বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ আজকের দিনের শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যত। কারণ আজকে যাকে আমরা শিশু হিসাবে দেখছি সময়ের অমোঘ নিয়মে আগামীতে সে হয়ে উঠবে দায়িত্বশীল পিতা/মাতা এবং ভবিষ্যত নাগারিক।তাই একটি জাতিকে সুস্থ, সবল ও দক্ষ মানবসম্পদ হিসাবে গড়ে তুলতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নিরোগ, স্বাস্থ্যবান ও সুস্থভাবে বেড়ে উঠা শিশুর উপর।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে যে হারে বায়ু, মাটি, পানি ও খাদ্য দূষণ বাড়ছে তাতে নবজাতক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের শিশুরা নানাবিধ রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। জীবনীশক্তি লোপ পেয়ে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠা প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ইউনিসেফের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সারাবিশ্বে ১ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা হচ্ছে প্রায় ২২০ কোটি। এরমধ্যে উন্নয়নশীল বিশ্বে এ সংখ্যা হচ্ছে- প্রায় ১৯০ কোটি। সারাবিশ্বে দারিদ্রের মধ্যে বসবাসকারী শিশুর সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি।
দক্ষিণ এশিয়ায় ১ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত বয়স্ক শিশুর সংখ্যা হচ্ছে প্রায় ৬০ কোটি। এরমধ্যে বাংলাদেশে ১ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত বয়স্ক শিশুর সংখ্যা হচ্ছে- ৭ কোটি।
সারাবিশ্বে প্রায় ৬০ কোটি ৪০ লক্ষ শিশু আশ্রয়হীনভাবে বেড়ে উঠছে। ৪০ কোটি শিশু বিশুদ্ধ পানীয় জলের সুযোগ, ২০ কোটি ৭০ লাখ শিশু স্বাস্থ্যসেবা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এ সব সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে প্রতি বছর প্রায় ৭৫ লাখ শিশু তার জন্মের পঞ্চম বছরে পদার্পন করার আর্গেই মারা যায়।
অথচ এ মৃত্যু ইচ্ছে করলে প্রতিরোধ করা যায়। ইউনিসেফ পরিচালিত বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও আঘাত সংক্রান্ত জরিপে দেখা যাচ্ছে- বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১৮ হাজার শিশু শুধুমাত্র সাঁতার না জানার কারণে পানিতে ডুবে মারা যায়।
অথচ প্রত্যেক শিশুকে যদি শুরুতেই সাঁতার শিখানো যায়, তবে এ ধরণের অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা অনায়াসেই দূর করা যায়। বস্তুত: এক বছরের অধিক বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া, টিবি বা পোলিও রোগের চেয়ে বেশী প্রাণহারী।
বিবিএস পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা হচ্ছে ১৬ কোটি। আর এ জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ অর্থাৎ ৭ কোটি ২০ লক্ষ হচ্ছে ১ থেকে ১৮ বছর বয়স্ক।
বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির মধ্যে ১৫ বছরের নীচে শিশুর সংখ্যা প্রায় ১০.১ শতাংশ। ইউনিসেফ পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট শিশুদের প্রায় ৪৫ শতাংশ জাতীয় দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে। এদের সংখ্যা হবে প্রায় ৩ কোটির অধিক। এসব শিশুদের মাঝে আবার ৪১ শতাংশের কোন আশ্রয় নেই।
আবার ৬৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃসেবা থেকে বঞ্চিত। ৫৭ শতাংশ দৈহিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না। ১৬ ভাগ স্বাস্থ্য সেবা এবং ৩ ভাগ শিশু সুপেয় পানীয় জল থেকে বঞ্চিত। আর এসমস্ত বঞ্চনার সাথে যখন যোগ হয় পরিবেশ দূষণ, তখন হত-দরিদ্র, সুবিধা-বঞ্চিত পরিবারের শিশুরা মারাত্মকভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আক্রান্ত হয়।
পরিবেশ দূষণের কারণে আমাদের বাংলাদেশের শিশুরা প্রতিনিয়ত মৃত্যু ছাড়াও বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রথমে বলে রাখতে চাই, শিশুরা কিন্তু পূর্ণাঙ্গ মানব-মানবী নয়। জৈবিক, দৈহিক ও মানসিক গঠনে তারা স্বতন্ত্রমন্ডিত এবং একই কারণে ভঙ্গুর ও সংকটাপন্ন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী সারা বিশ্বে ১৫ বছরের নীচে প্রায় ১ কোটি শিশু বিভিন্ন পরিবেশ দূষণ জনিত কারণ- দূষিত পানি, খাবার এবং দুর্ঘটনায় মারা যায়। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া হচ্ছে অন্যতম।
বস্তুত: এক বছরের অধিক বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া, টিবি বা পোলিও রোগের চেয়ে বেশী প্রাণহারী। এদের মধ্যে ৯০ ভাগের বয়স হচ্ছে ৫ বছরের নীচে।
শরীরের ওজন অনুপাতে শিশুরা একজন পূর্ণাঙ্গ বয়স্ক মানুষের চেয়ে বেশী শ্বাস নেয়। খাদ্য হজম করে এবং বিষাক্ত টক্সিন গ্রহণ করে। এ বাস্তবতার কারণে শিশুরা বয়স্কদের চেয়ে অনুপাতিক হারে পরিবেশ দূষণজনিত রোগ-শোকে ভোগে।
পরিনামে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কম বয়সের কারণে শিশুরা যেহেতু তাদের বৈধ অধিকার সম্পর্কে কম ওয়াকিবহাল এবং পরিবার ও সমাজকে কম প্রভাবিত করেতে পারে- তাই সমাজ ও রাষ্ট্রে তারা বৈষম্যমূলকভাবে অধিক মৃত্যু ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাবে একটি মানব শিশুর মাতৃজঠরে জীবনের সূচনা থেকে জন্মলাভ এবং পরবর্তীতে শিশুকাল থেকে কৈশোরের দ্রুত বেড়ে ওঠার বিভিন্ন পর্যায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
যেমন- একটি শিশুর বেড়ে ওঠার প্রথম বছরে তার স্নায়ুতন্ত্র বিকশিত হতে থাকে। তাই, পরিবেশের বিরূপ প্রভাবে এসময় তার স্নায়ুতন্ত্র কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা আর পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় না।
কোন কারণে বিকাশমান ব্রেইন কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা স্নায়ু কোষের সাথে এর সংযোগ স্থাপন ব্যাহত হলে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশকে চিরতরে রূদ্ধ করতে পারে এবং অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হতে পারে।
সারা বিশ্বের প্রায় এক চতুর্থাংশ রোগের বোঝার (গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিস) কারণ পরিবেশ সংক্রান্ত দূষণের ঝুঁকি থেকে বলে ধারণা করা হয়। আর এর মধ্যে ৪০ শতাংশ রোগের বোঝায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাঁচ বছরের নীচের শিশুরা।
অথচ জনসংখ্যার অনুপাতে এরা হচ্ছে মাত্র ১০ শতাংশ। সারা বিশ্বেও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা যে পাঁচটি রোগকে শিশুদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর নির্ধারণ করেছেন তা হচ্ছে- জন্মপূর্ব অসুস্থতা, শ্বাসরোগ, ডায়রিয়া এবং শারিরীক আঘাত (ব্রিগস, ২০০৩)।
পরিবেশ দূষণের কারণে জন্মপূর্ব অসুস্থতা সারাবিশ্বে শিশুমৃত্যুর এবং শিশুদের অসুস্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হিসাবে দেখা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে- পরিবেশগত কারণ বিশেষত: শিশু জন্মের পূর্বে ও পরে মায়ের দৈহিক স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি শিশুস্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে।
তাই, নবজাতককে জন্মপূর্ব এ সকল রোগ ও মৃত্যু ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন প্রসূতির জন্য শিশুর জন্ম পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টিকর খাবার এবং পরিবেশ সম্মত আবাসস্থল।
নবজাতক এবং শিশুদের মৃত্যুর দ্বিতীয় আরেকটি কারণ হচ্ছে- শ্বাসকষ্ট জনিত রোগ। রোগসৃষ্টিকারী প্যাথোজেন ছাড়াও গৃহাভ্যন্তরে ও বাইরে শিশুরা অব্যাহতভাবে বায়ু দূষণের শিকার হওয়ায় তারা মারাত্মক শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে ভুগছে।
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারসমূহে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবন যাপন, পয়ঃনিষ্কাশনে অব্যবস্থা, সুপেয় পানীয় জলের অভাব এবং দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে ডায়ারিয়া, কলেরা ইত্যাদি পানিবাহিত রোগের প্রকোপ অনেক বেশী।
আর এর সাথে পরিবেশগত এবং সামাজিক সমস্যাদি যুক্ত হয়ে এ সমস্যাকে আরো প্রকট করেছে। বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ যেমন- ডায়রিয়া, কলেরায় আক্রান্ত হয়ে অনেক শিশু মারা যায়।
কারণ ডায়ারিয়া ও কলেরা শিশুদের মধ্যে পানিশূণ্যতা বৃদ্ধি করে। তাই, বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ হচ্ছে এ সকল পানিবাহিত রোগ।
শিশুদের মৃত্যুর আরেকটি কারণ হচ্ছে- প্রতিকারযোগ্য আঘাত বা আহত হওয়া জনিত মৃত্যু। খেলার মাঠের অভাব, বাসস্থানের অভাব, বেপরোয়া গাড়ী চালনার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা এবং উম্মুক্ত ময়লা আর্বজনার জীবানুর আক্রমণে অনেক শিশু অকালেই প্রাণ হারায়।
মাতৃজঠরে থাকাকালীন, চামড়ার মাধ্যমে, শ্বাস বা খাদ্যের মাধ্যমে একটি শিশুর দেহে বিষাক্ত টক্সিন বা টক্সিন জাতীয় উপাদান প্রবেশ করতে পারে।
এসকল বিষাক্ত টক্সিনের কিছু কিছু উপাদান সরাসরি মাতৃজঠরের প্ল্যাসেন্টায় প্রবেশ করে। পরবর্তীতে এগুলো ভ্রণ সংগঠিত হওয়ার প্রাক্কালে মায়ের রক্ত এবং অ্যামোনিক তরলের মাধ্যমে বর্ধিঞ্চু ভ্রণে প্রবেশ করে।
তাছাড়া, জন্মের প্রথম ২/৩ দিন নব জাতকের চামড়া যেহেতু পাতলা থাকে তাই চামড়ার মধ্য দিয়ে ও কিছু বিষাক্ত টক্সিন তার দেহে প্রবেশ করে। জন্মের পর একজন নবজাতকের চামড়া তার মাংসের তুলনায় তিনগুণ বেশী বিস্তৃত থাকে।
আর শিশুটি একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের তুলনায় দ্বিগুণ বিস্তৃত চামড়া থাকে। যদিও বাংলাদেশ শিশু নীতিমালা ২০১৩ তে শিশুদের জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির তাগিদ দেয়া হয়েছে।
কিন্তু দেশের বিদ্যমান বাস্তবতা, অসচেতনতা এবং চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী পরিবারগুলোর পক্ষে এমন একটি মানবিক পরিবেশ যা কবি সুকান্তের ভাষায় নবজাতকের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী সৃষ্টি করা অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও এখনো সম্ভব হয়নি।
তবে আমাদের লক্ষ্য হোক- একটি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত এবং শিশুর জন্য উপযুক্ত একটি আবাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তোলা। সরকার, বিভিন্ন দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক সংস্থা এবং হৃদয়বান মানুষের সহযোগিতা নিয়ে এ লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
লেখক, পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট)
পরিবেশ অধিদপ্তর।
বাংলাদেশ সময়: ৮:৫৫:১৬ ৫১২ বার পঠিত