সুরের মূর্ছনায় নেচে চলেছেন মেয়েটি। প্রথমে হুপ (ধাতব বলয়), এরপর বল, ক্লাব (ধাতব দণ্ড) ও রিবন (লাল ফিতা) হাতে অসামান্য নৈপুণ্য দেখালেন। পরশু রাতে মেয়েটি যেন সম্মোহিত করলেন পুরো বিশ্বকে। রিও ডি জেনিরোর অলিম্পিক মঞ্চে কিংবা টেলিভিশনের পর্দায়-সবাই অপলক চোখে চেয়ে ছিলেন অল-অ্যারাউন্ড রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে মার্গারিতা মামুনের ক্রীড়ানৈপুণ্য দেখতে। তিনবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন রাশিয়ারই ইয়ানা কুদ্রাভতসেভাকে হারিয়ে রিও অলিম্পিকে এই ইভেন্টে সোনা জিতেছেন মার্গারিতা মামুন।
মার্গারিতার স্কোর ৭৬.৪৮৩। হিটে প্রথম হয়ে ফাইনালে উঠেছিলেন। তাতে সবাইকে মুগ্ধ করে ছাড়িয়ে গেলেন হিটের স্কোর।
২০১৩ সালে কিয়েভে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ও কাজানে গ্রীষ্মকালীন ইউনিভার্সিয়াদে অল-অ্যারাউন্ড চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম সবার নজর কাড়েন মার্গারিতা, মা-বাবা যাঁকে ডাকেন রিতা নামে। ওই সময়ই রাশিয়ার ক্রীড়াঙ্গনে তাঁকে নিয়ে শুরু হয় হইচই। রুশ ম্যাগাজিন ইউরো স্পোর্ত-এ তাঁকে নিয়ে করা হয়েছিল প্রচ্ছদ প্রতিবেদন। স্থানীয় গণমাধ্যম তাঁর নাম দেয় ‘বাংলার বাঘিনী’। ২০১৫ সালে বাকুতে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে হুপে জেতেন সোনা, অল-অ্যারাউন্ডে রুপা। বার্লিনে ২০১৩ সালের গ্রাঁ প্রিতে, পরের বছর অস্ট্রিয়ার ইনসব্রাকে এবং গত বছর চেক প্রজাতন্ত্রের ব্রনোতেও অল-অ্যারাউন্ডে সোনা জিতেছিলেন রিতা। পরশু রিওতে যখন সোনা জিতলেন, টেলিভিশন ধারাভাষ্যকারও মার্গারিতার নামের সঙ্গে ‘বেঙ্গল টাইগার’ শব্দটি উচ্চারণ করছিলেন বারবার।
চেহারায় বাঙালিয়ানা লাবণ্য। রিতা যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত! বাবা আবদুল্লাহ আল মামুন রাজশাহীর দুর্গাপুরের সন্তান। মা আনা রাশিয়ার সাবেক জিমন্যাস্ট। আশির দশকে আবদুল্লাহ আল মামুন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনা করতে গিয়ে সেখানেই বিয়ে করে স্থায়ী হয়ে যান। রিতার জন্ম মস্কোতেই। জন্মভূমি রাশিয়া হলেও রিতা সোনা জেতার পর সাফল্যটা উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশ-রাশিয়া দুই দেশকেই, ‘আমার এই জয় দুই দেশের জন্যই।’ বাংলাদেশের হয়ে একবার অবশ্য জার্মানিতে জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েছিলেন রিতা। বাংলাদেশ ও রাশিয়া দুই দেশেরই পাসপোর্ট আছে তাঁর।
কাশিপুরেই শিকড় মার্গারিতার
খবরটা শোনার পর একটু আফসোসই হচ্ছে বাংলাদেশ জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আহমেদুর রহমানের। রিতাকে নিয়ে তাঁর আফসোস হচ্ছে, ‘মেয়েটি হয়তো বাংলাদেশের পতাকা গায়ে খেলতে পারত। কিন্তু ওই সময় ফেডারেশন থেকে সেভাবে সহযোগিতা না পাওয়ায় ফিরে গিয়েছিল রাশিয়ায়। এখন মেয়েটির সোনা জয়ের খবরে একটু খারাপ তো লাগছেই।’ ২০০৯ সালে ১৩ বছর বয়সী রিতাকে নিয়ে ঢাকায় জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশনে এসেছিলেন বাবা আবদুল্লাহ আল মামুন। চেয়েছিলেন মেয়ে যাতে বাংলাদেশের হয়ে বিভিন্ন ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে। কিন্তু ফেডারেশনের সেই সময়কার নির্বাহী কমিটি সুযোগটা করে দিতে পারেনি। মেয়েটিকে নিয়ে সেই কমিটির সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমানের স্মৃতিটা অবশ্য ঝাপসা, ‘এই মেয়ের ব্যাপারে এ মুহূর্তে কিছু মনে করতে পারছি না।’ বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আহমেদুর রহমানের কণ্ঠে একটু দুঃখই ঝরছে, ‘আমি মেয়েটিকে কখনো দেখিনি। তবে শুনেছি, বাংলাদেশের পক্ষে জিমন্যাস্টিকসে অংশ নেওয়ার জন্য দিপু ভাইয়ের (আনিসুর রহমান) কাছে এসেছিলেন মেয়েটি ও তাঁর বাবা। এটা বছর সাতেক আগের ঘটনা। ওই সময় এই মেয়েকে জিমন্যাস্টিকস করাতে আর্থিক সহযোগিতা, অনুশীলনের ভালো সুযোগ-সুবিধাসহ ওই লেভেলের একজন কোচ দরকার ছিল আমাদের। কিন্তু এসব আমরা কখনোই দিতে পারতাম না। এ জন্যই এ দেশে তাঁকে দিয়ে জিমন্যাস্টিকস করানো যায়নি।’
বাস্তবতা হচ্ছে, কিশোরী রিতাকে নিয়ে হয়তো ততটা আশাবাদীই ছিলেন না বাংলাদেশ জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশনের কর্তারা। অথচ ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী জিমন্যাস্ট কাজী সাইক সিজার। তাঁকে ফেডারেশন সব রকমের সহযোগিতা দিয়েছিল। অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার আগে মাস তিনেক সিজারের অনুশীলনসহ আনুষঙ্গিক খরচ বহন করেছিল বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ)। ছোটবেলায় বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু ভালোমতো বাংলাটা বলতে পারেন না। সোনা জয়ের পর রিতা মজা করে বলছিলেন, ‘আমি বাংলায় ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গুনতে পারি। ছোটবেলায় বাবা আমাকে বাংলা শেখাতেন, কিন্তু সব ভুলে যেতাম।’
বাংলা ভুলে গেলেও বাংলাদেশকে যে মোটেও ভুলতে পারেন না রিতা, ‘বাংলাদেশে আমার অনেক ভক্ত আছে এটা জেনে ভীষণ ভালো লেগেছে।’
বাংলাদেশের হয়ে এখন পর্যন্ত কেউ অলিম্পিকে সোনা জিততে পারেনি। তবে একজন সোনাজয়ীর হৃদয়ে আঁকা আছে বাংলাদেশের নাম। রাশিয়ার পতাকা নিয়ে যে মার্গারিতা পরশু রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে সোনা জিতলেন, তাঁর হৃদয়ের একটি কোণে যে আছে লাল-সবুজের অস্তিত্ব।
বাংলাদেশ সময়: ৯:২৩:৫৮ ৩৭৩ বার পঠিত