পর্ব ৩
বন্ধুত্ব তৈরি
এখন থেকে আমরা একজন আরেকজনের সব খবরই রাখি, থিয়েটার হলের বাইরেও প্রায় প্রতিদিন আমরা আড্ডা দেই এবং একসঙ্গে লেন্ডস্ট্রাসেসের রাস্তায় হেঁটে হেঁটে গল্পগুজব করি।
লিজ শহরটি গত দশক থেকেই একটি আধুনিক শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে উঠেছে এবং ধীরে ধীরে দানিয়ুব অঞ্চলের মানুষের কাছে শহরটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে শহরের একটু বাইরে গেলে এখনও বাড়িঘরগুলোর চেহারা বন জঙ্গলে ঘেরা খামারবাড়ির মতো চোখে পড়বে। চোখে পড়বে মাঠে গরু ঘাস খাওয়ার দৃশ্যও। শহরতলির একটি ছোট পানশালায় এখনও মানুষজন সেখানকার স্থানীয় মদ পান করতে যায়, যেখানে আপনি মানুষের ভাষায় আঞ্চলিকতার ঘ্রাণ খুঁজে পাবেন। শহরতলির এই দৃশ্য লিজ শহর আপনাকে মনে করিয়ে দেবে যে এটা একসময় বদ্ধ গ্রাম ছিলো। শহরের বসবাসকারীরা কেউ কেউ এ শহরেই জন্মেছেন তবে তাদের বেশিরভাগরাই মূলত গ্রাম থেকে আসা। যদিও গ্রামের সঙ্গে অনেকেরই কোনো নাড়ির টান নেই, তারপরও কোথায় যেনো একটা আত্মিক যোগাযোগ অনুভব করা যায়। সমাজের যারা নামী-দামী মানুষ বিশেষ করে ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, সামরিক কর্মকর্তা- তারা মোটামুটিভাবে সবাই সবাইকে চেনেন ও জানেন। সবাই একসঙ্গে শহরের মূল সড়ক ধরে বৈকালিক হাঁটাহাটিতে মেতে ওঠেন এবং রেলপথের শেষ সীমানা যেখানটায় দানিউবের উপর ব্রিজটি রয়েছে, সেই পর্যন্ত লেন্ডস্ট্রাসেস শহরের আধিপত্য বিরাজ করতো। যেহেতু লিজ শহরে নিজস্ব কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো না, এ কারণে যুবক বয়সীরা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দেখলে তার সঙ্গে কথা বলার খুব আগ্রহ প্রকাশ করতো। লেন্ডস্ট্রাসেসের মানুষের সামাজিক জীবনযাত্রা শুধু ভিয়েনার রিংস্ট্রাসেস অথবা অন্তত লিনজারের সঙ্গেই তুলনা করা যায়।
অ্যাডলফের অসাধারণ কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যের কাছে মাঝে মধ্যে ধৈর্যহারা না হয়ে উপায় থাকতো না। যেমন ধরা যাক, কখনও যদি তার সঙ্গে দেখা করতে দেরি হয়ে যেতো সে সোজা আমার কর্মক্ষেত্রে চলে আসতো, যখন আমি হয়তো পুরনো কালো রঙের একটি সোফা মেরামতে ব্যস্ত অথবা অন্য কিছু করছিলাম। আমার কাজটি তার ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কাছে যেনো কোনো মূল্যই থাকতো না। অধৈর্যের মতো সে তার সঙ্গে রাখা ছোট কালো ছড়িটা বন বন করে ঘোরাতো। আমি তার হাতে অগাধ সময় দেখে খুব অবাক হতাম এবং একদিন বিনয়ের সঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে কোনো চাকরি-বাকরি করছে কিনা।
‘অবশ্যই না’। এটি ছিলো তার দ্রুত উত্তর। তার এই উত্তর আমার কাছে খুব উদ্ভট মনে হতো। তার উত্তরটা এমনভ লম্বা ও কায়দা করে সে দিতো, যেনো মনে হতো- রুটি-রুজির জন্য তার কাজের কোনো প্রয়োজন নেই।
এ ধরনের আচরণ আমি কারও কাছ থেকে আগে কখনও পাইনি। কারণ, এটা আমার জীবন চালিকার পথে প্রতিটা নীতিরই বিরোধিতা করে। প্রথম তার সঙ্গে কথা বলে যৌবনের দম্ভ ছাড়া আর আমি কিছুই দেখতে পাইনি। বিশেষ করে অ্যাডলফ সবসময় তার কথাবার্তায় সেটা প্রমাণ করার চেষ্টা করতো। আমি তার কথায় খুব বিস্মিত হতাম কিন্তু তাকে পুনরায় কোনো প্রশ্ন করা থেকেও বিরত থাকতাম। কারণ, আমি ততোদিনে আবিষ্কার করেছিলাম, ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা সে খুব একটা পছন্দ করে না। বিশেষ করে যেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে সে বিব্রত বোধ করে। তারচেয়ে বরং তার সঙ্গে ‘লোহেংগ্রিন, দি অপেরা’ নিয়ে কথা বলাই অনেক শ্রেয়।
সম্ভবত সে কোনো ধনীর সন্তান হবে। আমার এমনটাই ধারণা ছিলো যে, সে সম্ভবত তেমন একজন ভাগ্যবান যার রুটি রোজগারের জন্য কোনো কাজ করতে হয় না। আমার ধারণা ছিলো, সে এ ধরনের কাজ করতে লজ্জাবোধ করে যা তাকে হয়তো কিছুটা অলসও করে থাকবে। আমরা যখন বোমগার্টনার ক্যাফের পাশ দিয়ে যেতাম তখন সে সেখানকার কিছু যুবকবয়সী খদ্দেরদের সঙ্গে কথা বলতো যারা মার্বেল পাথরের টেবিলটাকে ঘিরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অলস আড্ডায় মেতে থাকতো। সম্ভবত তাদের কেউ কেউ হয়তো ভালো কোন চাকুরে ছিলো অথবা নিশ্চিত আয়ের ব্যবস্থা ছিলো।
তাহলে অ্যাডলফ কী একজন ছাত্র? এটা ছিলো তাকে দেখার পর আমার প্রথম অনুভূতি। হাতে কালো ছড়ি আর সেই সঙ্গে দামী জুতা, নিশ্চয়ই কোনো ছাত্রের সঙ্গেই মানায়। অন্যদিকে, সে এমন একজন বন্ধুকে বেছে নিলো যে কিনা সারাদিন মজুর খাটে আর এই ভয়ে থাকে, না জানি কেউ তার শরীর থেকে আসবাবপত্রের আঠার গন্ধ খুঁজে পায়। অ্যাডলফ যদি ছাত্র হতো নিশ্চয়ই সে সেই সময় কোনো স্কুলে গিয়ে থাকবে। হঠাৎ করেই আমি তার সঙ্গে স্কুল বিষয়ক কথা বলা শুরু করলাম।
স্কুল? শব্দটা শুনে সে যেনো খেঁকিয়ে উঠলো ও এটি ছিলো আমার জন্য তার দিক থেকে এক বাজে অভিজ্ঞতা। সে স্কুল সম্পর্কে কোনো কথাই শুনতে চাইলো না। জীবনে আর স্কুল নয়, সে যোগ করলো। সে শিক্ষকদের ঘৃণা করে এবং তাদের কখনই প্রশংসার চোখে দেখে না। সে তার সহপাঠীদেরকেও খুব একটা ভালোবাসে না। আমি তাকে আমার স্কুল জীবনের ব্যর্থতার কথা খানিকটা তাকে শোনাতে চেষ্টা করলাম। ‘স্কুলে তুমি সফল হওনি কেন?’ সে আমার কাছ থেকে জানতে চাইলো। স্কুলে সবরকম সুবিধা থাকা সত্ত্বেও স্কুলজীবনে আমার ব্যর্থতাকে সে ভালো চোখে দেখতে পারলো না। আমি তার এ ধরনের দ্বৈত মনোভাব দেখে নিজেই দোটানায় পড়ে গেলাম। তবে তার সঙ্গে কথা বলে আমার এটা মনে হলো, সে সম্ভবত সম্প্রতি স্কুল ছেড়েছে, অথবা হয়তো সে গ্রামার স্কুলে পড়াশুনা করেছে এবং ভয়ানকরকম বাজেভাবে হয়তো তাকে স্কুলের ইতি টানতে হয়েছে। এই বিষয়গুলো ছাড়া স্কুল নিয়ে তার এতো আপত্তি থাকার কথা নয়। পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে সে আমার কাছে খুবই বিস্ময় ও অধরাই থেকে গেলো। কখনও কখনও তাকে মনে হতো, সে বুঝি একটা আস্ত শয়তান। একদিন আমরা দু’জন যখন ফ্রেইনবার্গের রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম, হঠাৎ করে সে দাঁড়িয়ে পড়লো এবং পকেট থেকে একটি ছোট কালো নোটবুক বের করলো। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, সে তার সম্প্রতি লেখা একটি কবিতা আমাকে পড়ে শোনাতে শুরু করে দিয়েছে।
কবিতাটি আমার তেমন মনে নেই, মোটকথা তার পরবর্তী অনেক কবিতার সঙ্গে এটির কোনো মিল খুঁজে পাইনি। তবে বিষয়টি আমার মনে দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করেছিলো এই ভেবে যে, আমার বন্ধু কবিতা লেখে এবং আমি যে রাস্তা দিয়ে কাজের যন্ত্রপাতি নিয়ে যাই, সে সেই একই রাস্তা দিয়ে হাঁটে ও তার কবিতা আবৃত্তি করে। যখন অ্যাডলফ তার আঁকা কিছু স্কেচ ও ডিজাইন দেখালো তখন আমি সত্যি হতবাক হয়ে গেলাম এবং তার প্রতিভার কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হতে লাগলো। সে আরও জানালো, তার আঁকা এর চেয়েও অনেক ভালো চিত্রশিল্প আছে এবং সে তার গোটা জীবনটাই চিত্রকলায় মনোনিবেশ করতে চায়। তখন থেকেই আমি আমার বন্ধুটি সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলাম। কয়েকজন আলাদা বিশিষ্ঠ গুণী মানুষ, যারা আমার স্বপ্নলোকে বিচরণ করতেন- সে আমার কাছে যেনো ঠিক তাদেরই একজন হয়ে উঠলো। আমি শুধু ভাবতাম, আমার এমন এক বন্ধু আছে যে কিনা রুটি-রোজগারের কথা না ভেবে নিজেকে শিল্পকলায় নিবেদিত করতে চায় আর কবিতা, ছবি আঁকা, চিত্রকলা ও নাটক নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে চায়। তার এই বিষয়গুলো আমাকে দারুণভাবে উৎসাহী করেছিলো। আমার ভাবনায় চিত্রকলা হলো, খুব অস্পষ্ট একটি বিষয় ঠিক যেমন হিটলার নিজেই। তবে তার সব কাজ আমাকে দারুণভাবে প্রলুব্ধ করেছিলো।
চলবে…
বাংলাদেশ সময়: ৮:০৮:৩৫ ৩৭১ বার পঠিত