বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ
দীর্ঘ এক বছর পর তৃণমূল রাজনীতিতে ফিরছে বিএনপি। কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণার পর দলটির মনোযোগ এখন জেলা-মহানগরের সাংগঠনিক পুনর্গঠনে। মাঠপর্যায়ের সাংগঠনিক চিত্র নিয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকটি বিভাগের সাংগঠনিক রিপোর্ট জমা পড়েছে। বাকি বিভাগগুলোকেও খুব শিগগিরই জমা দিতে তাগাদা দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কোরবানির ঈদের পর তৃণমূল পুনর্গঠনে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হবে। তবে ঈদের আগেই কয়েকটি জেলার কাউন্সিল করার নির্দেশনা দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দলীয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, গতকাল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক পর্যায়ের বৈঠকে তৃণমূল পুনর্গঠনের কৌশল নির্ধারণ করা হয়। একইভাবে একাধিক পদ ছাড়তে জেলা নেতাদের কাছে কেন্দ্র থেকে কঠোর বার্তা পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে স্বেচ্ছায় একাধিক পদ না ছাড়লে কেন্দ্র থেকেই চিঠির মাধ্যমে এক পদ নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। এরই মধ্যে ৫৬ জন নেতার একাধিক পদে থাকার বিষয়টি চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের কেউ কেউ জেলা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও থানা সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন কেন্দ্রীয় সহসম্পাদক থেকে শুরু করে ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা পর্যায়ের নেতারা। তৃণমূল পুনর্গঠনে মির্জা ফখরুলের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রে প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘জেলার সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। আমরা এরই মধ্যে বরিশাল, সিলেট ও ফরিদপুর বিভাগের সাংগঠনিক রিপোর্ট পেয়েছি। বাকিগুলোও শিগগিরই পাব। ঈদের আগেই সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে আরও একটি বৈঠক করব। সেখানে যুগ্ম মহাসচিব পর্যায়ের নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হবে। ঈদের পর পুরোদমে সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হবে।’ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্র জানায়, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ডা. দেওয়ান সালাউদ্দিন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ অন্তত ১০ জন নেতা একাধিক পদ ছেড়ে দিয়েছেন। তবে কেন্দ্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাই জেলার পদ ছাড়তে চান না। তাদের মতে, জেলার পদ ছেড়ে দিলে নেতৃত্ব হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। ভবিষ্যতে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচনও ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। তারা এখন অনুগত নেতাকে খুঁজছেন। না পেলে জেলার পদ রেখেই কেন্দ্রের পদ ছেড়ে দেবেন কেউ কেউ। তবে বেগম জিয়ার সঙ্গে যারাই এ নিয়ে কথা বলতে গেছেন, তাদের সবাইকে জেলার পদ ছেড়ে দেওয়ার কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে বলে জানা যায়।
গত বছরের ৯ আগস্ট তৃণমূলে চিঠি পাঠিয়ে এক মাসের মধ্যে জেলা কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি পুনর্গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্র। এরপর রাঙামাটি, সিলেট জেলা ও মহানগর, কুড়িগ্রাম, ঝিনাইদহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নীলফামারী এবং সৈয়দপুর জেলায় কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হয়। এর আগেই অবশ্য নেত্রকোনো জেলায় কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হয়। এরপর চলতি বছরের ১৯ মার্চ দলের জাতীয় কাউন্সিল সামনে রেখে জেলা পুনর্গঠন প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা হয়। ওই সময় খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, নোয়াখালী, খুলনা জেলা ও মহানগর, চুয়াডাঙ্গা, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নওগাঁসহ অন্তত ১৪টি জেলা কাউন্সিল করার পর্যায়ে ছিল। পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় বিএনপি এখন সেই জেলাগুলোকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। জানা যায়, ঈদের আগেই কয়েকটি জেলায় কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন বেগম জিয়া। সূত্রমতে, সম্প্রতি দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জেলা ও মহানগরে সাংগঠনিক কমিটির আকার নির্ধারণ করা হয়। প্রতিটি ওয়ার্ডে ন্যূনতম ১০০ জন করে সদস্য করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ওয়ার্ড বা ইউনিয়ন কমিটি হবে ৫১ সদস্যের। থানা বা উপজেলা পর্যায়ের কমিটি হবে ৭১ সদস্যের। জেলা বা মহানগর কমিটি হবে ১৫১ সদস্যের। এর মধ্যে ৭৪টি হবে কর্মকর্তা পর্যায়ের পদ, বাকি ৭৬টি সদস্য পদ। অবশ্য জেলা-মহানগর ১৭১ সদস্যের কমিটি করার ব্যাপারেও স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। স্থায়ী কমিটির নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তৃণমূলে কমিটি গঠন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সব কমিটিই কাউন্সিলের মাধ্যমে করতেও বলা হয়। এদিকে গতকালের সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যায়ের বৈঠক সূত্র জানায়, দু-একদিনের মধ্যেই ১১টি সাংগঠনিক বিভাগভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকরা জেলা সফর করবেন। ওই বিভাগে অবস্থান নেওয়া যুগ্ম মহাসচিবরাও তাদের এ কাজে তদারকি করবেন। দল সমর্থিত সাবেক এমপি-মন্ত্রী, উপজেলা-পৌরসভার নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকবেন। জেলার সাংগঠনিক ত্রুটি-বিচ্যুতি নির্ধারণের পাশাপাশি পরিস্থিতি উত্তরণে করণীয় নিয়ে তারা সুপারিশ করবেন কেন্দ্রে। ওই রিপোর্ট ধরেই সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চালাবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। একইভাবে বিএনপির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর রিপোর্ট দিতেও সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে মির্জা ফখরুল ছাড়াও মো. শাহজাহান, যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সারোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবীর খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হোসেন জীবন, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, মাহবুবুর রহমান শামীম, বিলকিস ইসলাম শিরিন, সহসাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, আ ক ন কুদ্দুসুর রহমান, মাহবুবুল হক নান্নু, শহীদুল ইসলাম বাবুল, সেলিমুজ্জামান সেলিম, আবদুল আওয়াল খান, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, জয়ন্তু কুমার কুণ্ডু, খন্দকার মাশুকুর রহমান, হারুন অর রশীদ, শামসুজ্জামান, কলিম উদ্দিন মিলন, দিলদার হোসেন সেলিম প্রমুখ। বৈঠকে বরিশালের সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস ইসলাম শিরিন ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল হক নান্নুর মধ্যে বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। একে অপরকে অশ্লীল ভাষায় বকাবকি শুরু করেন। পরে মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। তবে অসাংগঠনিক ভাষায় কথাবার্তা বলায় বিষয়টি চেয়ারপারসনকেও জানানো হবে বলে সূত্রে জানা যায়। জেলা পর্যায়ের পুনর্গঠন প্রসঙ্গে কেন্দ্রের প্রধান সমন্বয় মো. শাহজাহান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দল আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জেলা পুনর্গঠনে দায়িত্ব দিয়েছে। আমরা কাজও শুরু করেছি। দলের মহাসচিব পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সুপারভাইস করবেন। যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার সাবেক মন্ত্রী-এমপি সবাই এ প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করবেন বলে আমরা আশা করছি। ঈদের পর পুরোদমে সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হবে।’
ঢাকা জেলার কমিটি যে কোনো মুহূর্তে : জানা যায়, ডা. দেওয়ান সালাউদ্দিন বাবু ও আবু আশফাকের নেতৃত্বে ঢাকা জেলা কমিটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। যে কোনো দিন এ কমিটি ঘোষণা করা হবে। এরই মধ্যে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন দেওয়ান সালাউদ্দিন বাবু। এ ছাড়া জেলার বর্তমান সভাপতি আবদুল মান্নান ও সাধারণ সম্পাদক আমানউল্লাহ আমানও পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা এরই মধ্যে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে পদত্যাগের কথা জানিয়েছেন।
ঈদের আগে তিন অঙ্গ-সংগঠনের কমিটি : সাইফুল আলম নীরবকে সভাপতি ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সাধারণ সম্পাদক করে ঈদের আগেই যুবদলের আংশিক কমিটি ঘোষণা হতে পারে। আবার সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সভাপতি ও রফিকুল ইসলাম মজনুকে সাধারণ করে কমিটি করার আলোচনাও আছে। তবে নীরব-টুকুর কমিটি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলে শফিউল বারী বাবুকে সভাপতি ও আবদুল কাদের ভূইয়া জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি করার জোর আলোচনা চলছে। তবে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীমের নামও আলোচনায় আছে। জাতীয়তাবাদী মহিলা দলে আফরোজা আব্বাস ও সুলতানা আহমেদের নাম শোনা যাচ্ছে। আবার সভাপতি পদে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানার নামও আলোচনায় আছে। ঈদের পর জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটিও গঠন হতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১২:২৯:০৭ ৪৪৪ বার পঠিত