দ্বিতীয় অধ্যায়
পর্ব ৪
এডলফ অনেক কথাই বলতো কিন্তু তার নিজের পরিবার সম্পর্কে কোনো তথ্যই আমাকে দিতে চাইতো না। সে প্রায়ই বলতো যে বড়দের সম্পর্কে যত পারা যায় কম জানাই মঙ্গল, কারণ তাতে নিজের জীবনের ইপ্সিত পরিকল্পনা ব্যাহত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তার দরিদ্র অতি সাধারণ অভিভাবকরা খুব করে চাইতেন এডলফ হাতে কলমে ছুতার মিস্ত্রির কাজটি শিখে ফেলুক। তার পরিবারের মত মোটামুটি এমনটাই ছিলো।
আমার ধারণা, এডলফের সাথে তার পরিবারের সম্পর্কটি অনেকটাই উদ্ভট ছিলো। তার অভিভাবকদের মাঝে সে শুধুমাত্র তার মাকেই পাত্তা দিতো। সে সময় তার বয়স ছিলো মাত্র ষোল বছর, আমার চেয়ে নয় মাসের ছোট।
তবে যাইহোক তার চিন্তা ছিলো ব্যতিক্রমধর্মী যা তাকে অন্যান্য সাধারণ বৈষয়িক মানুষদের থেকে সম্পূর্ণই আলাদা করে তুলতো। বিষয়টা আমাকে আশ্চার্য করেনি মোটেও। এ কথা সত্য যে সে সাধারণ মানুষ থেকে একটু ব্যতিক্রম ছিলো। চারুকলার জন্যে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করা- আমি মনে করি একজন যুবকের জন্যে এক বিশাল ব্যাপার এবং আমিও তাকে অনুসরণ করে আমার জীবন সঙ্গীতের জন্যে উৎসর্গ করবো বলে স্থির করেছিলাম। তরুণ বয়সে বন্ধুত্ব হওয়ার প্রাথমিক সূত্রটা হতে হয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা রূপক আকারে বলা যায় যে আমাদের বন্ধুত্বটা তৈরি হয়েছিলো নাটক, পারস্পরিক বোধ এবং সঙ্গীতের উচ্চতম শক্তিকে ঘিরেই। যার পরিণতিতে আমাদের আজকের এই সুখি বন্ধুত্ব।
তাছাড়া আমার জীবনটাও এডলফ এর জীবন থেকে খুব আলাদা কিছু ছিলো না। স্কুলে আমি অনেক পিছিয়ে ছিলাম এবং স্কুল আমাকে তেমন কিছু দিতেও পারেনি। বাবা-মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও আমি বড় হতে থাকি একা একাই। সর্বপরি, আমার এই বড় হওয়ার মাঝে শত সীমাবদ্ধতার কথা কারো সাথে শেয়ার করার কেউ ছিলো না।
তবে এ কথা বলতেই হবে আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিলো পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং যে কারণে প্রথম দিকে আমাদের বন্ধুত্বটা একটু কঠিন ছিলো। আমি নিজে ছিলাম খুব শান্ত প্রকৃতির, স্বাপ্নিক, স্পর্শকাতর এবং অনেকটা মিশুক স্বভাবের বলতে পারেন। সঙ্গীতের মতোই অন্যদিকে এডলফ ছিলো বেশি পরিমাণ জেদি, মারদাঙ্গা স্বভাবের। কয়েকটা শব্দ দিয়ে তার চরিত্র বর্ণনা করা সত্যি কঠিন কাজ। তবে এ জায়গাটায় হয়তো আমি এডলফকে ভুলভাবে বুঝতে পেরেছিলাম। সম্ভবত আমাদের মাঝে যে পার্থক্যটা খুবই বেশি ছিলো, তা হল সে যে কোনো বিষয়কেই খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখতো। হ্যাঁ, এটা তার স্বভাবজাত। সবকিছুতেই সে অদম্য উৎসাহ খুঁজে পেতো।
তবে আমাদের জীবনে যত কঠিন আর খারাপ সময়ই আসুক না কেন তা আমাদের বন্ধুত্বে কখনো কোনো বিপদ ডেকে আনতে পারেনি। শুধু আমরা নই, প্রথম যৌবনে সবাই চলমান সময় থেকে একটু আলাদা হয়েই চলতে চায়। অন্যদিকে আমরা কোনো রকম বিবাদে না গিয়ে পারস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। এটা ঠিক যে সে মাঝে মাঝে তার যুক্তিতে এতটাই অটল থাকতো যে বিষয়টি আমাকে লজ্জায় ফেলে দিতো। অতএব সময় যতই যেতে থাকলো আমরা একজন আরেকজনকে আরো ভালো বুঝতে শুরু করলাম।
সম্প্রতি আমি জানতে পারলাম যে আমাদের বন্ধুত্ব স্থায়ী হওয়ার আরেকটা কারণ হলো আমি ছিলাম তার একজন গুণমুগ্ধ শ্রোতা। তবে আমি তার এই আচরণে কখনই অসন্তুষ্ট ছিলাম না, কারণ আমার একাকীত্ব ভরা জীবনে সে বন্ধু হিসেবে একটা জায়গা তৈরি করে নিয়েছিলো। সেও ছিলো ঠিক আমার মতই একা। দু’বছর হলো তার বাবা মারা গেছে। তার মাকে সে খুব ভালোবাসে কিন্তু সেই মাও তার ব্যক্তিগত সমস্যাগুলোর কোনো সমাধান দিতে পারতো না। মনে পড়ে সে প্রায়ই এমন কিছু বিষয় নিয়ে লম্বা লেকচার দিতো যার প্রতি আমার কোনো আগ্রহই জন্মাতো না। যেমন ধরা যাক দানিয়ুব ব্রিজের উপর ট্যাক্স বসিয়ে টাকা তোলা অথবা রাস্তায় জনগণের কাছ থেকে লটারির নামে টিকেট বিক্রি করা। তার কাজ ছিলো শুধু বকবক করে যাওয়া এবং তার সেই বকবাকানি শোনার জন্য একজন যথার্থ লোক ছিলাম আমি। আমি মাঝে মাঝেই তার এই অতিরিক্ত কথাবার্তায় খুব বিরক্ত হয়ে যেতাম। সে কখনো বিষয়টা আমলে আনতো না যে তার বক্তৃতার একমাত্র শ্রোতা শুধু আমিই। তবে আমার এই তরুণ বন্ধুটি তার বক্তৃতা এবং অভিজ্ঞতা বিতরণ করে প্রগাঢ় উৎসাহ পেতো। তার এই বক্তৃতাগুলো বেশিরভাগ সময়ই বর্ষিত হতো ফ্রেইনবার্গের দানিয়ুব এর পাশে, যেন মনে হতো সেখানে আগ্নেয়গিরি থেকে লাভা ঝরছে। মনে হতো যেন সে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে কথা বলে নিজেকে প্রসমিত করছে। এই চিত্রটি শুধুমাত্র আমি নাটকের অভিনেতাদের মাঝেই খুঁজে পেতাম, যারা এভাবে চিৎকার করে নাটকের সংলাপ বলছে। আমি প্রায়ই বিষয়টা খুব স্বাভাবিকভাবেই উপভোগ করতাম এবং হাত তালি দিয়ে তাকে উৎসাহ দিতাম। তবে খুব শিগগির আমি অনুধাবন করতে শুরু করি, এটাতো নাটকের রঙ্গমঞ্চ নয়। না, এটা তার অভিনয় নয়, অতিরিক্ত কোনো অভিব্যক্তিও নয়। এটা ছিলো তার সহজাত এবং সত্যিকারের অভিব্যাক্তি। প্রতিবারই আমি এটা ভেবে বিস্মিত হতাম যে কত সুচারু আর বর্ণিলভাবেই না সে তার বিষয়বস্তুকে তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছে, কত সহজেই শব্দগুলো সে বশ মানিয়ে তার মুখ থেকে আবেগ মিশিয়ে প্রকাশ করছে। এটা এমন নয় যে তার কথায় আমি গলে গিয়েছি বরং বিষয়টা ছিলো তার বাচন ভঙ্গির কারুকাজ। এটা আমার জীবনে ছিলো নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিজ্ঞতা। আমি কখনো ভাবতে পরিনি যে একজন মানুষ শুধুমাত্র তার বাচনশৈলী দিয়ে কীভাবে একটি বিষয়বস্তুকে বাস্তবসম্মত রূপ দিয়ে দিতে পারে। আমার কাছে তার প্রত্যাশাই ছিলো একটাই-তার কথায় সব সময় জ্বী হুজুর করে যাওয়া। আমি বিষয়টি নিয়ে পুরোপুরিভাবেই নিশ্চিত। তার সব রকম ভাবনার সাথে রাজি হওয়াটা আমার জন্য কঠিন কাজ ছিলো না, কারণ তার অনেক সমস্যার সমাধানে আমার কোনো চিন্তা শেয়ার করাই হতো না।
বাংলাদেশ সময়: ১১:১০:২০ ৪৯৩ বার পঠিত