বঙ্গ-নিউজ: তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাসহ বিতর্কিত চারটি ধারা বিলুপ্ত এবং এসব ধারার বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করে প্রণীত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৬’-এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। তবে বিলুপ্ত হলেও এরই মধ্যে এসব ধারায় হওয়া মামলাগুলো তথ্যপ্রযুক্তি আইনেই চলবে-এমন বিধান যুক্ত করা হয়েছে খসড়ায়। এ ছাড়া কম্পিউটার, মোবাইল বা যেকোনো ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধ করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মতো কঠোর শাস্তির বিধান থাকছে খসড়া আইনে। এতে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার চালালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ডিজিটাল ক্ষতির মূল্য নির্ধারণ করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি গঠন করার প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়া আইনে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গতকাল সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হলেও আইনের খসড়াটি আরো পর্যালোচনা ও পরীক্ষা করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে। আইনে বিভিন্ন অপরাধের শাস্তির যে মাত্রা প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করবেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আইনটিতে যেন ওভারল্যাপিং না হয়, কনফিউজিং না হয় সে জন্য আমাকে বলা হয়েছে। আইনটি ভেটিংয়ের জন্য আসবে, সে সময় এগুলো দেখা হবে।’ আইনের অপরাধগুলো জামিনযোগ্য কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনোটি জামিনযোগ্য আবার কোনোটি জামিন অযোগ্য।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কাঠামো তছনছ করলে সাইবার অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করা হবে। এ জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছর, সর্বনিম্ন দুই বছর কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। অন্য কোনো ব্যক্তির তথ্য নিজের দেখালে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি অসৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য কোনো ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া তার ব্যক্তিগত ছবি তুললে এবং প্রকাশ করলে তা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। জরুরি পরিস্থিতিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালক তথ্য সম্প্রচারে বাধা দিতে পারবেন।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদসচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের জানান, ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ নিলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইনে ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সাইবার অপরাধের সংজ্ঞা ও শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করে নতুন এ আইনে স্থানান্তর করা হয়েছে। নতুন আইনে সাইবার ক্রাইমকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধের জন্য আইনের ১৫-এর ২, ৩, ৪ ও ৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদালত কর্তৃক মীমাংসিত মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত বিষয়াবলি বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনো প্রচার, প্রোপাগান্ডা বা এতে মদদ দেন, তাহলে তাঁর শাস্তি হবে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড, সর্বনিম্ন তিন বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোর ব্যাপারে অপরাধ করলে সর্বনিম্ন দুই বছর এবং সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। কোনো ব্যক্তি অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো, যেমন-বিমান পরিচালনার জন্য যে সাইবার ম্যানেজমেন্ট আছে, এটার মধ্যে হামলা বা হ্যাক করেন, তাহলে এ দণ্ড কার্যকর হবে। ডিজিটাল বা সাইবার সন্ত্রাস করার জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছর এবং সর্বনিম্ন দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হবে।
মন্ত্রিপরিষদসচিব জানান, কম্পিউটার, মোবাইল ও ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে অপরাধ করলেও শাস্তি রয়েছে। কম্পিউটার, মোবাইল এবং ডিজিটাল ডিভাইস-সংক্রান্ত জালিয়াতি করলে শাস্তি হবে সর্বনিম্ন এক বছর ও সর্বোচ্চ পাঁচ বছর এবং অর্থদণ্ড তিন লাখ টাকা বা উভয় দণ্ড। কম্পিউটার ও মোবাইল-সংক্রান্ত প্রতারণা বা হুমকি প্রদানের শাস্তি সর্বনিম্ন এক বছর ও সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড তিন লাখ টাকা বা উভয় দণ্ড। প্রতারণা বা প্রতারণার উদ্দেশ্যে অপর কোনো ব্যক্তির পরিচয় ধারণ করে বা অন্য কোনো ব্যক্তির তথ্য নিজের দেখালে সর্বনিম্ন এক বছর ও সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হবে তিন লাখ টাকা বা উভয় দণ্ড।
সচিব জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হবে। এর প্রধান হবেন সরকার নির্ধারিত মহাপরিচালক। আইনে জরুরি পরিস্থিতিতে মহাপরিচালকের নির্দেশ প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। জরুরি পরিস্থিতিতে মহাপরিচালক সরকারের কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কোনো কম্পিউটার রিসোর্সের মাধ্যমে কোনো তথ্য সম্প্রচারে দ্রুত বাধা দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারবেন।
কোনো ব্যক্তি অসৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য কোনো ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া তাঁর ব্যক্তিগত ছবি তোলে এবং প্রকাশ করে বা প্রেরণ করে বা বিকৃত করে, তাহলে তা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এর শাস্তি হবে দুই বছরের কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। পর্নোগ্রাফির জন্যও শাস্তি সর্বনিম্ন দুই বছর ও সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।
তথ্যপ্রযুক্তি আইন থেকে ৫৭ ধারাসহ মোট চারটি ধারা বিলুপ্ত করে এসব ধারার অপরাধ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। নতুন আইনে প্রায় প্রতিটি ধারার শাস্তি ও জরিমানা কমানো হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত চারটি ধারা বিলুপ্ত করে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৬’-এর খসড়া প্রণয়ন করেছে সরকার। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা হচ্ছে সবচেয়ে বিতর্কিত। এ ধারার শাস্তি অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড। নতুন আইনের খসড়ায় এই কারাদণ্ড নামিয়ে আনা হচ্ছে সর্বনিম্ন দুই মাসে। আর জরিমানার অঙ্কটিও নেমে আসছে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকায়।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৪ ধারায় কম্পিউটার দূষণ, কম্পিউটারের তথ্য-উপাত্ত ভাণ্ডার নষ্ট করার শাস্তি অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড, ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। প্রস্তাবিত খসড়া আইনে কম্পিউটার, মোবাইল, ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক জালিয়াতি করলে সর্বনিম্ন এক বছর থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৬ ধারায় বলা হয়েছে, কম্পিউটার সিস্টেমের হ্যাকিং অপরাধী অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। প্রস্তাবিত খসড়া আইনে প্রতারণা করা বা ঠকানোর উদ্দেশ্যে অন্য কোনো ব্যক্তির পরিচয় ধারণ করলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, সর্বনিম্ন এক বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৫ ধারায় বলা হয়েছে, কম্পিউটার সোর্স কোড পরিবর্তনসংক্রান্ত অপরাধের জন্য অনধিক তিন বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। ওই ধারাটি নতুন আইনে ১১ ধারায় স্থান পেয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কম্পিউটার বা মোবাইলে প্রতারণা বা হুমকি দেয়, প্রতারণার জন্য মেসেজ দেয়, ভুয়া তথ্য প্রচার করে সামাজিক কোন্দল ছড়িয়ে দেয় তাহলে তার শাস্তি হবে সর্বোচ্চ পাঁচ এবং সর্বনিম্ন এক বছরের কারাদণ্ড।
২০২২ সাল পর্যন্ত সংরক্ষিত বনের গাছ কাটা যাবে না : দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সংরক্ষিত ও প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের গাছ কাটার ওপর বিধিনিষেধের সময় ২০২২ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে সরকার। এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব গতকাল অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
মন্ত্রিপরিষদসচিব সাংবাদিকদের জানান, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় গাছ কাটার ওপর বিধিনিষেধের সময় ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল। তবে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিধিনিষেধ আরোপের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর এ বিধিনিষেধের মেয়াদ শেষ হয়।
আবহাওয়া-বিষয়ক আইন অনুমোদন : আবহাওয়া অধিদপ্তর ও আবহাওয়া-সংক্রান্ত কার্যক্রম আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এ জন্য ‘আবহাওয়া-বিষয়ক আইন, ২০১৬’-এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিপরিষদসচিব জানান, এত দিন পর্যন্ত আবহাওয়ার কোনো আইন ছিল না। প্রশাসনিক আদেশে চলেছে। সংস্থাটির সঙ্গে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডাব্লিউএমও) একটি সংযোগ আছে। এ জন্য আইনি কাঠামো দরকার। আবহাওয়া অধিদপ্তর, মহাপরিচালক ও অন্যান্য কর্মচারীর ব্যবস্থাপনা আইনের কাঠামোতে নিয়ে আসা হচ্ছে। আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ক স্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে বিধান রাখা হয়েছে। পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণে ডিভাইস কী হবে, সে বিষয়েও আইনে বলা আছে। মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, আবহাওয়া বিজ্ঞানীরাই মূলত আবহাওয়া অধিদপ্তর পরিচালনা করবেন।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ট্রাস্টে ইচ্ছেমতো অনুদান : মন্ত্রিসভা বৈঠকে ‘হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০১৬’, ‘বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০১৬’ ও ‘খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০১৬’-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদসচিব জানান, ‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ট্রাস্ট অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করা হচ্ছে। নতুন আইনে তেমন কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি, যা ছিল তাই আছে। অধ্যাদেশে ট্রাস্টগুলোতে সরকারের অনুদানের একটি সীমা ছিল। এখন সেই সিলিং উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন সরকার ইচ্ছেমতো অনুদান দিতে পারবে।
বাংলাদেশ সময়: ৯:১৪:২৭ ৪২৭ বার পঠিত