বঙ্গ-নিউজঃ পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে সার্ক সম্মেলন কিংবা সার্ক-টু! শুনতে বিস্ময়কর লাগলেও কাশ্মিরের উরি হামলা পরবর্তী কূটনীতিতে এই ‘ব্যবস্থা’কেই আগামী মাসে বাস্তব চেহারা দিতে চাইছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যেই তৈরি হয়েছিল সার্ক। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান বৈরিতার কারণে সেই সহযোগিতা ভেস্তে যেতে বসেছে। ভারত এজন্য পাকিস্তানকেই দায়ী করে আসছে।
সর্বশেষ ইসলামাবাদে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও তা ভণ্ডুল হয়ে গিয়েছে ভারত-পাকিস্তান ‘যুদ্ধ’ পরিস্থিতিতে। আয়োজক দেশ পাকিস্তান ছাড়া জোটের বাংলাদেশসহ বাকি ৭টি দেশই বয়কট করছে সম্মেলন। সন্দেহ নেই, এই বয়কট-পর্বের পিছনে রয়েছে ভারতের প্রত্যক্ষ কূটনীতি।
এমন পরিস্থিতিতে এ বার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে সহযোগিতা ও উন্নয়নের নতুন ছক নিয়ে এগোতে চাইছে ভারত। যেখানে পাকিস্তানের কোনও ঠাঁই হবে না। লক্ষ্য মূলত তিনটি- সন্ত্রাসে মদত জুগিয়ে চলা পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলা ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের কোণঠাসা করা, পাকিস্তানের হস্তক্ষেপে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে যে সব প্রকল্প থমকে বা ঝুলে আছে, সেগুলোর পথ সুগম করা এবং সার্কের সদস্য নয়, এমন দেশগুলির সঙ্গেও সহযোগিতা বাড়ানো।
সার্ক ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে সহযোগিতার আরও কিছু মঞ্চ বা জোট আগে থেকেই রয়েছে। কিন্তু সেগুলোতে কাজের কাজ তেমন হচ্ছিল না। ভারত এ বার সেই মঞ্চগুলোকে চাঙ্গা করতে চায়। এগুলোতে পাকিস্তান বাদে সার্কের বাকি সব দেশকে যাতে কোনও না কোনও ভাবে যুক্ত করা যায়, সে ব্যাপারেও তৎপর দিল্লি।
যেমন আগামী মাসে গোয়ায় বিমস্টেক সম্মেলন। বিমস্টেকের পুরো কথাটি হলো ‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টোরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকনমিক কোঅপারেশন’। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার ও তাইল্যান্ড- সাত দেশের এই জোটের প্রথম পাঁচটিই সার্ক-সদস্য। গোয়ায় বিমস্টেক সম্মেলনে এই দেশগুলিকে নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমন্বয় ও যোগাযোগ বাড়ানোর নকশা তৈরি করবে ভারত।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, সার্ক সদস্য মলদ্বীপ ও আফগানিস্তানকেও যাতে গোয়ায় বিমস্টেক-এর পর্যবেক্ষক দেশ হিসেবে নেওয়া হয় তার জন্য জোরালো আবেদন করবে ভারত। এখনও পর্যন্ত যা ইঙ্গিত, তাতে এ ব্যাপারে সর্বসম্মতি পাওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ পাকিস্তানকে সরিয়ে রেখে সার্কের বাকি সব ক’টি দেশকেই বিমস্টেক-এর মঞ্চে নিয়ে আসার কাজ প্রায় সম্পূর্ণ।
মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার মতে, সন্ত্রাসবাদ প্রশ্নে আঞ্চলিক স্তরে পাকিস্তানকে চাপে রাখার একটা কৌশল তো রয়েছেই, অর্থনৈতিকভাবে যদি ইসলামাবাদকে কোণঠাসা করা যায়, তবে তাদের মদত পুষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলোও দুর্বল হবে। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তানকে আঞ্চলিক উদ্যোগগুলি থেকে বাইরে রাখতে পারলে বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রেও বাড়তি গতি আসবে। কর্মকর্তা বলেন, ‘আঞ্চলিক বাণিজ্য, শক্তি, সড়ক সংযোগের মতো বহু ক্ষেত্রেই এগোনো সম্ভব হচ্ছে না পাকিস্তানের কারণে।’
নয়াদিল্লির কূটনৈতিক কর্মকর্তারা মনে করেন, সার্ককে ক্রমশ অকেজো করে দিয়ে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে তাদের ‘মেগা’ বাণিজ্যিক পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ৫ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করে বেইজিং অর্থনৈতিক করিডোর করছে ইসলামাবাদের সঙ্গে, যাতে এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলির ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই।
পাকিস্তানে দায়িত্ব পালন করা ভারতের সাবেক হাইকমিশনার জি পার্থসারথি বলেন, ‘পাকিস্তান সম্পর্কে এখন ভারতের মনোভাবটি হলো, তোমরা চীনের সঙ্গে যা করছ কর। আমরা আমাদের মতো উন্নয়নের দিকটি বুঝে নেব। তাই পাকিস্তান যে দিকে হাঁটছে, আমরা (ভারত) তার বিপরীত পথে হেঁটে বাকি রাষ্ট্রগুলিকে আমাদের সঙ্গী করে নেব।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত সার্ক স্যাটেলাইট প্রকল্প, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মোটর ভেহিক্যাল চুক্তি, ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তান সড়ক চুক্তি- এই সব ক’টিই মুখ থুবড়ে পড়েছে শুধু পাকিস্তানের অসহযোগিতায়। ভারত তাই পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালকে নিয়ে (বিবিআইএন) মোটর ভেহিক্যাল চুক্তি বাস্তবায়িত করতে চলেছে। পাকিস্তানকে এড়িয়েই ইরান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে চুক্তি করে পশ্চিম এশিয়ার পণ্য পাঠানোরও ব্যবস্থা করতে তৎপর নয়াদিল্লি। গোয়ায় বিমস্টেক সম্মেলনটি হবে ১৬ তারিখ। সেখানে ৪টি বিষয়ের ওপর কৌশল তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা। এগুলি হলো: শিল্প-বাণিজ্য, পরিবহণ-যোগাযোগ, শক্তি ক্ষেত্রে বাণিজ্য এবং আবহাওয়া পরিবর্তন।
শুধু বিমস্টেকই নয়। পাকিস্তানকে বাইরে রেখে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য নিস্তেজ হয়ে পড়া ‘সাব-রিজিওনাল মেকানিজম’ তথা উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা ব্যবস্থাতেও এ বার অক্সিজেন জোগানোর দিকে মন দিচ্ছে মোদি সরকার। যেমন ২০০১-এ তৈরি হয়েছিল সাসেক তথা ‘সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন প্রোগ্রাম’। এর সদস্য দেশগুলো হলো, ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, মলদ্বীপ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা। তৈরি হওয়ার পর থেকে কার্যত কুম্ভকর্ণ দশা চলছিল সাসেক-এর। উরি হামলার পর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে ভারতেরই নেতৃত্বে একটি কর্ম-পরিকল্পনা (প্ল্যান অব অ্যাকশন) তৈরি হয়েছে। ২০১৬ থেকে ২০২৫, আগামী দশ বছরের প্রস্তাবিত বাণিজ্য এবং শক্তিপ্রকল্পগুলি চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। সূত্র: আনন্দবাজার।
বাংলাদেশ সময়: ৯:২৮:৫৩ ৪০০ বার পঠিত