আমিনুল ইসলাম বঙ্গ-নিউজ ডটকম:শিরীন আক্তার (সহকারী অধ্যাপক, শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়)
চার ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় মমতাজ। ছোট ভাই মুরাদ, দুই বোন শিউলী আর গোলাপী। পদ্মার পাড়ে বাড়ি। বাবা কৃষক; নিজের জমি চাষ করেন। তাতে ধান হয়, ডাল হয়, সরিষা হয়, শাক-সবজি সবই হয়। সারা বছর তেমন কিছু কিনতে হয় না। তবে ফসল ভালো না হলে শেষের দিকে ধার-কর্জ করতে হয়; ধান উঠলে সেই কর্জ শোধ করা হয়। মমতাজ আর মুরাদ ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। খেয়ে-পরে শান্তিতেই কাটে বাবা সুরুজ মিয়ার সংসার।
সেদিন বিকেল বেলা একদল মানুষ চিৎকার করতে করতে বাড়ির দিকে আসছে। সুরুজ মিয়া গরুর খাবার দিচ্ছেন। মানুষ দেখে এগিয়ে গেলেনÑকি ব্যাপার বলো তো, কি হয়েছে? মইনুল বলছে, ‘চাচা নদীর ভাঙন, পুরা অঞ্চলে ফাটল।’ সুরুজ মিয়া মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন। মমতাজ জিজ্ঞাসা করে ‘কি হইছে বাবাÑনদী কী আমাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দিবে?’ সুরুজ মিয়া বলেন, ‘আল্লারে ডাক মা’।
দ্বিতীয় দিন ফাটল আরো দীর্ঘ হয়, বাড়িসহ দীর্ঘতম ফাটল। মানুষ পদ্মার পাড় থেকে ঘরে ফিরে না, কাজে মন বসে না। বউ-বাচ্চা, গরু-ছাগল নিয়ে কোথায় যাবে রূপ নগরের মানুষ; কোথায় ঠাঁই হবে সুরুজ মিয়ার সংসারের? পাশের গ্রামে সুরুজ মিয়ার শ্বশুরবাড়ি।
তৃতীয় দিন বৃদ্ধ নানা এসে মমতাজকে জড়িয়ে ধরে কয় আমি বেঁচে থাকতে মমতাজ পদ্মায় ভাসবে তা কি কখনো হয়। সুরুজ মিয়া বউ বাচ্চাদের নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নেন। শ্বশুরের দেয়া ৩ কাঠা জমিতে ঘর বসান। ৬ বিঘা ফসলের জমি পদ্মার পেটে গেল, নিজের পেটে কি দিবেন সুরুজ মিয়া? সংসারের এতোগুলো পেট-ই বা কীভাবে চলবে?
মমতাজ পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ত, মুরাদ চতুর্থ শ্রেণীতে; দু’জনেরই লেখাপড়া বন্ধ হলো। মুরাদকে লাগানো হলো মামার সাথে গরু-ছাগল দেখাশোনার কাজে। সুরুজ মিয়া এখন অন্যের জমিতে কাজ করেন। দিন শেষে যা পান, তাতে ৫ জনের পেট চলে না। সুরুজ মিয়ার শ্যালিকা সখিনা ঢাকায় থাকে। তার স্বামী গার্মেন্টস এ কাজ করে। সখিনা গ্রামে আসে বোনের সংসার দেখতে। বোনের অভাব-অনটন দেখে মমতাজকে ঢাকায় নিয়ে আসে। মমতাজ খালাত ভাই-বোনদের নিয়ে খেলাধুলা করে; খালা ঘরে বসেই সেলাই এর কাজ করে। এভাবেই কাটছিল দিন।
৭/৮ মাস পর সখিনা তার স্বামীর সাথে পরামর্শ করেন কীভাবে বোনকে সাহায্য করা যায়। সখিনার স্বামী সুলতান প্রস্তাব দেয়মমতাজকে গার্মেন্টসের কাজে দিতে। সখিনা বলে, ‘বারো বছরও বয়স হয় নাই, দু’মাস বাকি, ও কি কাজ করবে? সুলতান বলে, ‘সুতা কাটা, শার্ট-প্যান্ট ভাঁজ করা এসব ছোট ছোট কাজ। সখিনা খুব আনন্দিত হয়। ভাবেÑবোনের হাতে কিছু টাকা পয়সা পাঠানো যাবে।
সখিনার স্বামী কারখানার ম্যানেজার স্যারকে বলে মমতাজের জন্য গার্মেন্টস এ চাকরির ব্যবস্থা করে। মমতাজ যা পায়, সামান্য কিছু রেখে সব টাকা মা-বাবাকে পাঠায়। মমতাজের আচার-আচরণ খুবই ভালো। হাসি মুখে কাজ করে। নিজের কাজের ফাঁকে অন্যদেরও হেল্প করে। খালুর সাথেই মমতাজ অফিসে আসা-যাওয়া করে।
ঈদের ছুটিতে মমতাজ বাড়িতে যায়। ছোট ভাই-বোন, মা-বাবা, নানা সবার জন্য জামা কাপড় কিনে। কেনা-কাটা করে ঘরে এসে খালাকে বলে গার্মেন্টসে কাজ না পেলে আমাদের ঈদ হতো না খালা। আমি কোনোদিন গার্মেন্টস ছাড়ব না। খালাকেও শাড়ি কিনে দেয় মমতাজ। নিজের জন্য খুব সাধারণ জামা কাপড় কিনলেও, তার সখের গহনা কানে একজোড়া ঝুলা দুল আর পায়ের নূপুর কিনতে ভুলেনি।
মমতাজ ১৩ বছর বয়স থেকেই মেশিনে সেলাইয়ের কাজ দক্ষতার সাথে করতে থাকে। কাজে দক্ষ, সুদর্শনা, সুনয়না, সদা হাস্যোজ্জ্বল মমতাজ সবার নজর কেড়েছে অল্প বয়স থেকেই। মেশিন অপারেটিং করার পর থেকে বেতন-ভাতা ভালোই পায় মমতাজ। ছোট বোন দুটির পড়াশোনার প্রয়োজনীয় খরচ জোগান দিতে পারে সে। এসবের পরও ব্যাংকে একটি ডিপিএসও খুলেছিল; ৫ বছরে ৮০ হাজার টাকা হয়েছিল। সেই টাকা দিয়ে নানার সাহায্যে বাবাকে ১ বিঘা জমি কিনে উপহার দিয়েছিল মমতাজ।
সেই বছরই খালুর বদলি হয় গাজীপুর। খালুর জায়গায় নতুন সুপারভাইজার বাদল হোসেন যোগদান করে। বাদল খুব ভালো ছেলে। ভদ্র, নম্র, চেহারাটাও সুন্দর, গায়ের বরণ শ্যাম। মমতাজের পাশের মেশিনেই কাজ করেন কাজল আপা। কাজল আপার কাছে প্রায়ই বাদল ভাইয়ের গল্প করে মমতাজ।
কাজল আপা মজা করে বলেন ঐ কালো ছেলের যে এত গুণ, তাকে জানিয়ে দে-না যে, তার গুণের কদর আমরা করতে জানি। কাজল আপার স্বামী অন্য ফ্লোরের সুপারভাইজার। তার ঘটকালীতেই বাদলের সাথে মমতাজের বিয়ে হয়। বাদল সুন্দরী লক্ষ্মী বউ পেয়ে খুশি। বিয়ের পরের বছরই তাদের একটি ছেলে হয়। ছেলে হওয়ার পর ১ বছর মমতাজ গার্মেন্টসে আসতে পারেনি। পরে মায়ের কাছে বাচ্চা রেখে সাভারে চলে আসে এবং চাকরিতে যোগদান করে। ছেলের বয়স যখন ৪ বছর, তখন আবার এক মেয়ে হয়। মমতাজ ভাবে মেয়ের নামে একটি ডিপিএস খুলবে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাবে।
মায়ের কাছ থেকে ছেলেকে নিয়ে আসবে; গ্রাম থেকে বিধবা শাশুড়িকে নিজের কাছে নিয়ে আসবে। দুই রুমের একটি বাসা নিবে। সাভারে বাড়ি ভাড়া অনেকটা সহনশীল পর্যায়ে। শাশুড়ি, স্বামী, আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে সুখের সংসার করবে মমতাজ।
বাচ্চা হওয়ার জন্য ৬ মাস ছুটি নিয়ে বাপের বাড়িতে এসেছিল মমতাজ। এই ৬ মাস খুব সুখে সময় কাটিয়েছে। স্বামী বাদল প্রতি সপ্তাহে অনেক জিনিস নিয়ে তার কাছে যেত। মেয়ে হওয়ার পর প্রথম যেদিন গিয়েছিল, সেদিন খুব ছোট একজোড়া কানের সোনার দুল আর রুপার পায়ের নূপুর নিয়ে যায়।
স্বামী বলেছিল, বিয়ের পর থেকেই মনে হচ্ছিলযদি তোমার ঐ রাঙা পায়ে নিজের হাতে সোনার নূপুর পরিয়ে দিতে পারতাম। মমতাজ বলেছেতুমি যে ভেবেছ, চেষ্টা করেছ তাতেই আমার সখ পূরণ হয়েছে।
মেয়ের বিয়েতে আমরা তাকে সোনার নূপুর পরাব, ঠিক আছে? দু’জন হেসে কুটিকুটি…।
মেয়ের বয়স ৬ মাস হলে মমতাজ ঢাকায় চলে আসে। আবার গার্মেন্টসে যোগদান করে।
এবার যখন মমতাজ গার্মেন্টসে আসে, তখন গার্মেন্টস ভবনের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ভবন বর্ধিত করে ৯ তলা করা হয়েছে। মমতাজ যখন প্রথম এসেছিল, তখন ছিল মাত্র ৩ তলা। ৫ বছর পর ভবনের চারপাশ দিয়ে কলাম দিয়ে করা হয়েছে পাঁচ তলা। এবার গ্রাম থেকে এসে সে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে নাএকেবারে ৯ তলা; কি যে ভালো লাগছে! এতবড় অফিসে সে এত বছর ধরে চাকরি করছে। দেখলেই মন ভরে যায়। সামনের দিকটাতে খুব সুন্দর কালারের টাইলস লাগানো হয়েছে, বড় বড় কলাম কারুকার্য খচিত, বিভিন্ন কালারের লাইট লাগানো হয়েছে। গেটের উপরে সুন্দর অক্ষরে এবং রঙিন আলোতে লেখা কুইন এপারেল ইন্ড্রাস্টি যে কেউ দেখলেই বলবে চমৎকার। এমন একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়া সাত জনমের পুণ্যের ফল।
মেয়ের জন্মের পর বাদলের বেতনও বেড়েছে; মেয়ের ভাগ্য ভালোÑদেখতেও হয়েছে মায়ের মতো ফুটফুটে সুন্দর। বাদল বলেমমতাজ তোমার মেয়ে তোমার মতোই স্বামী সোহাগী হবে। মমতাজ লজ্জায় রাঙা হয়। হেসে বলেমেয়ের বয়স ৬ মাস ১৬ বছর নয়, দু’জনে হেসে কুটিকুটি। এভাবে হাসি আনন্দে কাটে কয়েকটি দিন কয়েকটি রাত। ৬ মাস পর স্ত্রীকে পেয়ে বাদল যেন মমতাজের কাছ ছাড়া হতে চায় না।
সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। ভোর ৫টায় মমতাজ ঘুম থেকে উঠে রান্না করে ছেলেকে ভাত খাওয়ায়, মেয়েকে বুকের দুধ দেয়। স্বামী, শাশুড়ি এবং নিজে একসাথে বসে ভাত খায়। গার্মেন্টসে যাওয়ার আগে মমতাজ শাশুড়িকে বলেন,‘আম্মা বাবুকে সারাদিন কোলে রাখতে আপনার কষ্ট হচ্ছে বেতন পেয়ে একটা দোলনা কিনে আনবো। আর কাল ছুটির দিন, সবাই মিলে পার্কে ঘুরে একটু খালার বাসায় বেড়াতে যাব।’ এরপর বাচ্চাদের আদর করে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে নিয়ে বুক ভরা আশা নিয়ে দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে গার্মেন্টসের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।
কারখানায় পৌঁছেই মমতাজ দেখতে পায় অনেক লোক। তার খেয়ালই ছিল নাÑগতকাল গার্মেন্টস ভবনে ফাটল দেখা গিয়েছিল। তাই কেউ ভেতরে ঢুকতে চাচ্ছে না। তার রুমের মেয়ে রোকেয়া এসে বলছে, ‘মমতাজ আপা গোলাপী শাড়ি, চুড়িতে তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। তোমার নূপুরটাও খুব সুন্দর হয়েছে। মমতাজ বলছে, ‘এখন জীবন-মরণ সমস্যা আর তুই দেখছিস নূপুর। রোকেয়া বলেÑচলো কাজ করি। মমতাজ বলেনারে রোকেয়া ভয় লাগছে। আমি মরে গেলে আমার দুইটা বাচ্চা এতিম হবে। বাচ্চার বাবার হার্ট অ্যাটাক হবে। মমতাজের কথা শুনে রোকেয়া হাসে। কিন্তু না; শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সবাইকেই ঢুকতে হলো কারখানায়। মমতাজ বললচল আল্লাহ ভরসা, বাবুর আব্বুও ঢুকেছে।
মমতাজ স্বভাব সুলভ কাজ শুরু করে। টিফিন ক্যারিয়ার রেখে ওয়াশরুমে যায়, হাত মুখ ধুয়ে বোতল বের করে একটু পানি খেয়ে মেশিনে বসে।
ঘণ্টাখানেক পর কেমন একটি শব্দ পায়; মমতাজের কাছে ঝড়ের শব্দ মনে হয়। বাদলকে ডাকেÑএই তুমি কোথায়, কিসের শব্দ? বাদল চিৎকার করে বলেÑবের হও, আপনারা সবাই বের হন। কারখানা ভেঙে পড়ে যাচ্ছে…। রোকেয়া চিৎকার করেÑমমতাজ আপা, বাদল পিছনে ফিরে দেখে ছাদ পড়ে রোকেয়ার হাত আটকে আছে।
মমতাজ কোথায়? মমতাজ মমতাজ বলে চিৎকার করতে করতে এক সময় চোখ আটকে যায়Ñএকি? একটি পা দেখা যাচ্ছে। কার পা? গোলাপী শাড়ির লাল পাড়, রুপার সাদা ঝকঝকে নূপুর এই তো মমতাজ, আমার মমতাজ, রডের ফাঁকে মুখটাও একাংশ দেখা যাচ্ছে, চোখ খোলা। পা’টা এখনো নড়ছে। বাদল চিৎকার করছে, বাদলের শরীরের সর্বশক্তি ভাঙা ছাদ সরানোর জন্য যথেষ্ট নয়। বাদল চিৎকার করে বলেÑমমতাজ তুমি মরবে না, আমি তোমার জন্য তাজমহল গড়তে পারব না, তুমি আমার সন্তানদের জন্য বেঁচে থাকো। বাদলের কান্নায় ভারি হয় বাতাস; কিন্তু মমতাজের প্রাণ রক্ষা হয় না। দুধের বাচ্চার বুক ফাটে তৃষ্ণায়। ছেলে বলেÑ‘বাবা মাকে বের করে আনো।’ কিন্তু কার সাধ্য মমতাজকে বাঁচায়?
এই শিশুদের কান্না থামাবে কে? মমতাজের পায়ের তালু দেখা যাচ্ছে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত, পা’সহ চকচক করছে তার নূপুর। মমতাজের পা কি ইঙ্গিত করছে? এটা কিসের নিদর্শন? পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছে। কোটি কোটি মানুষের মনে প্রশ্ন কেন এভাবে মানুষ মরবে? প্রশ্নের পর উত্তরও এসে যায়-কারণের সূতিকাগারে সাবধান হতে হয়।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১১:৫৬:০১ ১১৭৬ বার পঠিত #স্তব্ধ নূপুর