বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃবিশ্বকে হতবাক করে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা তাদের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছে নিউ ইয়র্কের ধনকুবের রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে।
এর আগে কোনো রাজনৈতিক দায়িত্বের অভিজ্ঞতা না থাকা ট্রাম্প মঙ্গলবারের নির্বাচনে হোয়াইট হাউজে যাওয়া নিশ্চিত করার পথে হারিয়েছেন সাবেক ফার্স্টলেডি ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে ইলেকটোরাল কলেজের ৫৩৮টি ভোটের মধ্যে ২৭০টি পেলেই চলে। সর্বশেষ প্রাপ্ত ফলে ট্রাম্প জিতে নিয়েছেন ২৯০ ভোট। আর ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি পেয়েছেন ২১৮ ভোট।
বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে সমর্থকদের উদ্দেশে ৭০ বছর বয়সী ট্রাম্প বলেছেন, “আমেরিকাকে আমি সব সময় শীর্ষে রাখব।”
ট্রাম্পের ভোট ২৭০ পেরিয়ে যাওয়ার পর হিলারি তাকে ফোন করে হার স্বীকার করে নেন বলে সিএনএন এর খবর।
কেবল হোয়াইট হাউজ নয় এবারের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের দুই কক্ষেরই নিয়ন্ত্রণ পেতে যাচ্ছে রিপাবলিকান পার্টি। নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ আগেই তাদের হাতে ছিল, নতুন করে সিনেটও তাদের দখলে যাচ্ছে।
এদিকে ট্রাম্পের জয়ী হওয়ার খবরে বিশ্ব অর্থনীতিতে তাৎক্ষণিকভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। আমেরিকার ডলার আর মেক্সিকোর পেসোর দাম কমে গেছে, দরপতন হয়েছে শেয়ারবাজারেও।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সংস্থার করা গাদা গাদা জরিপকে মিথ্যা প্রমাণ করে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী এই ব্যবসায়ীকেই চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউজের জন্য বেছে নিয়েছেন মার্কিনিরা।
তবে নির্বাচনের ট্রাম্প জয়ী হলে তার গৃহীত নীতি বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে আশঙ্কায় বিনিয়োগকারীদের আশা ছিল হিলারি নির্বাচিত হবে। কিন্তু সেই আশার গুঁড়ে বালি পড়ায় ভোট শেষে বিশ্বজুড়ে আর্থিক বাজারে ব্যাপক দরপতন হয়েছে।
নির্বাচনের আগে বেশিরভাগ গণমাধ্যমের ধারণা ছিল, দোদুল্যমান রাজ্য বলে পরিচিত ‘ব্যাটল গ্রাউন্ডে’ ভোটের ফল হিলারির পক্ষে থাকবে।
রয়টার্স তাদের সর্বশেষ জরিপে হিলারির জয়ের সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ বলে জানিয়েছিল। বিবিসিও বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের জরিপকে গড় করে হিলারির দিকেই পাল্লা ভারী রেখেছিল।
বিতর্কিত মন্তব্য, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সখ্যতাসহ নানা কারণে দোদুল্যমান রাজ্যগুলোর ভোট হিলারির গাধা প্রতীকেই পড়বে বলে ধারণা করেছিল তারা।
কিন্তু সেসবকে উড়িয়ে দিয়ে ট্রাম্পের পক্ষেই রায় দিয়েছেন অধিকাংশ মার্কিন নাগরিক।
এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ইংল্যান্ডের বেরিয়ে যাওয়ার ‘ব্রেক্সিট’ ভোটেও জরিপের তথ্য ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছিল।
ট্রাম্প বৈধ অভিবাসন কমানোর কথা বলছেন। নথি বা কাগজপত্র নেই এমন অভিবাসীদের দ্রুত দেশে পাঠানোর পাশাপাশি রিপাবলিকান এই প্রার্থী অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান করার পক্ষে।
নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প বলেছিলেন- আমেরিকার মাটিতে থাকা ১ কোটি ১০ লাখের বেশি নথিবিহীন অভিবাসীকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হবে। তিনি মুসলমানদের আমেরিকায় ঢোকা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেন। এক পর্যায়ে এ বক্তব্য থেকে সরে যাওয়ার কথা বললেও অভিবাসন নিয়ে নীতি বদলাননি তিনি।
ট্রাম্প আমেরিকা ও মেক্সিকো সীমান্তে দু হাজার মাইলের বেশি দীর্ঘ দুর্ভেদ্য দেওয়াল তুলে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সমালোচকেরা একে অবাস্তব এবং ব্যয়সাপেক্ষ বললেও রিপাবলিকান দল এ প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার দিকে জোর দিতে চান ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচারে তিনি বলেছেন- ইউরোপ ও এশিয়ায় মিত্র দরকার আমেরিকার।
আইএস-কে পরাজিত করতে সিরিয়ার মাটিতে কয়েক হাজার স্থল সেনা পাঠানোর প্রস্তাব রয়েছে তার। রিপাবলিকান এ প্রার্থী বলছেন- ‘মেইক আমেরিকা গ্রেইট এগেইন’ করতে সবসময়ই আমেরিকার স্বার্থকে সবার উপরে রাখতে হবে।
প্রথম থেকেই ইরাক যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক পদক্ষেপের সমালোচনা করে আসা ট্রাম্প বলেছেন- নেটো জোটের ব্যয়ের একটা বড় অংশ দেয় আমেরিকা। এটা ঠিক নয়। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই জোটের সদস্যদের আরও অর্থ ব্যয় করা উচিত।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সই হওয়া প্যারিস চুক্তি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তিতে মার্কিন স্বার্থ বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। ক্ষমতায় গেলে এসব চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরুরও প্রতিশ্রুতি রয়েছে তার ইশতেহারে।
বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের করা বিভিন্ন অর্থনৈতিক চুক্তি নিয়েও নাখোশ ট্রাম্প। তার মতে, এসব চুক্তির ক্ষেত্রে আমেরিকার স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া হয়নি।
রিপাবলিকান এই প্রার্থী বহুল আলোচিত ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তির বিরোধিতা করছেন। ক্ষমতায় গেলে সই হয়ে যাওয়া নর্থ আমেরিকা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (নাফটা) চুক্তি নিয়ে নতুন করে দর কষাকষি করবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
আমেরিকার সঙ্গে চীন এবং মেক্সিকোর মত ব্যবসায়িক অংশীদাররা অন্যায় করছে বলেও অভিযোগ বিলিয়ন ডলার সম্পদের মালিক ট্রাম্পের।
২০১৫ সালে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখানোর পরপরই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন ধনকুবের ট্রাম্প। ওই সময়েই মেক্সিকানদের ‘ধর্ষক ও সন্ত্রাসী’ বলে আলোচনায় চলে আসেন এই রিপাবলিকান।
বিচারক, সাবেক মিস ইউনিভার্স, ফক্স নিউজের একজন উপস্থাপক, মুসলিম পরিবারের এক যুদ্ধাহতকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেও খবরের শিরোনাম হয়েছেন ট্রাম্প।
হিলারি শিবিরের বারবার প্রচারণা সত্ত্বেও এই রিপাবলিকান প্রার্থী ১৮ বছর ধরে দেয়া তার ট্যাক্স রিটার্নের কপি দেখান নি। এড়িয়ে গেছেন তার দাতব্য সংস্থা নিয়ে করা বিভিন্ন সমালোচনাও। আর এসব কারণে হারিয়েছেন প্রভাবশালী অনেক রিপাবলিকান ও প্রতিষ্ঠানের সমর্থন।
২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেওয়া ট্রাম্প দলের সবচেয়ে বড় দাতা ও তহবিল সংগ্রাহকে পরিণত হন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ২ কোটি ৫০ লাখের বেশি অনুসারী আছে।
নারীদের প্রতি ট্রাম্পের ধারণা ‘বাজে’- ধারাবাহিকভাবে এমন দাবি করে আসছিল হিলারি শিবির। নির্বাচনের মাস দেড়েক আগে ফাঁস হওয়া একটি টেপ সেই দাবিকে সুসংহত করে।
নির্বাচনের আগে হিলারির সঙ্গে মুখোমুখি বিতর্কের মধ্যেই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন বেশ কয়েকজন নারী। সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে ট্রাম্প বলেন, তাকে ফাঁসাতে হিলারি শিবির ও প্রভাবশালী কয়েকটি গণমাধ্যম ‘নাটক সাজিয়েছে’।
এতোসব বিতর্কের কারণে ট্রাম্পের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেন অনেক প্রভাবশালী রিপাবলিকান সিনেটর। ট্রাম্প তাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যায়িত করে বলেন, নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি দেখিয়ে দেবেন, ‘কী করে জিততে হয়’।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৩৬:১০ ৩৬৪ বার পঠিত