বঙ্গ-নিউজ: দেশীয় শিল্পের উন্নয়নে সরকারের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দীর্ঘদিনের। সে অনুযায়ী, ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধাসহ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আসছিল স্থানীয় শিল্প, যা এসব শিল্পে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ায়। অর্জিত হয় বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু নতুন অর্থবছরে সরকারের ভ্যাট আরোপ ও শুল্ক বৈষম্যে স্থানীয় শিল্প এখন ঝুঁকিতে পড়েছে।
দেশীয় শিল্পের অনেক খাতে ভ্যাট আরোপ করায় দাম বেড়েছে এসব পণ্যের, অন্যদিকে বিদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ায় বানের মতো ঢুকছে দেশের বাজারে। ফলে ভ্যাট, শুল্ক এবং কর বৈষম্যের কবলে পড়ে স্থানীয় শিল্প এখন বাজার হারাতে বসেছে, যা উদ্বিগ্ন করে তুলেছে এসব শিল্প মালিকদের। তাদের মতে, সরকারের বাজেটনীতির ফলে দেশীয় বিনিয়োগ কমবে, সেই সঙ্গে সংকুচিত হবে কর্মসংস্থানও।
চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে স্থানীয় মোটরসাইকেল শিল্প থেকে সরকার ভ্যাটমুক্ত সুবিধা তুলে নিয়েছে। অন্যদিকে আমদানি মোটরসাইকেলে সম্পূরক শুল্ক ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তে স্থানীয় মোটরসাইকেল শিল্পে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ১৫ শতাংশ। অথচ শুল্ক সুবিধায় আমদানি মোটরসাইকেলের দাম কমপক্ষে ২৫ শতাংশ কমে আসতে পারে, যা মোটরসাইকেলের বাজারে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করছে।
প্রসঙ্গত, আমদানিনির্ভরতা কমাতে স্থানীয় শিল্পের উন্নয়নে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। সে হিসেবে ইলেকট্রনিকসের পাশাপাশি দেশীয় মোটরসাইকেল শিল্পও দীর্ঘ সময় ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা ভোগ করে আসছিল। সরকারের এ সুবিধা পেয়ে বেশ কিছু উদ্যোক্তা বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করে স্থানীয়ভাবে মোটরসাইকেল উৎপাদন কারখানা গড়ে তোলে। এসব প্রতিষ্ঠান স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিপুল কর্মসংস্থানেরও উৎস হয়ে ওঠে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উদ্যোক্তা বলেন, এখন সরকারের নীতিগত পরিবর্তনের কারণে পুরো শিল্পই ঝুঁকিতে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘ইলেকট্রনিকস কম্পানিগুলোর পাশাপাশি স্থানীয় মোটরসাইকেল শিল্পও সরকারের কাছ থেকে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পেয়ে আসছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সরকারের নতুন বাজেটে মোটরসাইকেল শিল্পকে এ সুবিধা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে আমদানি মোটরসাইকেলে অস্বাভাবিকভাবে কমানো হয়েছে শুল্ক। এর ফলে মূল্য প্রতিযোগিতায় স্থানীয় শিল্প হেরে যাচ্ছে। এটা বৈষম্য ছাড়া আর কী হতে পারে।’
ওই উদ্যোক্তা বলেন, ‘যদি এ পরিস্থিতি দীর্ঘ সময় অব্যাহত থাকে, তবে একসময় স্থানীয় মোটরসাইকেল কারখানাগুলো আমাদের বন্ধ করে দিতে হবে। কয়েক হাজার কর্মী তাদের চাকরি হারাবে।’
সরকারের নীতিগত এ সিদ্ধান্তে দেশের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পও অসম প্রতিযোগিতায় পড়েছে। তাঁতশিল্প এত দিন যে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পেয়ে আসছিল, তা তুলে নেওয়া হয়েছে। ফলে টিকে থাকাই এখন এ শিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভ্যাট আইন কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত বিশেষায়িত টেক্সটাইল উৎপাদনকারীরা ভ্যাটমুক্ত সুবিধা ভোগ করত। এর ফলে এ শিল্পে যেমন বড় অঙ্কের বিনিয়োগ এসেছে, তেমনি কর্মসংস্থানও বেড়েছে ব্যাপকভাবে। বিশেষ করে অদক্ষ ও অর্ধদক্ষ কর্মীদের কর্মসংস্থানের বড় উৎস হয়ে উঠেছে টেক্সটাইল।
বাংলাদেশ স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলস অ্যান্ড পাওয়ারলুম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসটিএমপিআইএ) প্রেসিডেন্ট আজিজুল হক সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, টেক্সটাইল ও তাঁতশিল্পে আগের ভ্যাটমুক্ত সুবিধা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। তিনি বলেন, সরকার যদি বিষয়টি বিবেচনা না করে তাহলে শিগগিরই অনেক তাঁতশিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, প্রায় ৪০ হাজার বিশেষায়িত টেক্সটাইল কারখানা (হস্ত তাঁত ছাড়া) দেশজুড়ে ওভেন বস্ত্র, শাড়ি, লুঙ্গি, লংক্লথ, পপলিন টাওয়েল, শার্টিং এবং স্যুটিং বস্ত্র উৎপাদন করে থাকে। এ শিল্পে প্রায় ৫০ লাখ লোক জড়িত। বিএসটিএমপিআইএ প্রেসিডেন্ট আরো উল্লেখ করেন, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী মো. ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক এবং অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান সম্প্রতি তাঁদের আশ্বস্ত করেছেন, পাবলিক-প্রাইভেট আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের। টেক্সটাইল খাতের আধুনিকায়নে তাঁরা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যবস্থা নেওয়ারও আশ্বাস দেন। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী টেক্সটাইল খাতের বিষয়টি অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনারও আশ্বাস দিয়েছিলেন।
আজিজুল হক বলেন, ‘আমরা সরকারের সিদ্ধান্তে অপেক্ষায় আছি। যদি সরকার এ খাতকে সহায়তা দেয় তবে দেশ লাভবান হবে। ওভেন বস্ত্র রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা অর্জন করা যাবে।’ ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং বিজিএমইএর সাবেক প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম মহিউদ্দিন এক আলোচনায় বলেছেন, ৭০০ থেকে এক হাজার কোটি ডলার রপ্তানি আয় সম্ভব হবে স্পেশালাইজড টেক্সটাইল খাত থেকে। যদি সরকার এ খাতকে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা দেয়। তিনি এ খাতের জন্য সরকারকে ভ্যাটমুক্ত সুবিধা দেওয়ার অনুরোধ জানান।
দেশের জুতাশিল্পও ভ্যাটমুক্ত সুবিধা হরিয়েছে। জুতা উৎপাদন কম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ পাদুকা প্রস্তুতকারক সমিতি (বিপিপিএস) রাবার ও প্লাস্টিকে তৈরি শু এবং চপ্পলে ভ্যাটমুক্ত সুবিধা চেয়েছে। সংগঠনের নেতারা বলেন, এ খাতে রাবার ও প্লাস্টিকের তৈরি শু ও চপ্পলে ভ্যাটমুক্ত সুবিধা ভোগ করত। কিন্তু ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে সরকার এ সুবিধা তুলে নেওয়ায় এ খাত এখন ধ্বংসের মুখে। বিপিপিএস সভাপতি সাখাওয়াত হোসাইন বেলাল বলেন, এসব পণ্যের প্রধান ভোক্তা দেশের দরিদ্র শ্রেণি। সরকার ভ্যাটমুক্ত সুবিধা তুলে নেওয়ায় এসব পণ্যের দাম বেড়েছে ব্যাপকভাবে। অনেকাংশে তা মানুষের সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, ‘এ শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ভ্যাট কর্মকর্তাদের হেনস্তারও শিকার হচ্ছেন। অনেক সময় ভ্যাট কর্মকর্তারা আমাদের মালবোঝাই ট্রাক আটক করে নিয়ে যান।’ এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, জুতাশিল্পের সক্ষমতা ও ভোক্তা শ্রেণির সাধ্যের দিকে তাকিয়ে এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
সরকারের ভ্যাট আইন কার্যকরের ফলে বেকারিশিল্পও এখন ঝুঁকির মুখে। হাতে তৈরি কেক, ব্রেড এবং বিস্কুটে ভ্যাট দিতে হচ্ছে। সরকার বেকারি পণ্যে কেজিপ্রতি ১০০ টাকা পর্যন্ত ভ্যাট আরোপ করেছে। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকার স্থানীয় শিল্পের উন্নয়নে সহযোগিতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাজেটে যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, তা তার বিপরীত। বিশেষ করে মোটরসাইকেলশিল্প এর দ্বারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
বাংলাদেশ সময়: ৯:২৭:১৩ ৪৮৬ বার পঠিত