁচিশ হাজার রুপি পর্যন্ত ভারতীয় অর্থ নগদে নিয়ে যেতে পারেন। তবে এই নিয়মের দুটো ব্যতিক্রম আছে - পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি নাগরিকরা এই নিয়মের সুবিধা পান না। যার অর্থ দাঁড়ায়, ভারত সফর শেষে দেশে ফেরার সময় বাংলাদেশিরা যত ৫০০ বা ১০০০ রুপির নোট সঙ্গে করে এতদিন নিয়ে গেছেন, তার সবটাই বেআইনি এবং সেগুলো চোরাই টাকায় পরিণত হয়েছে।
ফলে এখন যখন ভারতীয় নাগরিকদের ব্যাংকের শাখায় বা পোস্ট অফিসে পুরনো পাঁচশো-হাজারের নোট বদলানো, বা জমা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, বাংলাদেশিদের হাতে থাকা নোটগুলোর জন্য কিন্তু সেরকম কোনও পদক্ষেপের কথা আদৌ ভাবা হচ্ছে না।
‘সত্যি কথা বলতে কি, বাংলাদেশে চলে যাওয়া ওই নোটগুলোর ব্যাপারে আমাদের আইনগত কোনও দায়বদ্ধতা নেই। আর সেটা পাল্টে দেওয়ার ব্যাপারেও ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের কোনও অঙ্গীকার নেই। বাস্তবতা এটাই’, বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদস্থ সূত্রটি।
আসলে ভারতের কারেন্সি ‘রুপি’ বিশ্ব অর্থনীতিতে বহুকাল একটি ‘ক্লোজড কারেন্সি’ বলেই পরিচিত ছিল। তার মানে হলো, রুপি ভারতের বাইরে নিয়ে যাওয়া বা বিদেশে ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের জুন মাসে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া সেই নিয়ম কিছুটা শিথিল করে। ২০১৪ সালের ১৯ জুন জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে তারা জানায়, ভারতীয় ও বিদেশি নাগরিকরা এ দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় পঁচিশ হাজার রুপি পর্যন্ত নগদে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবেন।
কিন্তু এই নিয়মের দুটি ব্যতিক্রমও উল্লেখ করা হয় সেখানে। পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নাগরিকরা এই সুবিধা পাবেন না। অর্থাৎ তারা কোনও ভারতীয় রুপি নগদে নিয়ে যেতে পারবেন না। এর কারণ কী, সে ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তিতে কিছু বলা না হলেও তথ্যাভিজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে জাল ভারতীয় নোটের যথাক্রমে উৎস ও ট্রানজিট রুট হিসেবে ভারত চিহ্নিত করে থাকে, সে কারণেই এই সুবিধার আওতা থেকে এই দুটি দেশকে বাইরে রাখা হয়েছিল।
তবে এতদিন এর জন্য বাংলাদেশিদের কোনও অসুবিধাও হয়নি। বস্তুত কলকাতা থেকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য তারা যখন শ্যামলী পরিবহনের বাসে বা মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপেছেন, তখন তাদের কাছে ভারতীয় রুপি আছে কিনা, তার জন্য কখনও তল্লাশি হয়েছে বলেও শোনা যায়নি। একই কথা কলকাতা এয়ারপোর্টের ক্ষেত্রেও খাটে। ঢাকা বা চট্গ্রাম-অভিমুখী যাত্রীদের কাছে রুপি আছে কিনা, তা নিয়ে কাস্টমস-ইমিগ্রেশনেরও কখনও মাথাব্যথা ছিল না।
ফলে দিনের পর দিন এই বাংলাদেশি নাগরিকরা অজস্র ৫০০ বা ১০০০ ভারতীয় নোট নিজের দেশে নিয়ে গেছেন- এটা ভেবে যে পরের যাত্রায় সুবিধে হবে। কিন্তু তারা হয়তো জানতেও পারেননি যে, রিজার্ভ ব্যাংকের নিয়ম অনুসারে সেটা বেআইনি, আর তাদের নিয়ে যাওয়া ভারতীয় রুপি চোরাই অর্থ হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে হয়তো কখনও কোনও অসুবিধেও হতো না, যদি না নরেন্দ্র মোদি হঠাৎ করে কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে গিয়ে সেই নোটগুলো বাতিল ঘোষণা করতেন।
এখন প্রতি বছর ভারতে ব্যবসা, পর্যটন, চিকিৎসা, কেনাকাটা ইত্যাদি নানা কারণে ১৩ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি আসেন। সংখ্যার বিচারে আমেরিকার পরে বাংলাদেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি বিদেশি ভারতে আসেন। তাদের অনেকের ঘরেই এমন অজস্র ভারতীয় ৫০০ বা ১০০০ রুপির নোট পড়ে আছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। নরেন্দ্র মোদির এক ঘোষণায় সেগুলো শুধু তামাদিই হয়ে যায়নি, রিজার্ভ ব্যাংকের নিয়মের কারণে বৈধ পথে তা পাল্টানোরও কোনও সুযোগ নেই।
তবে এই নোটগুলো যদি আবার চোরাপথে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যায় এবং সেখানে পরিচিত কোনও ভারতীয় ব্যক্তির মাধ্যমে ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে তা ব্যাংক বা পোস্ট অফিস অ্যাকাউন্টে জমা করা যায়, তাহলে অবশ্য সেগুলোর একটা গতি হতে পারে। কিন্তু সেখানেও চোরাপথে রুপি পাঠানোর ঝুঁকি থাকে। আর কজন বাংলাদেশির পক্ষেইবা এত ঝামেলা করে ওই নোটের গতি করা সম্ভব, সেই প্রশ্নও থেকে যায়।
ভারতীয় রুপি এতদিন প্রায় অবাধেই চলত নেপালে। তাই সে দেশেও প্রচুর পরিমাণে ভারতের পাঁচশো বা হাজারের নোট আছে মানুষের হাতে। নেপালে ভারতীয় নোট নেওয়ার ওপরও কোনও বিধিনিষেধ ছিল না। ঠিক সেই কারণেই নেপালি প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ডও এই বিপদে ভারতের সাহায্য চেয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমস্যাটা অনেক বেশি জটিল ও আইনি মারপ্যাঁচে ভরা। যার কারণে বলতেই হচ্ছে, অন্তত আজকের তারিখে সে দেশে সব ভারতীয় ৫০০ আর ১০০০ রুপির নোট ‘বাতিল কাগজের টুকরো’র চেয়ে বেশি কিছু নয়।
বাংলাদেশ সময়: ০:২৪:৪৯ ৩৪১ বার পঠিত