বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল সেই কবি যিনি তাঁর যুগের দাবিও পূরণ করেছেন, চিরকালের মানুষের জন্যও রেখে গেছেন তাঁর শাশ্বত বাণী। তাঁর সৃষ্টির বাণী প্রাসঙ্গিকতা কোনোদিনই ফুরোবে না। সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উড়িয়ে ধূমকেতুর মতো আকস্মিকভাবে যে নজরুলের আবির্ভাব সেই নজরুলের আর যে বিষয়টিতে নজরুল ছিলেন সাবলীল প্রবক্তা তা হলো নারীমুক্তি। ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধের কারণে নারীকে বন্দি করে রেখে সামাজিক অগ্রগতি অর্জন যে অসম্ভব এই বিশ্বাসে তিনি ছিলেন অবিচল। নারীমুক্তি প্রশ্নে তাঁর সময়ে এত কঠোর অবস্থান আর কেউই নেননি।
সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বর্তমান সময়ের আলোচিত একটি বিষয়। প্রায় এক শ’ বছর আগে নজরুল সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিদ্বেষ যারা সমাজে ছড়ায় এবং তা নিয়ে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে, তারা যে ধর্মাবলম্বীই হোক, তাদের নজরুল বলেছেন পশু এবং নিরীহ পশু নয়, সেই শ্রেণীর হিংস দাঁত-নখ-শিংঅলা পশু যে অন্যকে আঘাত করে রক্তাক্ত করে। তিনি যে ভাষায় সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদকে আঘাত করেছেন সরাসরি সোজা ভাষায় এবং তাদের বোধগম্য ভাষায় যা আজ হয়তো বলা সম্ভব নয়।
বিশের দশকে যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে তখন ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িকতার সমস্যাটি ছিল নজরুলের প্রধান উদ্বেগের বিষয়। ভারতবর্ষ স্বাধীন হলেও হিন্দু-মুসলমানের সমস্যা থেকে গেলে শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা বিঘ্নিত হবে এটি ছিল তাঁর উদ্বেগের প্রধান কারণ। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার মতো সাম্প্রদায়িকতাবিরোধিতাও হয় নজরুলের প্রধান কাজ। হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা নিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও আলোচনা করেন। বিশের দশকে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা যখন রক্তাক্ত দাঙ্গা পর্যন্ত গড়ায়, নজরুল তখন কবিতা ও গদ্য রচনায় তার প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন, ‘হিন্দু মুসলমানি কাণ্ড’ বেধে যাওয়ার পর দুই সম্প্রদায়ের দাঙ্গা-হাঙ্গামায় পরস্পরের মার খেয়ে ‘হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি পড়িয়া থাকিয়া এক ভাষায় আর্তনাদ করিতেছে, ‘বাবাগো, মাগো’ মাতৃপরিত্যক্ত দুটি বিভিন্ন ধর্মের শিশু যেমন করিয়া এক স্বরে কাঁদিয়া তাহাদের মাকে ডাকে।’ [মন্দির ও মসজিদ] তিনি লিখেছেন, ‘দেখিলাম, হত-আহতদের ক্রন্দনে মসজিদ টলিল না, মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিল না। শুধু নির্বোধ মানুষের রক্তে তাহাদের বেদি চির-কলঙ্কিত হইয়া রহিল।’ সাম্প্রদায়িক হানাহানিকারীদের নজরুল বলেছেন ‘ধর্ম-মাতাল’। তাঁর ভাষায়, ‘ইহারা ধর্ম-মাতাল। ইহারা সত্যের আলো পান করে নাই, শাস্ত্রের অ্যালকোহল পান করিয়াছে।’ মাত্রার বেশি অ্যালকোহল বা মদ পান করলে যেমন মাতালের পরিণতি অবধারিত মৃত্যু, তেমনি ধর্ম নিয়ে যারা বাড়াবাড়ি করে সেই সব ‘ধর্ম-মাতাল’-এরও করুণ পরিণতির কথা বলেছেন নজরুল। মুসলমান সমাজে নজরুলের চেয়ে বেশি হিতার্থী আর কেউ ছিলেন না, কিন্তু সেই মুসলমান সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল নেতারা তাঁর সমালোচনাকে সহজভাবে গ্রহণ করেননি। আত্মসংশোধনের কথা না ভেবে তাঁরা বরং আক্রমণ করেছেন নজরুলকেই। রক্ষণশীল মুসলমান সমাজের নেতারা তাঁকে বুঝতে পারেননি। তাঁকে কাফের পর্যন্ত আখ্যা দিয়েছেন। তাতে তিনি কষ্ট পেয়েছেন। দুঃখ করে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁকে লিখেছিলেন: বাংলার মুসলমান সমাজ ধনে কাঙ্গাল কি না জানিনে, কিন্তু মনে যে কাঙ্গাল এবং অতি মাত্রায় কাঙ্গাল, তা আমি বেদনার সঙ্গে অনুভব করে আসছি বহুদিন হতে। আমায় মুসলমান সমাজ ‘কাফের’ খেতাবের যে শিরোপা দিয়েছে, তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি। একে আমি অবিচার বলে কোনোদিন অভিযোগ করেছি বলে তো মনে পড়ে না। তবে আমার লজ্জা হয়েছে এই ভেবে, কাফের-আখ্যায় বিভূষিত হওয়ার মতো বড় তো আমি হইনি অথচ হাফেজ-খৈয়াম-মনসুর প্রভৃতি মহাপুরুষদের সঙ্গে কাফেরের পঙ্ক্তিতে উঠে গেলাম!
নজরুলের ভাষায়, ‘ইসলামের সত্যকার প্রাণশক্তি, গণশক্তি, গণতন্ত্রবাদ, সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব ও সমানাধিকারবাদ। ইসলামের এই অভিনবত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব আমি তো স্বীকার করিই, যাঁরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী নন, তাঁরাও স্বীকার করেন।’
ইসলাম ধর্মের শাশ্বত বাণী নজরুল এক শ’ বছর আগে উপলব্ধি করেছেন, এর বাড়াবাড়ি নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন, তা করতে গিয়ে নাস্তিক উপাধি পেয়েছেন তবু তিনি হারেননি, হাল ছাড়েননি। নিজ বিশ্বাস ও অবস্থান থেকে লড়াই করে টিকে থেকেছেন। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ প্রশ্নে নবপ্রজন্মও হারবে না, পিছু হটবে না। কারণ তারাও যে নজরুলের উত্তরসূরি এর প্রমাণ তো ইতোমধ্যে মিলেই গেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩:১৫:২০ ৪৭১ বার পঠিত