কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে অ্যামোনিয়া গ্যাস যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সে ব্যবস্থা চট্টগ্রামের আনোয়ারার ডিএপি (ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট) সার কারখানায় ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দুর্ঘটনার ১৬ ঘণ্টা পর গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে কারখানা এলাকায় গিয়ে অ্যামোনিয়া গ্যাসের তীব্র ঝাঁজালো গন্ধ পাওয়া যায়। গ্যাস নিঃসরণ বন্ধে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের গতকাল বিকেলেও দুর্ঘটনাস্থলে পানি ছিটাতে দেখা গেছে।
গত সোমবার রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে আনোয়ারা উপজেলার রাঙাদিয়া গ্রামে ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সার কারখানার ১ নম্বর ইউনিটে তরল অ্যামোনিয়া গ্যাসের একটি ট্যাংক বিকট শব্দে ফেটে যায়। তখন কারখানাটির উৎপাদন বন্ধ ছিল। কারখানার কর্মকর্তারা জানান, প্রায় ৫০০ টন ধারণক্ষমতার ট্যাংকটিতে দুর্ঘটনার সময় প্রায় ২৫০ টন অ্যামোনিয়া গ্যাস ছিল। ছড়িয়ে পড়া গ্যাসের প্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া ৫২ জনকে সোমবার রাতেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সাংবাদিকদের জানান, কারখানার ভেতরে অ্যামোনিয়া গ্যাসের একটি ট্যাংকে বিস্ফোরণ ঘটায় গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে।
কারখানার কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে পর্যাপ্ত পানি ছিটানোর ব্যবস্থা থাকা দরকার। কারণ, পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাস দ্রবীভূত হয়ে যাওয়ায় গ্যাস বেশি ছড়াতে পারে না। কারখানার চারপাশে কৃত্রিম বৃষ্টির ব্যবস্থা থাকা দরকার ছিল।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক বেনু কুমার দে প্রথম আলোকে বলেন, অ্যামোনিয়া গ্যাস নিঃসরিত হলে পর্যাপ্ত পানি ছিটিয়ে মাত্রা কমানোই একমাত্র ব্যবস্থা। কারণ, অ্যামোনিয়া বাতাসের চেয়ে হালকা। দ্রুত অনেক ওপরে উঠে যায়। এ কারণে প্রচুর পানি ছিটানো হলে অ্যামোনিয়া পানিতে দ্রবীভূত হয়। সেই পানি একটি ট্যাংকে সংরক্ষণ করে ধীরে ধীরে ছেড়ে দেওয়া হলে ভালো। তবে যতটুকু জানা গেছে, তাতে মনে হয়েছে, ট্যাংকে গ্যাসের চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ব্যবস্থা ছিল, তা কার্যকর হয়নি।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনা সামাল দেওয়ার সামর্থ্য কারখানা কর্তৃপক্ষের ছিল না। তাদের কিছুটা কারিগরি সহযোগিতা করেছে কাফকো। পরে তিনি ফায়ার সার্ভিসকে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে যেতে বলেন। ফায়ার সার্ভিস রাত ১১টা ২৫ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এ ঘটনায় কারও গাফিলতি ছিল কি না, তা তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখছে।
দুর্ঘটনার সময় ঘটনাস্থলের ৪০ হাত দূরে ছিলেন কারখানার স্কিল টেকনিশিয়ান আতিকুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক পালার দায়িত্ব শেষে গাড়ির জন্য কারখানা চত্বরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দে ট্যাংকটি ৫০ গজ দূরে গিয়ে পড়ে। এরপর যাঁরা কারখানায় ছিলেন, সবাই দৌড়ে মূল ফটকের দিকে চলে যান। গ্যাসের গন্ধে আমার পেট ফুলে যায়।’
দুর্ঘটনার সময় কারখানার পাশের পুকুরে মাছের প্রকল্পে অবস্থান করছিলেন মো. জামাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিকট শব্দ হওয়ার পর গ্যাসের গন্ধে দৌড় দিই। দক্ষিণ দিকে গিয়ে দেখি, অনেক মানুষ আতঙ্কে দৌড়াচ্ছে। ভোরে এসে দেখি, গ্যাসের মাত্রা কিছুটা কমেছে।’
কারখানার কর্মকর্তারা জানান, এই কারখানায় তিনটি ট্যাংক রয়েছে। বড় ট্যাংকটিতে ৫ হাজার লিটার এবং ছোট দুটি ট্যাংকে ৫০০ লিটার করে অ্যামোনিয়া গ্যাসের ধারণক্ষমতা রয়েছে। কারখানার অদূরে কাফকো সার কারখানা থেকে তরল অ্যামোনিয়া গ্যাস এনে এই কারখানায় রাখা হয়। এসব ট্যাংক থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস এবং আরও দুটি কাঁচামালসহ (ফসফরিক অ্যাসিড ও সালফিউরিক অ্যাসিড) প্ল্যান্টে ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট সার তৈরি করা হয়।
গতকাল বেলা ১১টা থেকে তিনটা পর্যন্ত দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশের এলাকা ঘুরে অ্যামোনিয়া গ্যাসের তীব্র ঝাঁজালো গন্ধ পাওয়া যায়। কারখানার পাশের সড়ক এড়িয়ে চলার জন্য ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা লাল ফিতা টেনে দিয়েছেন। পাশের পুকুর থেকে পানি নিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে ছিটানো হচ্ছিল। গ্যাসের ট্যাংকটি যেখানে ছিল, এর অন্তত ৫০ গজ দূরে তা ছিটকে পড়েছে। ট্যাংকের মুখ দুমড়ে-মুচড়ে গেছে।
বেলা তিনটায় চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক জসীম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার প্রায় এক ঘণ্টা পর থেকে ফায়ার সার্ভিস কাজ শুরু করে। বেলা ১১টায় পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে।
কারখানার পাশের সিইউএফএলের বিশ্রামাগারে ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অমল কান্তি বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার সময় বাতাস ছিল পশ্চিমমুখী। বাতাসের টানে অ্যামোনিয়া গ্যাস নদীর ওপারে চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা ও বন্দর এলাকা হয়ে হালিশহরের দিকে চলে যায়। রাত দুইটার পর বাতাস দক্ষিণমুখী ছিল। তখন দক্ষিণ দিকে ছড়িয়েছে গ্যাস।দুর্ঘটনার পর কৌতূহলী লোকজনের ভিড় এড়াতে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ডিএপি সার কারখানার ভেতরের রাস্তায় সতর্কতা-নির্দেশক টাঙানো হয়েছে। ছবিটি গতকাল দুপুরে তোলা l প্রথম আলো
দুর্ঘটনার পর পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চাইলে অমল কান্তি বড়ুয়া বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর অসুস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরিয়ে নেওয়ার দিকে প্রথমে গুরুত্ব দিয়েছি। এরপর সিইউএফএল ও কাফকোর নিরাপত্তা-সরঞ্জাম ব্যবহার করে গ্যাসের মাত্রা কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস আসার পর পুরোদমে কাজ চলেছে।’
দুর্ঘটনা, না নাশকতা: কারখানাটি ২০০৬ সালে চালু করা হয়। সে হিসেবে এই কারখানার ফেটে যাওয়া ট্যাংকটির বয়স মাত্র ১০ বছর। ন্যূনতম ২৫ বছর এসব ট্যাংকের মেয়াদ থাকে। মেয়াদের আগে কী কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা জানতে চাইলে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৬ সালে ট্যাংকটি বানিয়েছিল চীনের একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের বিষয়টি জানানো হয়েছে। তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনার কারণ নির্ধারণ করবে।
অমল কান্তি বড়ুয়া বলেন, ট্যাংকে অ্যামোনিয়া গ্যাসের চাপ যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে জন্য দুটি ব্যবস্থা ছিল। তরল অ্যামোনিয়া যাতে চাপ সৃষ্টি না করে, সে জন্য ‘প্রেশার সেইফটি ভাল্ব’ ছিল। গ্যাসের চাপ বাড়লে এই ভাল্ব দিয়ে গ্যাস বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। এটি অকার্যকর হয়ে গেলে ফ্লেয়ার স্টিক বা আগুনের শিখার সাহায্যে গ্যাস পুড়িয়ে ফেলারও আরেকটি বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। এই দুটির কোনোটি অকার্যকর হয়েছে কি না, তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। তবে নাশকতার আশঙ্কা কম বলে মনে করেন তিনি।
গ্যাসের মাত্রা কমেছে: দুর্ঘটনার পর কয়েক দফায় গ্যাসের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। মোহাম্মদ ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, রাত তিনটায় ড্রেগার টিউব (গ্যাস শনাক্তকরণ যন্ত্র) দিয়ে পরিমাপ করে দেখা গেছে, দুর্ঘটনাস্থলের ২০০ মিটার দূরে গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাব ছিল না। অ্যামোনিয়া গ্যাসের মানুষের সহনীয় মাত্রা ২৫ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন)। এ সময় সেখানে গ্যাসের মাত্রা ছিল ২০ পিপিএম। তবে ঘটনাস্থলের ১৪০ মিটারের মধ্যে গ্যাসের মাত্রা ছিল ৬০০ পিপিএম। গ্যাসের এই মাত্রা ক্ষতিকর।
অমল কান্তি বড়ুয়া জানান, গতকাল সকাল নয়টায় দুর্ঘটনাস্থলের ২০০ মিটার দূরে অ্যামোনিয়া গ্যাসের মাত্রা ছিল ২৫ পিপিএম। তবে দুর্ঘটনাস্থলের অদূরে কারখানার প্রধান ফটক, চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের ফটকে গ্যাসের মাত্রা ছিল শূন্য।
৩৪ জন চিকিৎসাধীন: অ্যামোনিয়া গ্যাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৪ জন গতকাল বিকেল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাদের মধ্যে এক শিশুও রয়েছে। গ্যাসের ক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে সোমবার রাতে ৫২ জন এবং গতকাল সকালে একজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৯ জন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। সোমবার রাতে পতেঙ্গা, বিমানবন্দর ও আনোয়ারা এলাকা থেকে তাঁরা অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসাধীন সবাই শঙ্কামুক্ত বলে জানান চিকিৎসকেরা।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জালাল উদ্দিন বলেন, ৩৪ জনের সবাই শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগেছেন। তবে সবাই শঙ্কামুক্ত। দু-এক দিনের মধ্যে সবাই বাড়ি ফিরতে পারবেন।
তদন্ত কমিটি: ট্যাংক ফেটে যাওয়ার কারণ, ক্ষয়ক্ষতি ও দায়দায়িত্ব নির্ধারণে ১০ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিসিআইসি। সকালে সিইউএফএলের বিশ্রামাগারে মোহাম্মদ ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, কমিটি তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন দেবে। কারখানার অন্য ট্যাংকগুলোতে ঝুঁকি আছে কি না এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়েও সুপারিশ করার জন্য বলা হয়েছে কমিটিকে।
বিসিআইসির পরিচালক আলী আক্কাসকে প্রধান করে গঠিত এ কমিটিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, জেলা প্রশাসন, কাফকো ও সিইউএফএলের প্রতিনিধি রয়েছেন। এর আগে ঘটনার রাতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে।
একনজরে অ্যামোনিয়া
নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন মিলে তৈরি হয় অ্যামোনিয়া। এই গ্যাস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এ বিষয়ে বলেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত ও পরিবেশ রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীন
* অ্যামোনিয়া গ্যাস কেমন
ঝাঁজালো গন্ধযুক্ত বিষাক্ত গ্যাস। এই গ্যাস বাতাসে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয় না
* ক্ষতিকর প্রভাব আছে?
বেশি মাত্রার অ্যামোনিয়া গ্যাস শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করলে তাৎক্ষণিক ক্ষতি হতে পারে। আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন
হতে হবে
* অন্য প্রাণীর ওপর প্রভাব?
এ গ্যাস নালা, খাল ও পুকুরের পানিতে মিশতে পারে। তখন অক্সিজেনের মাত্রা কমে মাছসহ জলজ প্রাণীর মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে পানির পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যামোনিয়ার ঘন মাত্রা কমে গেলে ক্ষতির কারণ হবে না
বাংলাদেশ সময়: ৯:২২:৩৭ ৪৬১ বার পঠিত